এর মধ্যে ঘটে গেল অন্যরকম দুইটা ঘটনা। বোকা-সোকা মফিজটা আন্তঃকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে চলে গেছে। আর মাত্র একটা ধাপ পার হলেই টেলিভিশনে যাবে। আমরা তো প্রথম দিকে একেবারে থ’। এই হাঁদারামটা এমন তর্ক শিখল কীভাবে? আসলে হেলাল ভাইয়ের সাথে তো আমাদের সর্বক্ষণ নানা দিক নিয়ে কথা হয়। রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস, ঐহিত্য। কোনো কিছুই বাদ যায় না। নানা দিকে কথা বলতে বলতে আমাদের অনেক কিছুই জানা হয়ে যায়। আবার হেলাল ভাই তর্কের সময় প্রায়ই বলে, এই বইটা পড়ে দেখিস, ঐ বইটা পড়ে দেখিস। হেলাল ভাইয়ের আছে বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। সেখান থেকেও আমরা বই এনে পড়ি।
মফিজ এইসব জ্ঞান কাজে লাগিয়েছে। ও যে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিল, প্রথমে আমরা তা জানতেই পারিনি। পরে যখন জানলাম তখনও বিশেষ গা করিনি। ধরে নিয়েছি, ও প্রথম ধাপেই বাতিল হয়ে যাবে। যে এক শব্দের পরে তিন মিনিট হু হা করে। অথচ আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওর সে কি ক্ষুরধার যুক্তি! একটার পর একটা ধাপ অতিক্রম করে যেতে লাগল। হয়ে গেল আমাদের কলেজ দলের দলনেতা।
আরেকটা ঘটনা ঘটালাম আমি। হেলাল ভাইয়ের আঁকাআঁকির হাত আছে তা আগেই বলেছি। গল্প করছেন, চা খাচ্ছেন, বসে আছেন তার হাতে আছে একটা কলম, সামনে আছে কাগজ। টানে টানে ফুল, পাখি, লতা-পাতা, বিচিত্রসব আলপনা, নৈসর্গিক দৃশ্য এঁকে চলেছেন। এসব যেন তার অজান্তেই হয়ে যাচ্ছে।
হেলাল ভাইয়ের এই গুণটা আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। সে যখন আঁকে, সবার অজান্তে সেসব লক্ষ্য করতে থাকি। তারপর আড্ডা ভেঙে গেলে আমি হেলাল ভাইয়ের আঁকাবুকির সেইসব কাগজগুলো কুড়িয়ে বাসায় নিয়ে আসি। রাতে বসে বসে আঁকতে চেষ্টা করি। চেষ্টা যে করি তা কাউকে বলি না।
একদিন হেলাল ভাইয়ের বাসায় গিয়ে বইয়ের আলমারিতে পেলাম বেশ কিছু স্কেচবুক। বললাম: হেলাল ভাই, এগুলো নিতে চাই।
: কেন, আঁকাআঁকি করছিস নাকি?
: ঠিক তা নয়, স্কেচগুলো ভালো লাগছে খুব। বাসায় নিয়ে বসে বসে দেখব।
: আচ্ছা, নিয়ে যা।
স্কেচবুকগুলো আমার অনেক কাজে দিয়েছে। নারী-পুরুষের ফিগার আঁকাটা সেই স্কেচবুক থেকে আয়ত্বে নিয়ে ফেলি। নানা রকমের বৃক্ষ, পাখি, প্রাণীদের স্কেচও ছিল। সবই আমি করতে চেষ্টা করি। এক সময় নিজের স্কেচগুলোতে রঙ লাগাতে থাকি। যেন মজার এক খেলা।
একটা পেইন্ট কোম্পানি পত্রিকায় চিত্র প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন দেয়। কাউকে না জানিয়ে আমি এন্ট্রি করে ফেলি। তাদের দেয়া মাপ, এবং অন্যান্য শর্ত ঠিক রেখে ছবি পাঠাই। প্রাথমিক নির্বাচনে আমার ছবি টিকে যায়। আমি চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার জন্য ডাক পাই।
হেলাল ভাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে আমাদের নিয়ে। মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানে বসে মফিজকে চুলচেড়া যুক্তি শেখায়। ওর বিতর্কের বিষয়ের ওপর পয়েন্টের পর পয়েন্ট বের করে। আমাদেরকে দুই দলে ভাগ করে নিয়ে সেই বিষয়ের ওপর বক্তৃতা করায়। এতে পক্ষ-বিপক্ষ সব কথা বের হয়ে আসে।
বিতর্ক শেষ হলে আমাকে নিয়ে বসে ছবি আঁকতে।
হেলাল ভাইয়ের কথা-দুইজন যখন দুই প্রতিযোগিতায় ঢুকে গেছিস, তো চূড়ান্ত চেষ্টা করেই প্রতিযোগিতা ফেস করতে হবে। জয়-পরাজয় পরের কথা।
