: তুমি আমার চিঠি গায়েব করে, এখন আমাকে আন্ডার এজ বানাচ্ছো।
: তোমার চিঠি গায়ের করে আমার কী লাভ?
: লাভ ছাড়াও এই পৃথিবীতে অনেকে অনেক কিছু করে। তোমরা যে হেলাল ভাইয়ের ল্যাজ ধরে থাকো, তাতে কি কোনো লাভ পাও? শোন, আমার নাম তনিমা। হেলাল ভাই তো আমাকে চিঠি দিবেই, তার বাব-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠি আমাকে চিঠি দিবে।
: চৌদ্দ গোষ্ঠির চিঠি নিয়ে তুমি কী করবা? মাথা ঠান্ডা করে লেখাপড়া করো।
বেড়ালের মতো পা টিপে চলার পরও যখন তনিমার সাথে দেখা হয়েই যায়, তখন গাব্বু হাঁটার ধরন পাল্টাল। তনিমাদের বাসার সামনে গিয়ে সে ডাকাতের মতো ধুপধাপ করে পা ফেলে ওপরে ওঠে, বা নিচে নামে। কিন্তু তনিমার কখনো ওর পায়ের শব্দে বের হয় না। গাব্বু একটু অবাক হয়। ভাবে, তনিমা হয়তো চিঠির শোক ভুলে গেছে। মেয়েদের মাথা বলে কথা। কিছু ঢুকলে যেমন খসখস করতেই থাকে। আবার বেরও হয়ে যায়।
একদিন গাব্বুর ওঠার সময় দেখে তনিমা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। একেবারে মুখোমুখি হয়ে গেল। কিন্তু তনিমা কিছুই বলল না। শেষে গাব্বু নিজেই জিজ্ঞেস করল: ব্যাপার কী, চিঠির বিষয়ে আমাকে কোনো চার্জ করছো না যে?
তনিমার মুখে মিটিমিটি হাসি। বলল: এ ব্যাপারে তোমাকে আর চার্জ করব না। আমার চিঠি আমি পেয়ে গেছি।
: পেয়ে গেছো?
: হু।
: কে দিয়েছে?
: আমি হেলাল ভাইকে বলেছিলাম। হেলাল ভাই নিজ হাতে আমাকে চিঠি দিয়েছে।
: হেলাল ভাই নিজ হাতে তোমাকে চিঠি দিয়েছে!
: দাঁড়াও নিয়ে আসছি। তোমাকে দেখাচ্ছি।
তনিমা চিঠি আনতে ভেতরে গেল। গাব্বু অবাক হয়ে ভাবতে লাগল-হেলাল ভাই তাহলে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে। কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না। স্কুলের মেয়েদের চিঠি দিবে না। অথচ ক্লাশ নাইনের একটা মেয়েকে নিজ হাতে চিঠি দেয়। আসলে প্রতিটা মানুষই এমন। নিজের মধ্যে কিছু গোপনীয়তা রেখে দেয়। কখনোই একজন মানুষকে সবটুকু চেনা যায় না, জানা যায় না। মানুষের হৃদয়ের গভীরতা মহাসমুদ্রের চেয়েও গভীর।
তনিমা চিঠি এনে বলল: এই দ্যাখো।
গাব্বু যেন কিছু শুনতে পেল না। তনিমা গলা চড়িয়ে বলল: কী হল? এমন স্টাচ্যু হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? দ্যাখো চিঠি।
গাব্বু সম্বিত ফিরে পেয়ে চিঠি হাতে নিল। খুলে পড়তে লাগল-
স্নেহের তনিমা,
আমার আদর ও ভালোবাসা নিও। তুমি একটু বেশি কথা বলো। মনে যা আসে, মুখে তা প্রকাশ করো। গুণটা ভাল। মনে এক, মুখে আরেক এরকম চরিত্রের মানুষ জটিল ও কুটিল হয়। তুমি মেয়েটা সহজ এবং সরল। তবে একবিংশ শতকের এই পৃথিবীটা মোটেও সহজ-সরল না। তাই সহজ-সরল মানুষকে অন্যেরা বোকা ভাবে। তুমি মোটেও বোকা না। তুমি বুদ্ধিমতি। লেখাপড়ায় ভাল। মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। বইয়ের কীট হয়ে না থেকে, আরও অনেক দিকে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে চেষ্টা করবে। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্পকলা এসব বিষয়ের বই পড়বে। বাইরের এই পাঠটা চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে পসারিত করবে। এটাই সারা জীবন কাজে আসবে। দেখবে পৃথিবীকে জয় করা সহজ হয়ে যাচ্ছে। যারা জ্ঞান অর্জন ব্যতীত নিজেকে চালাক ভাবে, তারা কোথাও না কোথাও ধরা খেয়ে যায়। কথায় আছে, অতী চালাকের গলায় দড়ি। এমনভাবে দড়ি পড়ে যে, জিহ্বা এক হাত বের হয়ে যায়।
আর বিশেষ কিছু লিখব না। তোমার জন্য শুভ কামনা রেখে বিদায়।
ইতি,
দার্শনিক হেলাল ভাই।
চিঠি পড়া শেষ হলে গাব্বুর মুখে মিটিমিটি হাসি। তনিমা বলল: মিচকা শয়তানের মত হাসতেছো যে?
: শোন, এটাকে প্রেমপত্র না ভেবে উপদেশপত্র ভাববে। আর হেলাল ভাই যেরকম উপদেশ দিয়েছে সেরকমভাবে কাজ করবে। অনেক বই পড়বে। বই মানুষকে জ্ঞানী ও মহৎ করে। আর বেশি বেশি গান শুনবে। ইসরাইলের বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সংগীত মানুষের মস্তিস্কে বিশেষ কম্পন সৃষ্টি করে মস্তিস্কের কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ইসরাইলীরা প্রতিটা শিশুকেই পিয়ানো, বেহালা ইত্যাদি বাজানো শেখায়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন চমৎকার বেহালা বাজাতে পারতেন। আর গণিত হল…..।
: তুমি এত কিছু জানো তো চার বছর ধরে নাইন এ বসে খই ভাজতেছো কেন?
গাব্বুর আসল জায়গায় খোঁচা দিতেই গাব্বু থেমে গেল। বলল: আসি তাহলে…..আসি…..!
এসব হল আমাদের একেক জনের ঝামেলা। আবার সবাই মিলে একই ঝামেলার মুখোমুখি হতে লাগলাম।
যেমন অনেক সময়ই আমাদেরকে থামিয়ে কোনো না কোনো মেয়ে বলতে লাগল: ঐ যে খোচা খোচা দাড়ি, বসে যাওয়া গাল সেই লোকটার সাথে তোমরা থাক, তাই না?
আমরা সুবোধ বালকের মতো জবাব দেই: হ্যাঁ, সে আমাদের হেলাল ভাই। দার্শনিক হেলাল ভাই।
কিন্তু ফেকুটা সুবোধ বালক থাকে না। সে রেগে যায়। বলে: এভাবে মানুষের পরিচয় তুলে ধরা অভদ্রতা।
: অভদ্রতা মানে?
: বসে যাওয়া গাল-এ সব বলতে হবে কেন?
: ওমা! তার গাল তো দুই দিক থেকে বসে যাওয়াই।
: তাই বলে সেটা বলতে হবে? তার নাম সবাই জানে-দার্শনিক হেলাল ভাই।
: তা লোকটা দার্শনিক হলেও লুচ্চা টাইপের। দার্শনিকরা লুচ্চা হয় তা আগে জানতাম না।
: খুবই বাজে একটা কথা বললা। হেলাল ভাই নিতান্তই ভদ্রলোক।
: ভদ্রলোক একযোগে এলাকার সব মেয়েকে প্রেমপত্র লেখে?
: স্কুলের মেয়েদের লেখেনি।
: স্কুলের মেয়েদের লেখে নাই বলে বুঝি সে ভদ্রলোক?
: তাকে আমাদের ভাল লাগে। তাকে আমরা ভালবাসি।
: ভাল লাগার কী আসে তার ভেতর?
: তার কাছে না গেলে বুঝবে না। সৈয়দ সাহেবের মেয়ে সৈয়দা নার্গিস জাহানকে জিজ্ঞেস করে দেখো কী আছে তার ভেতর।
: ছে……!
তবে কোনো কোনো মেয়ে আবার ভাল কিছুও বলতো। যেমন-
: তোমাদের ঐ হেলাল ভাইটা না, সত্যিই খুব সহজ-সরল, ভাল মানুষ।
: এরকম কথায় আমরা সবাই একযোগে উৎফুল্ল হয়ে উঠতাম। বলতাম, সিওর, সিওর।
তারপরের কথাগুলো বলত ফেকু। প্রতিবাদ, প্রশংসা সবটার মধ্যে ফেকু আগে। ফেকু বলত: সহজ-সরল না হলে পাড়ার এতগুলো মেয়েকে একযোগে কেউ প্রেমপ্রস্তাবপত্র দিতে পারে না।