• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব – ১২)

যুদ্ধ যুদ্ধ

বারো

ছুটির দিন হলে কী হবে দয়ালের হাত থেকে বসতির পুরুষমানুষগুলোর রেহাই হল না। সন্ধ্যাবেলায় সবাইকে একরকম ধরেবেঁধে মানুষটার জন্য ঘরবাঁধার কাজে লাগিয়ে দিল। কাল রাতে মানুষটা যে কষ্ট পেয়েছে তারপর আর দেরি করা যায় না। চোখের উপর এমন একটা মানুষ কষ্ট পাচ্ছে তা দয়াল কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
একদিনের ঝড়বৃষ্টিতে ঘরের কাঁচা দেয়াল আর পিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খুব। চালাটা বাঁধার পরেপরেই খড় চাপিয়ে দিতে পারলে এতটা ক্ষতি হত না। এখন যত শীঘ্র সম্ভব কাজটা শেষ করতে হবে। অল্প বয়সী ছেলেগুলোও কাজে হাত লাগিয়েছে। ওদের একজন খড়ে জল দিচ্ছে। একজন কাদামাটি পাড়িয়ে নরম করছে। দড়িদড়া এগিয়ে দিচ্ছে আরেক জন। ওদের দলে লুকাসও আছে। কাল বাদে পরশু ভরা পূর্ণিমার রাত, মানুষটার মন্ত্রপড়া কাঁটা সে রাতগভীরে জোয়ারে খেলাবে। তখন সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ থাকবে। স্মরণে থাকবে শুধু কামরূপ কামাখ্যা মা। তারপর ভরা অমাবস্যার রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। ভাঁটাতে কাঁটাদুটোকে ফের খেলাবে। আরেক অমাবস্যার রাতে ওদুটোকে সয়েনির গায়ে ফুটিয়ে দিতে সয়েনি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠবে। আর ঠিক তখনই দুই নদীর সঙ্গমের জল আর কালীর থানের ধুলো তার গায়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। এ পর্যন্ত এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। যত চিন্তা হল ওই তিন রাত্রির সহবাস নিয়ে। সয়েনিকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যেতে হবে। যেখানেই যাক, তিন রাত কাটানোর জন্য তার কিছু টাকা দরকার। কিন্তু তা সে কোথায় পাবে। যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা করার কথা ভাবে।
তখনই এক বিকট আর্ত চিৎকারে পৃথিবীর নীরবতায় ফাটল ধরল, ও মাগো, ও বাবা গো, আমাকে সাপে কেটেছে গো! আমি আর বাঁচব না গো!
বাঁচার এক তীব্র আকুতি ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। নদীও বুঝি তার চলা থামিয়ে দিয়েছে ওই আর্তকান্না শুনে। যদি সেও কোনওভাবে উপকারে আসতে পারে। নাকি মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে মৃতদেহ বয়ে দৈবের হাটে নিয়ে যাবে বলে। সেখানে নাকি মহা মহা ওঝাগুনিন আছে। তাদের হাতে পড়লে মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার তারা করবেই। নয়তো ওই দেহ মাটি পায় না, আগুন পায় না। শিয়াল শকুনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। সময়ের সঙ্গে ভেলা নষ্ট হয়। কঙ্কাল নদীর তলে চিরসমাধি নেয়।
সবাই ঘরবাঁধার কাজ ফেলে নদীর পাড়ে ছুটে এল। ছুটে এল সারা বসতি। লুকাসের ভাই পিটারকে সাপে কেটেছে। বছর চোদ্দ বয়স পিটারের। মাটির কলসি হাতে সে নদীর চরায় নেমেছিল চৌখুপি থেকে জল তুলতে। ওই জল দিয়ে দেয়াল তোলার মাটি কাদা করা হয়। কেউটে সাপটার লেজে পা পড়তেই সাপটা মুহূর্তে পিটারের পায়ে ছোবল বসায়। তারপরই সাপটা উধাও!
