কচি সর্দারের বউ অহল্যা মরেছে বহু বছর আগে। ওই নদী নিল অহল্যাকে। সেই থেকে বউয়ের খোঁজে পাগল পানা কচি সর্দার। তার হাত ফস্কেই বউটা তার জলের তোড়ে ভেসে গেল। ঘোর বর্ষার জোয়ার, উথাল পাতাল নদী। ঢেউয়ের মাথায় জল মোচর খেলে ডিঙি নৌকোর টালমাটাল দশা। বড় করে একদিকে কাৎ হতে অহল্যা পড়ো পড়ো। কচি সর্দার বউকে বাঁচাতে তার হাত শক্ত করে ধরার উদ্যোগ নিতে না নিতেই ঢেউটা ভেঙ্গে চোরাস্রোতের ঘূর্ণি তৈরি করে আর তাতেই হাত ফস্কে অহল্যা ভেসে যায়। পৃথিবীর আলোহাওয়ায় বারকয়েক বাঁচার আর্তি ছড়িয়ে দিয়ে অহল্যা কোথায় হারিয়ে গেল। কচি সর্দারের বুকে তা এখনও বড় দাগার ঘা। কচি সর্দার মানে, বউ তার আর বেঁচে নেই। যদি সে বেঁচে যেতই তাহলে ঠিক ঘরে ফিরে আসত। বহু খুঁজেছে কচি সর্দার, আজও খোঁজে। সকালবিকেল সময় পেলেই লাঠি হাতে গুটিগুটি পায়ে নদীর কাছে এসে বসে। মনে আশা, বালিয়াড়িতে বউয়ের কঙ্কাল খুঁজে পেল বুঝি কেউ। অহল্যার কঙ্কাল সে নাকি ঠিক চিনে নিতে পারবে। নাকে নথ, কানে দুল, সে নাক কান পচেগলে গেছে। কিন্তু কচি সর্দারের দৃঢ় বিশ্বাস, দুহাতের শাঁখা,পলা, লোহা, বালা এখনও অহল্যার দুহাতে বাঁধা পড়ে আছে। ওসবের নকশা তার মনে এখনও আঁকা। নয়তো হাড়ের গন্ধ শুঁকে সে অহল্যাকে ঠিক চিনে নেবে।
নদীর দুপার জুড়ে বালিয়াড়ি। বিস্তারে ছয় ধুধু পার। মাঝে ফ্যাকাসে নীলচে আলোর রেখাটান আঁকাবাঁকা নদী। তার এখন হাড়গিলে গতর, মরনদশা, থাকা না থাকায় পারের মানুষগুলোর কিছু আসে যায় না আর। মাছ নেই,গভীরতা নেই, নেই নাব্যতা। চলাচলে বানিজ্য তো দূর সম্পর্ক জিইয়ে রাখাটুকুতেও নাচার নদী। তাতে করে নদী মানুষ, দুইয়েরই একে অপরের প্রতি অভিমান, বুকচাঁপা কান্না। সে কান্নার শেষে অন্তহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুইয়ে বুক হাল্কা করে। কেউ কারোর দোসর না আর। মুখাপেক্ষীও না। নিজেদের মতো করে বাঁচে। যেন কত স্বাধীন, জগৎসংসার লুটে নেওয়ার ক্ষমতা ধরে। আসলে তো তা নয়, দুটোতেই হদ্দ অভাগা। মানুষ এবং নদী, গায়ে গায়ে বাস, সে কত হাজার বছরের ইতিহাস, মিলমিশের জীবন ঘুচে যেতে এখন একা বোকার জীবন। নদী নদীর মতো, মানুষ মানুষের মতো।
ভরাগ্রীষ্মের সকাল, মাথার উপরে টনটনে সূর্য খানিক দুপুরের দিকে না গড়াতেই দাবদাহে জ্বলে ওঠে পৃথিবী। মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, বালিয়াড়ি, নদী একই চুলোয় টগবগ ফোটে। এ বড় দুঃসময়, অনটন কাল। ফি বছরের মতো এ বছরও এই নিয়ে কত দুঃখকষ্টের কথা হয়। বুকটা খানিক হাল্কা হয়। হাল্কা মন, উনো পেট, এই দুই নিয়ে দিনাতিপাত মানুষগুলোর।
