সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব – ১৮)

যুদ্ধ যুদ্ধ
আঠারো
সেদিনই সন্ধ্যাবেলায় মানুষটা কুলতলির হাট থেকে ফিরে স্নানাদি সেরে সবে সন্ধ্যাহ্নিক করে উঠেছে, এমন সময় দয়াল এল তার কাছে।সকালে ফাদার গ্যাব্রিয়েলের তাদের নতুন বসতিতে আসার খবর নিয়ে।খবরটা না দেওয়া পর্যন্ত দয়ালের মন উদ্বেল হয়ে আছে। তার মুখে সব শুনে মানুষটা একরকম উল্লসিত হয়ে উঠে বলল, তমারে সাবাশি দেই আমি দয়াল। তুমি যে সাহস কইরা কথাগুলা সাহেবের মুখের উপর কইতে পারছ তাতে আমি খুব খুশি। এখন থিকা যত তোমরা স্বধর্মকর্ম পালন করবা ততই তমাগ পুন্য অর্জন হইব। তোমাগ পুন্যের শূন্য কলস এই কইরাই পূর্ণ করতে হইব দয়াল। বাঁচবা আর কয়দিন…!
দয়াল মানুষটার কথায় ইতিবাচক মাথা নেড়ে বলল, সেসবে আমি কোনওরকম ত্রুটি রাখব না গোঁসাই। কিন্তু আমার যত দুশ্চিন্তা তো মেয়েটাকে নিয়ে। পারুকে তো কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। ওদের দুজনের সম্পর্কের কথা সবাই জানে। ফলে কী হয়েছে জানেন, কোনও সম্বন্ধ দেখাদেখিতে সাহস করতে পারছি না। লাগানিভাঙ্গানি দেওয়ার লোকের তো অভাব নেই।
মানুষটা দেখল, এই তো মোক্ষম সময় যায় মনের কথাটা খুলে বলার। যা এতদিন সে মনের সংগোপনে পুষে রেখেছে। বলল, তোমার মাইয়াটারে যদি আমি ঘরে তুলি!
দয়াল হতভম্ব হয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকায়। ভাবে, এমন বিকটদর্শন বয়স্ক মানুষটার সঙ্গে তার পারুকে কি মানায়! না, মোটেই মানায় না। কিছুতেই মানায় না। তবে পাত্র গোঁসাইমানুষ, সৎপাত্র। দয়াল অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, এ বিয়ে হলে আপনার কোনও পাপ হবে না তো গোঁসাই? আমরা যে ছোটজাত!
মানুষটা অভয় দিয়ে বলল, ঐ চিন্তা তুমি কইর না দয়াল। সব পাপ কাটাইয়া নেওনের দায়িত্ব আমার। তুমি এই বিয়াতে রাজি আছ কিনা সেইটা কও আগে।
দয়াল অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সাতপাঁচ ভাবে শুধু। অনেক মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রাণপন চেষ্টায় মন থেকে ঝেড়ে ফেলে কোনওরকমে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে সে। ভাবে, স্বজাতের না হোক স্বধর্মে তো গতি হতে যাচ্ছে মেয়েটার! তার উপর গোঁসাই মানুষের বউ হিসেবে সমাজে তার আলাদারকম খাতির যত্ন হবে। গোঁসাইয়ের এখন আয়রোজগার ভাল, মেয়ে তার খেয়েপরে ভালই থাকবে।
নয়া বসতির মানুষগুলোর মুখে মুখে এখন মানুষটার সঙ্গে পারুর বিয়ের সংবাদ। পাত্র হিসেবে মানুষটাকে অনেকের পছন্দ না হলেও মুখ ফুটে তা বলতে পারছে না। অনেকে তা আড়ালে বলছে। কেউ কেউ দয়ালের সামনাসামনি তাদের অপছন্দের কথা বলার পরেও বলছে, তবে এমন পাত্র পাওয়া ভাগ্যেরই ব্যাপার। হোক না পাত্র বয়সে অনেক বড়, দেখতে খারাপ, গোঁসাইবংশের ছেলে বলে কথা! বয়স্কদের কয়েকজন বলল, গোঁসাইয়ের রোজগারপাতি ভাল, মেয়েটা খেয়েপরে ভালই থাকবে।
এই শ্রাবণেই চার হাত এক করে দিতে চায় দয়াল। এখন শুধু একটা শুভদিন ঠিক করার অপেক্ষা। মেয়ে তার চোখের উপর থাকবে, এটাও বড় শান্তির ব্যাপার।
