• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ৫)

দার্শনিক হেলাল ভাই – ৫

এমন তো হতে পারে, স্কুলের কোনো মেয়েই আপনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। স্কুলের মেয়েদের আবেগ বেশি থাকে, বয়স কম তো।
: বয়সের অনেক ফারাক।
: প্রেমের ক্ষেত্রে বয়স, জাত-পাত-ধর্ম কোনো কিছুই বাঁধা নয়। আমাদের প্রিয় লেখক হুমায়ুন……।
: আমাকে জ্ঞান দিতে আসবি না। যা বললাম তাই কর। স্কুলের মেয়েদের নাম কেটে দে’।
বল্টু দশম শ্রেণির মেয়েদের নাম কেটে দিল। কাটাকাটির পর রইলো বায়ান্নটা নাম।
হেলাল ভাই বলল: বায়ান্ন সংখ্যাটা আমার খুব প্রিয়। ১৯৫২ সালে আমাদের ভাষার লড়াই হয়েছিল। আমার দাদাও সেই লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। দাদা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন আমি নিয়মিত দাদার মুখে ভাষা আন্দোলনের গল্প শুনতাম।
আমরা বড় চোখ করে তাকালাম হেলাল ভাইয়ের দিকে। আমি বললাম: আপনি ভাষা সৈনিকের নাতী?
: হ্যাঁ, এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। এখনও নিয়মিত আমি বাবার কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প শুনি।
হেলাল ভাইয়ের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আরও বেড়ে গেল। ভাষা সৈনিকের নাতী, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। কম কথা নয়।
আমি বললাম: আচ্ছা হেলাল ভাই, আপনি চিঠি লিখুন। কাল থেকেই আমরা চিঠি বিলি করার কাজে নেমে পড়ব।
হেলাল ভাইয়ের পকেটে সব সময় একাধিক কলম থাকে। সুন্দর একটা প্যাডও ছিল কাছে। সেই প্যাড খুলে একটা পাতায় লিখল-
সুরঞ্জনা, অইখানে যেও নাকো তুমি,
বলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুনভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
এইটুকু লিখেই হেলাল ভাই পৃষ্ঠাটা প্যাড থেকে খুলে ফেলল। অপর দিকে নিজের নাম লিখল। তরপর আরেকটা পৃষ্ঠায় এরকম করল। তারপর আরেকটা পৃষ্ঠায়।
হেলাল ভাইয়ের হাতের লেখা দেখার মত। আমরা মুগ্ধ হলাম। কিন্তু এটা কি প্রেমপত্র? যার কাছে পত্র দিচ্ছে তার নামও তো লিখল না। সবাইকে সুরঞ্জনা সম্বোধন করছে।
বল্টুটা বিরক্তিঝরা কন্ঠে বলল: হেলাল ভাই, আপনি কি আমাদের সাথে ইয়ার্কি করছেন?
: ইয়ার্কি!
: আমরা আপনার সব ব্যাপারেই সিরিয়াস। আপনি যদি আমাদের সাথে ইয়ার্কি করেন তো…….।
: দার্শনিক হেলাল ইয়ার্কি করতে জানি না। একজন দার্শনিকের কাছে ইয়ার্কি বলে কোনো শব্দ নেই।
: তাহলে এসব কী লিখছেন? কোনো মেয়ের নামও তো লিখছেন না?
: সব মেয়েই আমার কাছে সুরঞ্জনা। তারা শুধু যুবকের কাছে যায়। এই হৃদয়ে আসে না।
: সবাইকে যদি সুরঞ্জনাই বলবেন তো এত কষ্ট করে নাম সংগ্রহ করার কী দরকার ছিল?
: ওটার দরকার আছে। পরে কে কোনটা চিনতে হবে না?
: কবিতার কয়েকটা লাইন লিখে দিলেন, এটা কি প্রেমপ্রস্তাব পত্র হলো?
