• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব – ১৪)

যুদ্ধ যুদ্ধ

চোদ্দ

সময় এক আশ্চর্য মনোবৈকল্য রোগের ওষুধ। শোকতাপ, দুঃখকষ্ট, দুর্দশার দিনগুলোর দুঃসহ স্মৃতিগুলোকে একটু একটু করে মন থেকে ফিকে করে দেয়। চলমান জীবনের সঙ্গে মানুষ ফের সড়গড় হয়ে উঠতে থাকে।উঠতে হয়। নয়তো জীবন চলে না। জীবনের প্রবাহ স্তব্ধ হয়ে যায়। যা প্রকৃতিবিরুদ্ধ।আর যা কিছু প্রকৃতিবিরুদ্ধ তার প্রতিশোধও আছে। সে বড় ভয়ঙ্কর। সাধারণ মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। জন্ম আর মৃত্যু হাত ধরাধরি করে চলে, বিচ্ছেদশোক তাই সাময়িক। কিংবা চলমান জীবনপ্রবাহের সাথী করে অন্তরে ফল্গুধারার মতো করে বয়ে নিয়ে চলতে হয়। আমৃত্যু। বসতির মানুষগুলোর জীবন হল, খেটে খাওয়া মানুষের জীবন।কাজ নেই তো পেটে ভাত নেই।কাজ আর কাজ, কাজ নেই তো তার অন্বেষণ আর অন্বেষণ। এভাবেই ওদের জীবন চলে। শোকতাপ যাপনের সময়ের আকাল ওদের। কয়েকদিনের মধ্যে বসতির মানুষগুলোর জীবনযাপনও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে সকলের মনে একটাই আশা জেগে রয়েছে যে পিটার একদিন ঠিক বেঁচে উঠবে। আর বসতির সবার মধ্যে ফিরে আসবে। সে এক আশ্চর্য আনন্দের দিন হবে। পিটারের মৃতদেহ বয়ে নিয়ে ভেলা যে ঘাটেই ভিরুক, যেখানে গিয়েই পিটার বেঁচে উঠুক সে নির্ঘাত তাদের মধ্যে ফিরে আসবে। পিটার ওর গ্রামের নামধাম ঠিকানা সবই জানে, সুতরাং ফিরে আসতে কোনও অসুবিধা হবে না। তাছাড়া সেরকম অসুবিধা হলে পাঁচজনে কি তাকে ঘরে ফিরতে সাহায্য করবে না? ঠিক করবে! বসতির মানুষগুলোর চোখ তাই থেকে থেকে সামনের মেঠোপথ আর ভেড়িবাঁধের দিকে পড়ে। কোন পথে যে পিটার ফিরে আসবে তা জানে না তো ওরা। সবাই মনে মনে পিটারের ফেরার আনন্দের উৎসব উদযাপনে মাতে। সে এক স্মরণীয় দিনই হবে বটে। মৃত্যুকে হারিয়ে জীবন ফিরে পাওয়া কি চাট্টিখানি ব্যাপার! পিটার নিশ্চিত এক আশ্চর্য ক্ষমতাধর ওঝা বা গুণীনের হাতে পড়বে। তার ঝাড়ফুঁকেই পিটার সুস্থ হয়ে উঠবে। দিন গোনে ওরা, গুনতে গুনতে দিনের সংখ্যা বাড়ে। গোনার সাধ্য কমে আসে। গোনায় একে অপরের মধ্যে অসংগতি দেখা দেয়। সে হোক, পিটারের ফিরে আসার আশা কারোর মন থেকে মুছে যায় না।
লুকাসও ভাইয়ের মৃত্যুশোক অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। তার মধ্যে ফের প্রেমিকভাব জেগে উঠছে। মানুষটাকে তার এখন খুব দরকার। খানিক আগে সে এসেছে মানুষটার কাছে। তার কিছু আগে দয়াল মানুষটার সঙ্গে অনেক গভীর গোপন আলোচনা সেরে গেছে। দয়াল আকুতিভরা কন্ঠে মানুষটাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখন আমাকে কী কী করতে হবে আপনি আমাকে বলুন, আমি তা সব পালন করব। মানুষটা বলেছিল, এ তোমাগ অনেক দিনের পাপ দয়াল, কঠিন প্রাচিত্ত করন ছাড়া গতি নাই। তবে তুমি ঘাবড়াইও না, প্রাচিত্ত যাতে কম খরচের উপর দিয়া হয় সেই ব্যবস্থা আমি করুম। আমারে তো তোমাদের নিয়াই বাঁচতে হইব, নাকি?
লুকাসের হাসি হাসি মুখ দেখে মানুষটা অবাক। কী এমন হাতি ঘোড়া মেরে এল বেটা! জিজ্ঞেস করতে লুকাস উৎফুল্ল হয়ে বলল, এই খানিক আগে সয়েনির গায়ে আপনার দেওয়া মন্ত্র পড়া সজারুর কাঁটা ফুটিয়ে এলাম গোঁসাই।যন্ত্রণায় চিৎকার করে না ওঠা পর্যন্ত সয়েনিকে আমি ছাড়িনি। তারপরই ওই মন্ত্র পড়া ধুলো আর সঙ্গমের জল ওর গায়ে ছিটিয়ে দিই। এখন ওকে নিয়ে তিন রাত্রি কোথাও কাটিয়ে আসতে হবে। তাই বলছিলাম গোঁসাই, আপনি যদি কিছু টাকা দিতেন তাহলে বাকি কাজটুকু এই সপ্তাহের মধ্যে সেরে ফেলি।