বর্ষাকাল বলে অনেকেই অমত করছে। বলছে, শীতটা পড়ুক।ওই সময় খাওয়া দাওয়া আর আনন্দ করে সুখ। দয়াল তাদের কথা মানছে না। শুভ কাজ সে শীঘ্রই সেরে ফেলতে চায়। মাথার উপর ওই অগস্টিন ছেলেটা যে খাঁড়া হয়ে আছে। কোনদিন কী ঘটিয়ে ফেলে কে বলতে পারে। তখন মানসম্মান নিয়ে গ্রামে থাকাই দায় হবে। তাই পারুকে মানুষটার হাতে তুলে না দিতে পারা পর্যন্ত তার শান্তি নেই।
শুভদিনের অপেক্ষায় একটা একটা করে দিন গোনে মানুষটা। পারু এখন একরকম ঘরবন্দি।ঘরের সবাই মিলে তাকে নজরে নজরে রাখে। মানুষটা মনে করে, এই বেশ হয়েছে। মাঝের এ কটা দিন মেয়েমানুষের একটু সংযমে থাকাই ভাল। যদিও রাত গভীরে শিরিষের পিছন থেকে কোকিলটা প্রতি রাতে ঠিক ডেকে ওঠে। মানুষটা তখন মনে মনে খুব হাসে। ওই ডাককে বিদ্রুপ করে। অস্ফুটে অশ্রাব্য কিছু শব্দও বলে ওঠে। পারুকে জয় করার আনন্দও সেইসঙ্গে উপভোগ করে।
নয়া বসতির ছোটরাও জেনে গেছে, ওদের পারুদিদির সঙ্গে ওই বুড়ো গোঁসাইমানুষটার বিয়ে হবে। জেনে ওরাও হতভম্ব। কিছুতেই ওদের বিশ্বাস হয় না। পারুদিদি কত সুন্দর দেখতে, কী ভাল মেয়ে, তার সঙ্গে কিনা ওই বদখত দেখতে মরাটে একটা লোকের বিয়ে! ওরা কিছুতেই মেলাতে পারে না। আর পারুদিদিও বলিহারি, সে এ বিয়েতে রাজি হল কী করে! কিন্তু এর বিরোধিতা করার ক্ষমতা ওদের নেই। ওরা ছোট, কিসে সংসারের ভালমন্দ হয় তা বড়রাই ভাল বোঝে। তবে ওরা বিরোধিতা না করতে পারলেও মুখে মুখে ছড়া বেঁধে নিজেদের অনিচ্ছা, অসম্মতি, বিদ্রুপ বসতিময় ছড়িয়ে দেয়। ওরা খেলাধুলো, হুটোপাটি, গল্পগাছা, ঠাট্টাইয়ার্কি, কোনও কিছু নিয়ে মজা লোটালুটির মধ্যেও বানানো ছড়াগুলো গুঁজে দেয়,
বুড়ো গোঁসাই বর
নতুন তার ঘর
সুন্দরি তার বউ
বুড়ো ডাকে ভৌ ভৌ!
কিংবা,
পারুদিদির জামাই
গান গেয়ে তার কামাই
পরের পয়সায় গামছা
হাড়েমাংসে চিমসা!
এমনই আরও অনেক ছড়া নয়া বসতির সীমা পেরিয়ে কদিনের মধ্যে গ্রামময় ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের ছড়িয়ে পড়তেও বেশিদিন লাগে না।
এই ছড়িয়ে পড়াকে নিরস্ত করার ক্ষমতা দয়ালের যেমন নেই তেমনি মানুষটারও নেই। ছড়াগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার মুখগুলো দিনে দিনে শুধু বাড়তেই থাকে।
সব জেনেও পারু নির্বিকার!
মাঝে পড়ে লুকাসের বেসামাল অবস্থা, পারুদিদি আর মানুষটার মান বাঁচাতে সে কত আর লড়বে।পারুদিদিকে সে খুব ভালবাসে আর মানুষটার প্রতিও রয়েছে তার অসীম কৃতজ্ঞতা। পারুদিদির সঙ্গে এই মানুষটার বিয়ে হোক তা সে কখনোই চায় না। এ বিয়ে হলে যে পারুদিদি সুখি হবে না তা সে খুব ভাল করেই জানে। ওদিকে মানুষটা বসতির মানুষগুলোকে স্বধর্মে ফিরিয়ে এনে খুব বড় একটা কাজ করেছে। এমনকী তাদের জন্য নয়া বসতির ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছে মানুষটা। সে উদ্যোগ না নিলে তাদের আর স্বধর্মে ফেরা হত না। এ জন্মের মতো পাপের জীবনই কাটিয়ে দিতে হত। আর মৃত্যূর পর নির্ঘাত নরকবাস বাঁধা ছিল। মানুষটা তাদের সে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে। ফলে সয়েনিকে পাওয়ার পথও তার কাছে সুগম হওয়ায় মনে তার আনন্দও কম না।