গনা মন্ডলের চায়ের দোকানে বসে গ্রামের পাঁচজনে এই নিয়েই কথা হচ্ছিল। দোকান বলতে নদীমুখী খড়ের একচালার ছাউনি দেওয়া, মাটির দেয়াল ছোট ঘর এক।সামনে মাটির উনুনে কাঠের আগুন, মাটির বেদীতে লজেন্স বিস্কুটের কটা বয়াম। চায়ের গ্লাস, জলের বালতি, দুধের ভান্ডার, চাপাতার কৌটো, আর সব টুকিটাকি। জোর হাওয়া দিলে খড় ওড়ে, দোকান দোলে। ওড়া বালি ঘেমোগায়ে হামলে পড়ে চিকচিক করে, কুটকুটায়, শ্বাসপ্রশ্বাস ভারি করে। চোখগুলোর সামনে আগুনে হল্কার জোয়ার। যেন কাচস্বচ্ছ জলের থৈথৈ নাচন। হারিয়ে যাওয়া নদীই ফিরে এল বুঝি। মানুষগুলো ফি বছর ওই জলকে সত্যি মেনে খানিক সুখ পায়, দিন ফুরিয়ে সূর্য পশ্চিমে ঢললে জল উবে কোথায় মিলিয়ে যায়! সারা গ্রীষ্মজুড়ে এ এক সুখদুঃখের খেলা। সূর্য ডুবলে বিষাদের ছায়াবুকে মানুষগুলো ঘরে ফেরে।
এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল বৃদ্ধ কচি সর্দার। কুচকুচে কালো পাথুরে মানুষ এক। খালি গা, কোমরে জড়ানো ধুতিকাপড়ের টুকরো। চৌকো মুখমণ্ডলে শক্ত চোয়াল। একমাথা কুচো সাদা চুল। হাতে ধরা পাকা বাঁশের লাঠি। হু বা হাঁ, একটা শব্দও ছিল না মুখে। এবার সে মুখ খুলল, আর তার মুখ খোলা মানে আর সবাই মুহূর্তে মাটির মতো চুপ, উৎকীর্ণ কান, মনভরা কৌতূহল। মানুষটা যে বড় প্রাচীন, এই চলমান পৃথিবীটাকে সে দেখেছে অনেক, তার নাড়িনক্ষত্র মানুষটার মনে নিখুঁত গাঁথা। হাতের লাঠি সামনে উঁচিয়ে দলা দলা শ্লেষ্মার সঙ্গে কথা উগলায়, এই ঝে বটগাছটা দেখচ সকলায়, একানেও নদী ছিল একসময়। ভরা কোটালে তার গতর ফুলেফেঁপে এই দোকানের সীমা পার।
অবাক মানে আর সবাই। বুড়ো গাছটা দোকান থেকে হাত দশেকও দূরে না। ছায়াগায়ে গরুছাগল ঘাস খায়, বিশ্রাম যায়, ছোটরা খেলা করে, বড়রা তাস পিটায়, আড্ডায় মাতে।আর যারা বালিয়াড়িতে কাঠ সংগ্রহে নামে তাদের জিনিসপত্রগুলো শিকড়ের খোঁদলে রাখা থাকে, হদ্দ ক্লান্ত হলে ছায়ায় ফিরে এসে জল পান্তা খায়, খানিক বিশ্রাম নিয়ে ফের কাজে নামে। কত শত বছরের পাহাড় টিলা চড়াইউৎরাই অসমতল সমতলের গাছপালা সব ঝড় বন্যা বানের টানে ভেঙ্গেচুরে উপড়ে জলে ভেসে যেতে যেতে পচে, ভারি হয়, জলের তলদেশে থিতু হয়। সময়ের স্রোতে বালিনুড়ির পলির আস্তরের পর আস্তর পড়ে। গাছপালা শুধু নয়,জলে ডুবে মরা মানুষ পশুপাখিও নদীমাটির গর্ভে ঘুমায়। সে যে কত যুগের হিসাবহীন ঘুম তা কেউ জানে না, রূপরস নিঙরানো কালো কাঠে পরিনত