• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ২৭)

দার্শনিক হেলাল ভাই

রিনিকে কথা দিয়েছিলাম, অনুষ্ঠান শেষ হলে হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিব। হেলাল ভাইয়ের সাথে সরাসরি কথা বলে ইয়েস/নো যা হয় একটা হবে। তবে ইয়েস যে হবে না তা আমরা জানি। রিনি ‘নো’ হবে, ঝিনি আপা ‘ইয়েস’ হবে এটাই আমাদের ধারণা। বড়বোনকে বাদ দিয়ে ছোট বোনের সাথে প্রেম করার মত মানুষ হেলাল ভাই না। উপরোন্ত ঝিনি আপা দর্শনের ছাত্রী। দু’জনের বাকল একই। আমড়া গাছের বাকল তো আম গাছে লাগে না।
কথাটা হেলাল ভাইকে বলার প্রস্তুতি নিয়েই মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানে গেলাম। আমাকে দেখেই হেলাল ভাই বলল: তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। হেলাল ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করে। চোখে-মুখে গর্বিত ভাব ধারণ করে অন্যদের মুখে তাকালাম। তারপর বললাম: আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন?
: হ্যঁ, তোর জন্য।
: কেন?
: রিনিকে তুই নাকি কথা দিয়ে রেখেছিস যে, অনুষ্ঠানের পর ওর সাথে একান্তে সাক্ষাত করতে হবে।
মাই গড! এ খবর তার কাছে এল কোত্থেকে? আমার মনের প্রশ্ন বুঝে নিয়ে হেলাল ভাই বলল: অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে রিনি আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়েছিল, সেখান থেকেই জানলাম।
মেয়েটা প্রেমের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস দেখছি। এই মেয়েকে সরিয়ে হেলাল ভাই ঝিনি আপার সাথে প্রেম করতে পারবে বলে মনে হয় না। মেয়েটা খারাপ কিছু ঘটিয়ে দিতে পারে। এরকম মেয়েরা খুব বেশি আবেগপ্রবন হয়।
হেলাল ভাই বলল: ভাল একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের নাম বল।
: চাইনিজ রেস্টুরেন্ট কেন?
: রিনির সাথে সাক্ষাত করবো।
: কোথাও ঘুরতে-টুরতে যান। প্রকৃতির কাছে…..।
: আরে না, তোরাও তো থাকবি আমার সাথে।
: আমরা কেন?
: খাওয়া-দাওয়া করবি।
: আমরা থাকলে একান্তে কথা বলতে পারবেন না।
: কথা যা বলার বলতে পারব।
: আপনি কি রিনিকে নেতিবাচক কিছু বলবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
: আমি ওকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে চাই, এখন প্রেম নয়….।
: মেয়েটা প্রচন্ড শক খাবে। গলায় দড়ি-টরি…….।
: দেখিস, আমি সাপ মারব কিন্তু লাঠি ভাঙবে না। মাছ ধরব কিন্তু শরীর ভেজাব না। ফুল ছিড়ব কিন্তু ডাল ভাঙব না। আমি হলাম দার্শনিক হেলাল।
: ইস্কাটনে ভাল একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে। খুব নিরিবিলি। খাবারগুলো ভেরি ডিলিসাস।
: নাম কী ?
: মিকাডো চাইনিজ।
: মিকাডো? মিকাডো অর্থ কী?
: সেখানে আমি অনেকবার গেছি। নামের অর্থ তো জিজ্ঞেস করি নাই। ওদের উচিত ছিল গেটের পাশেই মিকাডো শব্দের অর্থ, উৎপত্তি, ব্যাখ্যা ইত্যাদি লিখে ঝুলিয়ে রাখা। বিদঘুটে একটা নাম রাখবে অথচ……।
: অপরিচিত একটা নাম। তার অর্থ জানতে চাইবি না? কৌতুহল বলে তোদের ভেতর কিছু নেই।
: কৌতুহল আছে, তবে এত খুঁটিনাটি বিষয় জানার ইচ্ছা হয় না।
: হওয়া উচিত, যে যত খুঁটিনাটি বিষয় জানবে, সে তত আনকমন বিষয় জানবে। কমন বিষয় তো সবাই-ই জানে। চীনের রাজাকে বলা হয় সান অব গড, তিব্বতের ধর্মীয় নেতাকে বলা হয় দালাইলামা, জার্মান সাম্রাজ্যের প্রাচীন রাজাদের উপাধি ছিল কাইজার, ভ্যাটিকান সিটির নির্বাহী প্রধানকে বলা হয় পোপ, তেমনি জাপানের সম্রাটদের উপাধি মিকাডো।
আমরা অবাক না হয়ে পারলাম না। হেলাল ভাই সত্যিই অনেক খোঁজ-খবর রাখে। কিন্তু পড়ে কখন? মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানেই তো……। নিশ্চয় রাত জেগে পড়ে। তবে এখানে বসেও পত্র-পত্রিকা খুব খুঁটিয়ে পড়ে। আমরা ওরকম না। হেডলাইন দেখি। যেটা দরকার মনে করি সেটা পড়ি। আবার হেলাল ভাই নানা রকম বই হাতে করেও চায়ের দোকানে আসে। আমরা না থাকলে বসে বসে সে সব বই পড়ে।
তারপর হেলাল ভাই আমাদের একটা তারিখ দিল। সেই তারিখে আমরা সবাই মিকাডো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যাব। আর যাবে রিনি। সেখানে রিনির সাথে হেলাল ভাই কথা বলবে। কী কথা বলবে আমরা তা জানি না। তবে রিনির সাথে হেলাল ভাই প্রেম করবে না তা তো জেনেছিই। প্রেম যদি করে তো ঝিনি আপার সাথেই করবে। সে হিসেবে রিনিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সরিয়ে দিবে এটাই বুঝতে পেরেছি। আর ঝিনি আপার সঙ্গে যখন হেলাল ভাই বাইরে যাবার ডেট করবে, তখন নিশ্চয় আমাদেরকে সাথে নিবে না।
যেদিন মিকডো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যাব।
সকাল দশটা। আমরা মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানে গিয়ে জড়ো হলাম। সেখান থেকে সবাই একসাথে যাব। রিনি গেছে ওর এক টিচারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে। সেখান থেকে ও মিকাডোতে যাবে।
হঠাৎ সেখানে আফজাল ভাই গিয়ে হাজির। তার অগ্নিমূর্তি। হুঙ্কার দিয়ে বলল: আমি আর সহ্য করব না।
সেই অনুষ্ঠানের পর থেকে আফজাল ভাই হেলাল ভাইয়ের ওপর আরও ক্ষেপেছে। তখনই সে বুঝতে পেরেছে, শুধু এ এলাকার ছেলেপেলে নয়, ছেলেপেলের বাপ-মাও হেলাল ভাইকে ভীষণ পছন্দ করে। আর ছেলে-বুড়ো কারও কাছে আফজাল ভাইয়ের নূন্যতম গ্রহণযোগ্যতা নেই।
আফজাল ভাইয়ে হুঙ্কারে ভয় পেয়ে গেলে চলবে না। আমরা ভয় পেলে হেলাল ভাইয়ে অপমানিত করতে সে ছাড়বে না। আমাদের সামনে হেলাল ভাইয়ের অপমান-এটা আমরা সহ্য করতে পারব না।
: আমি বললাম, কী সহ্য করবেন না আফজাল ভাই?
: এইসব নষ্টামি।
: নষ্টামি! কী সব নষ্টামি?
: এলাকার সব মেয়েকে একযোগে প্রেমপত্র দেয়া, আবার একইসাথে দুই বোনের সাথে প্রেম করা। ফিলোসফাররা এতটা বদমাশ টাইপের হয় তা আমার জানা ছিল না। সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিস্টেটল, কান্ট, হেগেল এরকম ছিলেন না। এলাকার মান-সম্মান বলে একটা কথা আছে।
হেলাল ভাইকে ‘বদমাশ’ বলেছে। আমাদের মাথা বেঠিক। গাব্বু গা ঝারা দিয়ে বলল: আফজাল ভাই, লাগাম ছেড়ে কথা বলবেন না। কথার লাগাম ধরে রাখবেন। একসাথে দুই বোনের সাথে প্রেম করছে এ কথা আপনাকে কে বলল?
: বাতাসেরও কান আছে।
: বাতাস আপনার কানে ভুল খবর দিয়েছে। হেলাল ভাই যদি প্রেম করেই তো বড় বোন ঝিনি আপার সাথেই করবে।
: আর ছোটটাকে ছ্যাকা দিবে। অবুঝ মেয়েটা লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাথরুমে বসে কাঁদবে। মেয়েদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা দার্শনিকদের কাজ?
: সেভাবেই কাজ করা হবে, যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। মাছ ধরবে, শরীর ভিজবে না। ফুল ছিড়বে, ডাল ভাঙবে না।
: তোদের কাছে সাপ মারার কায়দা শিখতে চাই না। কথা একটাই, তোদের গুরু নষ্টদের অধিকারে গেছে। তাকে এ এলাকা থেকে তাড়াতে হবে।
: আফজাল ভাই, শুনে রাখেন-আপনার মতো রংবাজের পক্ষে হেলাল ভাইকে এলাকা থেকে তাড়ানো সম্ভব না। এ এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা হেলাল ভাইকে ভালোবাসে।
: কী কইলি? আমি রংবাজ? রংবাজের কী দেখছোস? ঐ আইজ তোরে…..!
আফজাল ভাই লাফ দিয়ে দোকানে ঢুকে গাব্বুকে ধরতে গেল। তার পায়ের ধাক্কা লেগে দোকানের চায়ের কেটলি উল্টে গেল। সেই সাথে উল্টে গেল কেরোসিনের স্টভ। দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠল।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।