লুকাস সয়েনিকে বলেছিল, তোর সঙ্গে আমার খুব দরকার। তাতে করে আমাদের দুজনেরই লাভ। তোকে বলেছিলাম না, আমার কাছ থেকে তোকে কেউ কোনওদিন কেড়ে নিতে পারবে না, তারই পাকা ব্যবস্থা করব কাল, কাঠ কুড়োতে কুড়োতে গইয়ের কাছে আসিস, আমি আগে থেকে ওখানটায় থাকব। আসিস অবশ্যই যদি আমাকে সত্যিই ভালোবাসিস!
জোয়ার নেমে নদীতে ভাটা লাগলে যত ভেসে চলা কাঠকুটো চরায় আটকে পড়ে। ওগুলো রান্নার জ্বালানি হয়। আর পাঁচজনের সঙ্গে সয়েনিও কুড়োতে যায়। নদীর বড় বাঁকের মুখে গই। অতদূর বড় কেউ একটা যায় না। আরও বেশি কাঠ কুড়োনোর অছিলায় সয়েনি প্রায়ই যায়। ওখানে লুকাস তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করে। বড় নির্জন সুনসান জায়গা। দুজনের মনের কথা হয়। কিন্তু আজ হল চরম কিছু। গইয়ের গা ধরে একটা চওড়া খাদ মতো। খাদের বুক খানিক সমতল। সেখানে কটা বানী আর হরা গাছ, নীচে কিছু গুল্ম আর লতাপাতার জড়ামুড়ি। একে অপরকে একান্তে কাছে পেতে দুজনে খাদে নেমে আসে। আজ হঠাৎই লুকাস সয়েনিকে জড়িয়ে ধরতে সয়েনি আতঙ্কে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে জোর করলে লুকাস বলেছিল, ভয় পাস না, তোকে চিরদিনের জন্য পাওয়ার জন্যই…। তৎক্ষণাৎ কোমর থেকে সজারুর কাঁটাদুটো বার করে…
অরে নিয়া পলাইয়া যাওনের আর দরকার নাই তর। কাঁটা ফুটাইছস তাতেই হইব। এখন কয়টা দিন চুপ মাইরা থাক। আর কী কান্ডটাই না ঘটাই তা দেখতে থাক! জোরের সঙ্গে লুকাসকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলল মানুষটা।
আমি আপনার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না গোঁসাই! লুকাস যেন হঠাৎ আকাশ থেকে পড়া একটা মানুষ এখন। বোধবুদ্ধিরহিত ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি তার। দেখে মজা উপভোগ করছে মানুষটা। মজা উপভোগ করারই তো সময় এখন মানুষটার। একটু একটু করে সে বসতির মানুষগুলোকে নিজের আয়ত্তে আনতে পারছে। নিজের সুবিধার জন্যই এই আয়ত্তে আনার আপ্রাণ চেষ্টা মানুষটার। নতুন করে জীবন শুরুর ধূসর স্বপ্নে একটু একটু করে সফলতার আলোর রেখাপাত ঘটছে।ওই আলোর বিস্তার দিনে দিনে আরও বাড়বে। স্বপ্নটা পুরোপুরি আলোকিত হয়ে বাস্তবের মাটিতে শিকর চাড়াতে থাকবে একটা সময় আর ততই এই মাটিতে থিতু হওয়ার সুস্থিতি অর্জন করতে থাকবে মানুষটা। দয়াল, বাজার কমিটির মাথা মুকুন্দ পোদ্দার আর পাঁচগ্রামের পাঁচজন গন্যমান্য স্বধর্মের মানুষজন তার এখন সহায়। ওরা পাশে এসে দাঁড়ানোয় বেশ বলভরসা পাচ্ছে মানুষটা। বুদ্ধিই যে বল, এ কথাটা যে একদম ঠিক তা মনেপ্রাণে মানে মানুষটা এখন। তা নইলে এই দেশে এসে এত অল্প সময়ের মধ্যে নিজের পায়ের নীচের মাটি সে এতটা শক্ত করতে পারত না। সবই বুদ্ধির জোরে ঘটছে।
একসময় মানুষটা দরাজ গলায় খানিক হেসে উঠে বলল, বুঝবি বুঝবি, সময় হইলেই বেবাক বুঝতে পারবি। ধৈর্য্য ধর। বলেই মানুষটা কুৎ কুৎ চোখে লুকাসের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় মিটিমিটি হাসতে থাকে।
এখনও লুকাস যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে। কেন যে সয়েনিকে নিয়ে তিন রাত্রি সহবাস করার আর দরকার নেই তা লুকাস কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। না করতে হলে খরচের দায় থেকে সে বেঁচে যায় ঠিকই কিন্তু সেইসঙ্গে তার ভাবনাও হয়, তাতে করে যদি সে সয়েনিকে আদৌ না পায়! বড় চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে। অথচ মানুষটা এখনও কেমন চিন্তাহীন, দিব্যি মিটিমিটি হেসেই চলেছে!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।