হয়, কয়লাই একরকম। অভাবী মানুষগুলোর হাতে হাতে এখন মাছ ধরার জাল বা অন্যান্য সরঞ্জাম নয়, বরং লোহার তৈরি ভারি শিককাঠি আর বেলচা। রুপোর মতো চকচকে আলো ঠিকরোয়। শীতগ্রীষ্মের খটখটে বালুচরে ওরা শিককাঠি গেঁথে গেঁথে খোঁজে ওই কালো কাঠ। শিককাঠির মাথায় শক্ত কিছু ঠেকল তো আশান্বিত হয়ে ওঠে। তড়িঘড়ি বেলচা দিয়ে বালিনুড়ি সরিয়ে কালো কাঠের টুকরোটাকরা বার করে আনে। বাজারে চায়ের দোকান, হোটেলে এগুলোর খুব চাহিদা। পোড়ে ভাল। আগুন দেয় খুব। ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকে। ওই বেচে মানুষগুলোর কোনওরকমে দিন গুজরান। ভোর থেকে শুরু করে সারা দিনভর বাঁচার রসদ জোগার করতে প্রাণান্ত হয় মানুষগুলো। যেন অলক্ষ্যে এক লড়াইই চলে। সূর্য ডোবার পরেও অন্ধকার না নামা পর্যন্ত দিনের লড়াই শেষ হয় না। কালো কাঠের বোঝা মাথায় পোড়া মানুষগুলো অন্ধকারে সারি দিয়ে পথ চলে। নদী বরাবর সরু মেঠো পথ। জায়গায় জায়গায় ধস নেমে বালিয়াড়ির বুকে পড়ে দিশেহারা। মাটি দম ছাড়ে, উষ্ণ বাতাস এলোমেলো খেলা করে। তাতে ঘর ফিরতি পাখিদের ডানা বেসামাল। মাথার উপর যত নক্ষত্রের মিটিমিটি হাসি।
অতীত দিনের কথা বলে কচি সর্দার, শেষ হতে চায় না। একই কথা বার বার বলে, তবুও শোনার আগ্রহে কারোর ভাটা পড়ে না।কাঠলোভী, বালিলোভী, মাটিলোভী মানুষের কথাও ওঠে। কাটা গাছের শিকড় মাটি আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা হারায়। গোড়াসুদ্দু ধস নেমে নদীর গর্ভ ভরে। জল ধারন ক্ষমতা কমে।ঢেউ ডানা মেলে দুপারে আঘাতে আঘাতে ধস নামায়। মাটি আর বালি চোরের দৌরাত্ম্যে নদী গতিপথ হারিয়ে দিনে দিনে শুকায়। শীর্ণ চেহারায় সারাবছর ভাটা বাসা বেঁধে থাকে। নদী বলে চেনা যায় না। কচি সর্দারের বুকে নদী আর নারী, দুইই হারানোর হাহাকার। লোকে বলে, কচি সর্দারের মৃত্যু নেই যতদিন না বউয়ের কঙ্কাল সে খুঁজে পায়। ভেসে যাওয়া লাশের খবর পেয়ে কোথায় কোথায় ছুটে গেছে মানুষটা। গ্রামের মোড়ল মাতব্বরদের পায়ে পড়েছে, থানাপুলিশে ছোটাছুটিও অনেক করেছে কচি সর্দার । একসময় সে বুঝেছে, আর লাশ নয় লাশের কঙ্কালের খোঁজে ছুটতে হবে তাকে। স্বামী আর ভরা সংসার রেখে মরেছে অহল্যা। অহল্যা তাই সতীলক্ষ্মী। কিন্তু তার অতৃপ্ত আত্মা। অপঘাতে মৃত্যু, শান্তি স্বস্ত্যয়ন না করালে ওই আত্মার মুক্তি নেই, কষ্ট নিয়ে বেঘোরে ঘুরে ঘুরে মরছে শুধু। তাই হাল ছাড়েনি কচি সর্দার। আজও বউয়ের কঙ্কাল খোঁজে।
সময়ের সঙ্গে কচি সর্দার এখন কঙ্কাল সর্দার, কেউ কেউ বলে, কঙ্কালবুড়ো।