ছেলের আমার এ কী সব্বনাশ হল গো! ও মা মনসা, ও বাবা বিষহরি, ছেলে আমার বুকের ছা, আঁচলের ধন, সে আমার মানিক, তাকে তুমি এভাবে আমার বুক খালি করে নিয়ে যেও না গো! পিটারের মা শেফালি ভেড়িবাঁধের উপর মাথা কুটে কুটে কাঁদছে। পরনের শাড়ি আলুথালু। কপালের সিঁদুর লেপ্টানো। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। দুহাত দিয়ে হাড়জাগা বুকে চাপড়ের পর চাপড় মারছে। মুখে করুণ আর্তি, ও প্রভু, হে ঈশ্বর, তোমার অশেষ করুণা, ছেলেকে আমার দয়া কর, ও আমার বুকের ছা, জেনে বুঝে কোনও দোষ তো করেনি, তবে কেন তাকে কেড়ে নেবে প্রভু। ছেলেকে আমার কোলে ফিরিয়ে দাও প্রভু। তোমার বেদীতে আমি একশো একটা মোমবাতি চড়াব প্রভু। পরক্ষণে সর্পদেবী মনসার উদ্দেশ্যে বিলাপ করে কাঁদছে, ও মা মনসা, বিষহরি, দয়া কর মা, দয়া কর…!
তিন চারটে বউ শেফালিকে শক্ত করে ধরে আছে। একজন বলল, ছেলে তোমার প্রভুর দয়ায় ঠিক বেঁচে উঠবে কেঁদো না। আমরা এতগুলো লোক রয়েছি কী করতে, চেষ্টার কোনও খামতি রাখব না। আরেকজন বলল, তুই না ছেলের মা, তোকে যে শক্ত হতেই হবে রে। তা নইলে তোর ছেলের মনও যে ভেঙ্গে যাবে। ভাঙ্গা মন কখনও বেঁচে ওঠার শক্তি দেয় না জানবি। প্রভুকে ডাক, প্রভুকে ডাক। তিনি ঠিক রক্ষা করবেন।
তোর কোল থেকে কে ছেলে কেড়ে নিতে চায় তাকে আমি দেখতে চাইরে মা! এই আমি দয়াল রুইদাস, এখানে খুঁটো হয়ে বসলাম। আমি যদি প্রভুর সত্য সেবক হই, আমি যদি তেত্রিশ কোটি দেবতার একনিষ্ঠ ভক্ত হই তাহলে যমকে এখান থেকে ফিরে যেতেই হবে। বলতে বলতে দয়ালের গলার শিরাগুলো যেন নতুন রক্তের জোয়ারে টইটম্বুর হয়ে উঠছে। সারা শরীরের পেশিগুলো ধনুকের ছিলার মতো টনটনে দেখাচ্ছে। বুকের ছাতি আত্মশক্তিতে ফুলে ফুলে উঠছে। মুখাবয়বে ফুটে উঠছে ইস্পাতকঠিন প্রত্যয়।ভিড়টার উদ্দেশ্যে বলল, বাঁধ, কষে বাঁধ, বাঁধনের ওপর বাঁধন মার! বিষ যেন কণাটুকু পরিমাণ উপর দিকে উঠতে না পারে।
শেফালি ডুঁকরে কেঁদে উঠে দয়ালের উদ্দেশ্যে বলল, সে মানুষটা ঘরে ফিরে এসে কী সব্বনাশটাই না দেখবে গো জ্যেঠা! আমি তাকে কী বলে বুঝ দেব গো!