আমরা হেলাল ভাইকে স্মরণ করিয়ে দেই রিনি আর ঝিনি আপার কথা। হেলাল ভাই বলে, প্রেম আপাতত স্থগিত। প্রেম করার সময় চলে যাচ্ছে না। আগে তোদের প্রতিযোগিতা শেষ হোক।
দুই/তিন মাস কিভাবে কেটে গেল আমরা টেরই পেলাম না। বিতর্কে জাতীয় পর্যায়ে মফিজদের দল রানার্স আপ হল। কিন্তু প্রধান বক্তার পুরস্কার জিতল মফিজ। এ ক্ষেত্রে ‘মফিজ’ বললে ভাল শোনায় না। বলা দরকার প্রধান বক্তা হল, মফিজুর রহমান।
আর আমার ছবিও চ্যাম্পিয়ন হতে পারল না। তৃতীয় হল। তার জন্য সনদের পাশাপাশি পঁচিশ হাজার টাকা পেলাম। আমার বাবা-মা বিস্ময়ে হতবাক। আমার তারিফ করে না মোটেই। শুধু বলে, হেলাল একটা সোনার টুকরা ছেলে। ওর সান্নিধ্যে যেতে পেরে……। একেই বলে সাধুসঙ্গ ইত্যাদি।
তো হেলাল ভাই সিদ্ধান্ত নিল, আমার আর মফিজের সাফল্যের সৌজন্যে পাড়ার ক্লাবে ছোট একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। সবাই হেলাল ভাইয়ের উদ্দেশ্যকে সুস্বাগতম জানাল। শুরু হয়ে গেল সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনের কাজ।
আমাদের দলের সবাই কিছু কিছু চাঁদা দিল। আমি আর মফিজ যেহেতু পুরস্কারের নগদ কিছু টাকা পেয়েছি, সেহেতু আমরা দু’জন কিছু বেশি দিলাম। হেলাল ভাই উৎসাহী মানুষ। সে দিল আমাদের চেয়েও অনেক বেশি।
অনুষ্ঠান তেমন কিছু না। আমাদের নিয়ে হেলাল ভাই এবং বন্ধুদের কেউ কেউ কিছু কথা বলবে। অভিনন্দনপত্র পাঠ হবে। তারপর কিছু গান, কিছু কবিতা আবৃত্তি, কেউ যদি নাচ করে, কৌতুক করে তাও হতে পারে। সবশেষে আপ্যায়ন।
পাড়ার মুরুব্বীদের দাওয়াত করা হল। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েদেরও দাওয়াত করা হল। ছেলেদের তো বিশেষভাবে দাওয়াত করার কিছু নেই। সবাইতো লেগেই আছি।
দাওয়াত করা হল আফজাল ভাইকেও। আফজাল ভাইকে দাওয়াতপত্র দিতে গেলাম আমি আর ফেকু। আফজাল ভাই কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দাওয়াতপত্র হাতে নিল। ফেকু বলল: আফজাল ভাই, আসবেন কিন্তু। বিকেল পাঁচটায় অনুষ্ঠান শুরু হবে।
: তুই কী ছবি আঁকছিলি?
: আমি আঁকি নাই। এঁকেছিল ও…..। ফেকু আঙুল তুলে আমাকে দেখাল।
আফজাল ভাই বলল: আর বিতর্ক করছে কি বল্টু? ও তো আগে থেকেই চাপাবাজ……।
: বল্টু না, মফিজ। বললাম আমি
: বলিস কি! ও তর্ক করতে জানে? ও তো এক কথা তেত্রিশবার বলে।
: হেলাল ভাইয়ের সাথে থেকে থেকে……।
: হইছে হইছে, হেলাল ভাইয়ের সাথে থাইকা তোরা সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিস্টেটল, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট হয়ে যাচ্ছিস। তোদের হেলাল ভাইতো প্রেমের রাজা। তোরা প্রেম সম্পর্কে কী শিখেছিস? মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করোস না?
: যাই আফজাল ভাই, অনেক কাজ পড়ে আছে। আপনি অনুষ্ঠানের দিন আসবেন কিন্তু।
: খাওয়া-দাওয়া আছে?
: আছে, অনুষ্ঠান শেষে প্যাকেট বিরিয়ানি আর কোকাকোলা।
: বলিস কি! এত টাকা-পয়সা……?
: আমরা নিজেরাই সংগ্রহ করেছি। আসবেন আফজাল ভাই।
: আমাকে বলতি, পাড়ার সব দোকান থেকে দুই/তিনশ’ করে উঠিয়ে দিতাম।
: ওভাবে আমরা টাকা তুলতে চাই নাই আফজাল ভাই।
: ও তোরা তো আবার সক্রেটিসের শিষ্য।
: যাই আফজাল ভাই…..।
সবকিছুই ঠিকমতো গোছানো হল। এখন উপস্থাপকের দায়িত্ব কে নেবে? বল্টু নিতে চাইল। ঠিক আছে। বল্টুর কন্ঠের গভীরতা আছে। কথা বলে গুছিয়ে সুন্দর করে। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে না বললেই চলে।