নিন্দুকেরা বলে, কাঠ আর কঙ্কাল এত বছরে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। খুঁজে আর লাভ কী! কাঠ আগুন দেয়, জ্বালানির কাজে লাগে। কিন্তু ওই হাড় শুধু ছাই হওয়ার জন্য। কোনও দাম নেই।
কচি সর্দার কষ্টের হাসি হাসে। সখেদে বলে, আগুনটুকা তো পাবে বাপ! আগুন না পেলি যে দেহ শুদ্ধি হয় না। আর দেহ শুদ্ধি না হলি যে সগ্গে যাওয়ার পথও মেলে না গো বাপ।
দুই
কচি সর্দার। মানুষটা সমাজ সংসারে পূজ্যমান।এখনও বউয়ের জন্য মনে তার অফুরন্ত ভালবাসা। মেয়েছেলেরা বলে, স্বামী হবে এমনই, বউকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসবে।
যাকে বলে, যোগ্য স্বামী।
এমন মানুষটা এখন বয়সের ভারে কাবু। বাড়ির সীমানাটুকুও খিয়োতে পারে না। দাওয়ায় বসে সামনের রাস্তার পানে অস্বচ্ছ দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিতে পথচারি কেউ ধরা দিলে শুধু দুটি কথা জিজ্ঞেস করে, কে যাও, কে যাও বাপ? তাকে কি পেলে বাপ?
না, অহল্যার কঙ্কাল আর পেল কোথায় মানুষগুলো। বুড়োমানুষটাকে শুধু আশা দিয়ে রাখে, পাবে একদিন ঠিক। এই করেই মানুষটাকে যতদিন নিজেদের মধ্যে ধরে রাখা যায়!
কিন্তু ধরে রাখা আর গেল কোথায়। জন্ম আছে যদি তার মৃত্যুও আছে। কচি সর্দার বয়সও পেল বহু, যাকে বলে গাছপাথরহীন বয়স। তবে সে এক তাজ্জব করা মৃত্যু। এই শরীর নিয়ে মানুষটা ওখানে কী করে গেল!
ভরা পূর্ণিমার রাতের ভোর তখন। চাঁদের আলোর ছটা নেই আর। পুব আকাশের মেঘ ফুঁড়ে সবে সূর্যটা পৃথিবীকে মুখ দেখাতে চাইছে, কাঠ সংগ্রহে আসা মানুষগুলো দেখল, মরা নদীর কোল ঘেঁষে চিৎ হয়ে শুয়ে প্রাণহীন কচি সর্দার। আশেপাশে কটা গর্ত।ওগুলোর গায়ে আঙুল চালানোর দাগ। কচি সর্দারের দুহাতে বালির মাখামাখি, তাতে কালচে ছোপ ছোপ। বুকের উপর ছড়িয়ে কটা কালো টুকরোটাকরা। মানুষগুলো বুঝবার চেষ্টা করছে ওগুলো কাঠের নাকি কচি সর্দারের বউ অহল্যার হাড়ের!
গেল রাত্রে গ্রামের অনেকেই কচি সর্দারকে স্বপ্নে দেখে। তাদের দেখা স্বপ্নের ঘটনা সবার একই রকম, কঙ্কালকাঁধে কচি সর্দার মিশকালো মেঘেদের চড়াইউৎরাই ভেঙ্গে পৃথিবীর দিকে নেমে আসছে। তার মাথার উপর অনেকগুলো শকুন। ওদের ডানার ছায়া ঢেকেছে কচি সর্দারকে, তার কাঁধের কঙ্কালকে। কচি সর্দার নেমে আসছে নদীর বুক বরাবর।
নদী তখন ভরাভারা। তাতে প্রবল ঢেউ। ঢেউয়ের মাথায় উথালিপাতালি একটা ডিঙি নৌকো।
সবাই বলাবলি করছে,ওটা অহল্যার কঙ্কাল। দুজনে একসঙ্গে মরবে বলে ওই ডিঙিনৌকোর আয়োজন করেছে সেই কবেকার নদী!