: আশ্চর্য! তোদের ভেতর দেখি রোমান্টিকতা বলে কিছু নেই। প্রেমপ্রস্তাবপত্র আর কাওরান বাজার থেকে মাল ক্রয় প্রস্তাবপত্র এক হয় না। মেয়েদের চিনিস না। মেয়েরা ‘আ’ বললে আমেরিকা বোঝে। ‘ক’ বললে কছিমউদ্দিন বোঝে। এতেই ওরা যা বোঝার সবই বুঝে নেবে।
মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানের ভেতরের দিকটার একটা টেবিল আমরা দখলে নিলাম। অন্য টেবিলগুলো টেনে একটু দূরে সরিয়ে দেয়া হল। হেলাল ভাই সুরঞ্জনাদের কাছে প্রেমপ্রস্তাবপত্র লেখায় মগ্ন হয়ে রইলেন। আর আমরা সিঙ্গারা, সামুচা, আলচপ, পিঁয়াজী , বেগুনি, ডালপুরি, কেক ইত্যাদি খাচ্ছি ইচ্ছা মত। আর ক্ষণে ক্ষণে চা তো আছেই। মোজাফ্ফর বিল হিসাব করে লিখে রাখছে। চুকিয়ে দিবে হেলাল ভাই। হেলাল ভাই প্রতিটা চিঠির পাশে টানটোন দিয়ে কিছু আল্পনাও এঁকে দিচ্ছে। বোঝা যায়, হেলাল ভাইয়ের আঁকার হাতও মন্দ না।
রাত আটটার মধ্যে হেলাল ভাই বাহান্নটা চিঠি লিখে ফেলল। তারপর আড়মোড়া ভেঙে (যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল) বলল: মোজাফ্ফর ভাই, চা খাওয়াও। কড়া লিকার দিয়ে লাল চা। চিনি কম। একটু আদার রস মিশিয়ে দিও।
চায়ে চুমুক দিয়ে হেলাল ভাই চোখ বন্ধ করল। চোখ বন্ধ রেখেই বলল: তো কাল থেকেই চিঠি বিলি করা শুরু কর তোরা?
রান্টু বলল: ঠিক আছে, তাই করব।
: ক’দিন লাগবে বিলি করতে?
: কাল এক দিনেই সব জায়গা মত পৌছে দেব। এতগুলো পাবলিক আমরা।
: বাহ! তাহলে আজ ওঠা যাক।
: আমরা আড়মোড় ভেঙে দাঁড়ালাম। বিন্তু গাব্বুটা ওঠে না। বসে থাকে। কেমন গাইগুই করে। হেলাল ভাই বলল: কিছু বলতে চাস?
: আপনি একটা জিনিস লক্ষ্য করেন নাই।
: কী লক্ষ্য করি নাই?
: লিস্টে একটা মেয়ের নাম লাল কালি দিয়ে মার্ক করা আছে।
হেলাল ভাই ধপ করে বসে পড়ল। আমরাও বসলাম। হেলাল ভাই পকেট থেকে লিস্ট বের করল। আমরা একযোগে ঝুঁকে পড়লাম লিস্টের ওপর। হ্যাঁ, সাতাশ নম্বর নামটা ‘সুরমা’। আর সেটাই লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করে মার্ক করা। আশ্চার্য! আমাদের কারো চোখেই পড়ল না।
সুরমা আমাদের সাথেই ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। কলেজ ভিন্ন। কারণ, ও মেয়েদের কলেজে পড়ে। কিন্তু স্কুলে আমরা এক সাথে ছিলাম। আমরা পাশাপাশি বসতাম। তবে সুরমার সাথে আমাদের ভাল বন্ধুত্ব হয়েছিল না। এক পাড়ায় থাকা, এবং এক স্কুলে পড়া সত্ত্বেও আমাদের ভাল বন্ধুত্ব হয়নি। সুরমা মেয়েটা কথা বলে কম। নাক উচু ভাব। কথা বলতে গেলে হ্যাঁ, হু বলে জবাব দেয়।
হেলাল ভাই বলল: তুই সুরমা নামটাকে মার্ক করে রেখেছিস কেন?
গাব্বু আবার মোচড়াতে শুরু করল। আস্ত এক হরিণ খাবার পর অজগর যেমন মোচড়ায়। হেলাল ভাই ধমক দিয়ে বলল: প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিস না যে?
: আপনি সুরমাকে প্রেমপ্রস্তাব পত্র পাঠায়েন না।
: কেন, সমস্যা কী?
: সমস্যা আছে।
: কী সমস্যা সেটা বল।
: লজ্জা লাগে বলতে।
: তুই কি মেয়ে মানুষ? লজ্জা নারীর ভূষণ। বল সমস্যা কী?
: আমি সুরমাকে ভালবাসি।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *