ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ১৫)

কিশোর উপন্যাস

ঢাকা টু মানিকগঞ্জ

১৫।।
কথায় আর গানে আমরা তীর থেকে অনেকটা ভেতরে চলে এসেছি। তীরের বাতিগুলো এখন মিটিমিটি জোনাক পোকার মতো লাগছে। যদিও ইলশেগুড়ি বৃষ্টি আছে, আকাশ অনেকটা পরিস্কার। আমাদের প্রবীন মাঝি গলা ছেড়ে হাক দিলেন: দাদারা, ইলিশ পাওয়া গেলে দয়া কইরা বলবেন। আমার নৌকায় কয়েকজন শিক্ষিত-ভদ্রলোক আছেন। তারা ঢাকা থিকা আসছেন। তাজা ইলিশ দেখার তাদের সখ।
আশেপাশের দু’/একটা নৌকা থেকে বলল: আচ্ছা, আচ্ছা…
আকমল ভাই মাঝিদ্বয়কে বললেন: এখন আর নৌকা চালানোর সেরকম দরকার নাই। এখন শুধু ভেসে থাকলেই হবে। আপনারা শুধু সতর্ক থাকেন যাতে ঢেউ আর স্রোতের সাথে নৌকার ভারসাম্য বজায় থাকে।
নদী জুড়ে মিটিমিটি আলোর মিছিল। সবই মাছধরা নৌকার আলো। দূর গ্রামগুলোকে মনে হয় জমাট অন্ধকার, শিল্পীর হাতের কালো কালির তুলি গাঢ় টান। ঢেউয়ে নৌকা দুলছে। ঢেউয়ের সলাৎ সলাৎ শব্দ। উপভোগ্য, আবার নৌকা বেশি দুললে ভয়ও করে।
মাহাবুব ভাই বললেন: খুব তো সখ পদ্মা নদীতে ভাসতে। পদ্মা নদী আর নদী পাড়ের মানুষকে কেন্দ্র করে লেখা বিখ্যাত দু’টি উপন্যাসের নাম বলতো।
মাহাবুব ভাই যে কোনো পরিবেশে যে কোনো অবস্থায় আমাদের সাধারণ জ্ঞান ঝালাই করে নেন। লাবু ঝট করে বলে দিল: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি।
: আরেকটা?
আমরা কেউ আর কিছু বলতে পারি না। ছগির বলল: তিতাস একটি নদীর নাম, লেখক অদৈত মল্ল বর্মন।
আমরা সবাই উচ্চ কন্ঠে হেসে উঠলাম। মাহাবুব ভাই গম্ভির কন্ঠে বললেন: যে বইয়ের নাম ‘তিতাস একটি নদী নাম’ সেটা পদ্মা নদীর ওপর লেখা হয় কেমন করে?
ছগির বলল: সরি।
: তোর নাম ছগির না হয়ে ছাগল হলে ভালো হত।
: বললাম তো সরি, মানুষ মাত্রই ভুল আছে- ম্যান ইজ মর্টাল।
আমরা আবার হেসে উঠলাম।
মাহাবুব ভাই বললেন: ওর সমস্যাটা কী? ও এমন উল্টাপাল্টা বলতে শুরু করেছে কেন? পদ্মা নদী কি ওকে মাতাল করে দিয়েছে?
মাহাবুব ভাই রেগে যাচ্ছিলেন। আকমল ভাই সেটা ধরতে পেরে বললেন: প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাক এর ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ আরেকটা স্বার্থক উপন্যাস। তবে আবু ইসহাকর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ যেমন ব্যাপক পাঠিত এটা তেমন নয়। এই ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসটা আমার কাছে আছে। তোদের পড়তে দিবো। একজন একজন করে পড়বে, তারপর আমাকে ফেরত দিবে।
মাহাবুব ভাই বললেন: তোদের আউট বই পড়ার পরিমাণ খুবই কমে গেছে।
ছগির বলল: আউট বই পড়ায় আমাদের আগ্রহ আছে, কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়।
: সমস্যা কোথায়?
: স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট টিচার। দম ফেলার সময় নেই।
: এত কোচিং, প্রাইভেট কেন?
: সৃজনশীল পড়াশোনা। সব করে দেয় কোচিং, প্রাইভেট টিচার আর গাইড বই। পাঠ্য বই পড়ে নিজে নিজে নোট করে পড়ার দিন তো এখন নাই। হোমওয়ার্ক করতে হয় তিন জায়গার জন্য। স্কুলের, কোচিং-এর আর প্রাইভেট টিচারের। লেজেগোবরে অবস্থা। আউট বই ধরার সময় আছে?
: শিক্ষার কি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হয়েছে!
: বুঝেন। শিক্ষার নাম হয়েছে সৃজনশীল, কিন্তু ছেলেপেলের সৃজনশীল কিছু চর্চা করার অবকাশ নেই। আমাদের লাইফ ত্যাজপাতা।
: ত্যজপাতা!
: নয়তো কী? মেধাবির সংজ্ঞা তো পাল্টে গেছে। এখন মেধাবি বলতে বোঝে এ+। আকমল ভাইয়ের কি সব বিষয়ে ৮০% নম্বর ছিল? তিনি কত বড় চিত্রশিল্পী হয়েছেন!
ছগির খুব সুন্দর করে কথা বলেছে। মাহাবুব ভাইয়ের কপাল কুঁচকে গেল। চিন্তিত মুখে নদীর দিকে চেয়ে রইলেন।
আকমল ভাই বললেন: যেহেতু আমরা এই লেজেগোবরে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারছি না, এর ভেতর থেকেই তোদের সৃজনশীলতার চর্চা করার সময় বের করে নিতে হবে। যাকগে, এসব ভেবে এই সুন্দর মুহূর্তগুলো নষ্ট করতে চাই না। এখন তোদের পদ্মা নদীর ইলিশ সম্পর্কে একটু ধারণা দেব।
আমরা মনোযোগি ছাত্র হয়ে আকমল ভাইয়ের মুখে তাকালাম। আকমল ভাইয়ের মুখে একটা আলো খেলা করছিল। মনে হচ্ছিল, চাঁদের আলো। আকাশে তাকিয়ে অবাক। মেঘের ফাঁকে একটা চাঁদ উঁকি দিয়েছে। দিনে মেঘের ফাঁকে সূর্য উঁকি দিতে দেখেছি। এই প্রথম মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঁকি দিতে দেখলাম। চঁদের ছায়াটা পানিতেও পড়ছে নিশ্চয়। কিন্তু উত্তাল পদ্মার পানিতে চাঁদের আলো দেখা সম্ভব নয়। চাঁদের আলো দেখতে মজা শান্ত পুকুরের পানিতে। মামা বাড়িতে আমি অনেক দেখেছি। থিরথির করে একটু কাঁপে।
আকমল ভাই বললেন: নদীর ইলিশ একটু বেঁটে-খাটো। আর সাগরের ইলিশ সরু ও লম্বা। সাগর থেকে ইলিশ যখন ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে, তখন নদীর যে প্লাংটন বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী খায় তার কারণে ইরিশ মাছের শরীর মোটা ও বেঁটে হয়। এসব খাবারের ফলে ইলিশ মাছের শরীরে চর্বি জমে যা তার আকৃতিতে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, পদ্মা ও মেঘনার ইলিশ চকচকে বেশি হয়, রং হয় অধিক রূপালী। সবচেয়ে বড় পার্থক্য হয় স্বাদে। কাল সকালে তোদের সে স্বাদ জিহ্বা দিয়ে উপলব্ধি করাবো। পদ্মার ইলিশ ভাজা দিয়ে গরম ভাত খেতে খেতে বুঝবি পদ্মার ইলিশের কী স্বাদ।
আমার জিভের ডগায় পানি টসটস করতে লাগল। তখনই পাশের এক নৌকা থেকে বলল: দাদাগো…., চারখান উঠছে। তাগোরে এইদিকে নিয়া আসেন।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।