চুপ কর মা, চুপ কর। সব দংশনে বিষ থাকে না রে মা। কেউ একজন দৌড়ে যা, একটা শুকনো লংকা পুড়িয়ে আন তো দেখি।
এতক্ষণ পিটারের শরীরটা মাটির ওপর বসানো ছিল, পারু এসে তাকে নিজের কোলে বসিয়ে মাথাটা কোলের ওপর ফেলে বসল। বলল, একদম ভয় পাবি না পিটার। সব ঠিক হয়ে যাবে। চোখ বুজবি না মোটে। দেখতো, আমরা সবাই আছি না এখানে! ভয় কী তোর। একসময় পারু আকাশের দিকে তাকাল। বলল, দেখ পিটার, দেখ, কত সুন্দর জ্যোৎস্না ফুটেছে আজ, কত শত চকচকে  তারার মেলা। তার নীচে নদী বইছে দেখ কেমন সুন্দর। ওপারের দিকে তাকা, তাকা না ভাল করে! ঘরে ঘরে কেমন সুন্দর ডিবির আলো জ্বলছে দেখছিস? এবারের বড়দিনের মেলা থেকে তোকে একটা বাঁশি কিনে দেব। তুই যা যা খেতে চাইবি সব খাওয়াব।
পোড়া শুকনো লঙ্কাটা হাতে নিল পারু। বলল, নে পিটার, এটা একটু চিবো তো ভাই, হা কর, হা…।
কোনওরকমে হা করে লঙ্কাটাকে চিবোতে শুরু করে পিটার। তার দুচোখের ওপর সব কেমন ধূসর হয়ে আসছে। নদীটা যেন এক কুটিল কালো বিষের ধারা। তার ওপারে কোথায় আলো! শরীরের কোষে কোষে অসংখ্য সুঁই ফুটছে। সারা শরীর তীব্র যন্ত্রণার আধার হয়ে উঠছে। তার কান্না বন্ধ হয়ে গেছে কখন। ভয় আশঙ্কাও দেহ ছেড়ে গেছে, সে এখন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণহীন। চিন্তা চেতনাবোধ দেহের অধিকার হারিয়ে ফেলছে। কিছুতেই আর চোখ মেলে রাখতে পারছে না। চোয়াল দুটো শিথিল হয়ে আসছে।
পোড়া লঙ্কার কেমন স্বাদ পাচ্ছিস পিটার?
পারু জিজ্ঞেস করল। একই সঙ্গে ভিড়টাও আর্তচিৎকার করে জানতে চাইল, বল পিটার, বল…। চুপ করে থাকিস না।
বিষিয়ে ওঠা রক্তের কালো ছায়া পড়েছে পিটারের সারা মুখমণ্ডলে। মৃদু বাতাসে শুকনো পাতার তিরতির কাঁপুনির মতো তার ঠোঁটদুটো কাঁপছে। সে ক্ষীণ গলায় অস্ফুটে বলল, তি… ই… ই… তো… ও… ও…!
সহসা ভিড়টা হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। আকাশে বাতাসে ওদের কান্নার রোল ছড়িয়ে পড়ছে। পিটারের জিহ্বায় বিষের স্বাদ। শেফালি তার বুকের খাঁচায় ফের আঘাতের পর আঘাত করছে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে তার। কথা বন্ধ হয়ে গেছে। অব্যক্ত যন্ত্রণার গোঙানি শুধু। মাথাটা পাগলিনীর মতো এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে। নিমিলীত দুচোখ। দাঁতের পাটি দুটো বজ্র আঁটুনির মতো লেগে আসছে যেন।
লুকাস এতক্ষণ ভিড়ের মধ্যে একরকম হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে সে এখন, কী তার করণীয়, কিছুই বুঝতে পারছে না। বাপ তার অন্য কাজ পেয়ে বাড়িছাড়া। গেছে সেই মন্ত্রীপুরে। এই অসময়ে কী করে বাপকে সে এই দুঃসংবাদ দেয়। আজকের মত নৌকোপথে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। সড়কপথে দীর্ঘ হাঁটা।তারপর খেয়া পেরনো। রাত কাবার হয়ে যাবে। বাপটা কবে ফিরবে তারও ঠিক নেই। ভাইকে বাঁচানোর উপায় হিসেবে গোঁসাই মানুষটার কথা মনে পড়ল তার। মানুষটা তো তার অসীম ক্ষমতার কথা বারবার বলে। সে এই ভেবে অবাক হয় যে, এতক্ষণ সে কী করে মানুষটার এত ক্ষমতার কথা ভুলে ছিল! সে ভিড়টার উদ্দেশ্যে বলল, এখন একমাত্র গোঁসাইই পারেন ভাইকে বাঁচাতে। আমি যাই তাকে ডেকে নিয়ে আসি।
শুনে সবাই কেমন অবাক চোখে লুকাসের দিকে তাকায়। মানুষটার অনেক ক্ষমতার কথা একমাত্র লুকাস জানল কী করে! ভিড়টা সম্ভবত এরকমই কিছু ভাবছে। মানুষটা তো এখনও পর্যন্ত অলৌকিক ক্ষমতার কিছু দেখায়নি তাদের, অবশ্য দেখাবেই বা কী করে, তেমন কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে বসতির মানুষগুলো ইতিমধ্যে পড়েইনি। হয়ত লুকাসের কাছে নিজের ক্ষমতার কথাগুলো বলেছে মাত্র। শুধু পারু অবিশ্বাসের জটিল চোখে একবার লুকাসের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই কী মনে করে মৃতপ্রায় লুকাসের পাংশু মুখের দিকে তাকায়।
দয়াল বলল, গোঁসাই আমাদের জাতের ছেলেকে ছোঁবে কেন? তাতে আমাদেরও পাপ হবে যে। লুকাসকে বলল, তুই বরং কাউকে সংগে নিয়ে ভরতগড়ের পঞ্চানন ওঝার বাড়ি যা। আর দুজন যাক হিরন্ময়পুর, যতীশ ওঝার বাড়ি। যাকে পাওয়া যায়। দুজনে এলেও ক্ষতি নেই। যা বাবা, আর দেরি করিস না।
দয়ালের শরীরমনের তেজ নরম হয়ে আসছে। মনে মনে সেও প্রমাদ গুনছে। তবুও যে তাকে ভেঙ্গে পড়া চলবে না। এতগুলো মানুষ যে তার মুখ চেয়েই বসে আছে। সে সবাইকে বল ভরসা না জোগালে হবে কেন।
পারু বলল, ওসব তো অনেক দূরের পথ বাবা, ওঝা ডেকে আনতে আনতে মেলা রাত হয়ে যাবে, ততক্ষণ কি পিটার বাঁচবে বাবা? সে ওরা যাচ্ছে যাক, আমি বলছি, এরমধ্যে গোঁসাই এসে একবারটি দেখুকই না!
এতবড় অধর্মের কাজ তুই করিস না মা। উনি গোঁসাই মানুষ, ধর্ম কর্ম সাধনা, ঠাকুর দেবতা নিয়ে থাকেন, ঠাকুরের নামগান করে পেট চালান। তাকে এই ওঝাগিরির কাজে কেন টেনে আনছিস মা! দয়ালের কথায় আকুতি ঝরে।
পারু একরকম গলা চড়িয়ে বলল, মানুষটার ক্ষমতার পরীক্ষা একবার হয়েই যাক না বাবা। তাছাড়া যে ছেলেটা মরতে চলেছে তার আবার জাতপাত, ধর্ম অধর্ম কী বাবা? প্রাণটুকু বেরিয়ে গেলেই তো সব মাটি। এখন পিটারকে বাঁচিয়ে তুলতে পারলে বরং মানুষটার অনেক বেশি পুণ্য হবে। লুকাসকে বলল, শিগগির তুই গোঁসাইয়ের কাছে যা। তাকে ডেকে আন। না আসতে চাইলে বলবি, পারুদিদি পাঠিয়েছে।
মনের মধ্যে এক কঠিন জেদ পোষণ করতে থাকে পারু। মানুষটার কত ক্ষমতা তা সে যাচাই করতে চায়।

ক্রমশ… 

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *