ড. মোহসীন আলি শহরের নামকরা জেনারেল ফিজিসিয়ান, খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানকারী এই চিকিৎসক প্রতিমুহূর্তে লক্ষ লক্ষ রোগীকে সুস্থ করে তোলার প্রতিযোগিতায় দৌড়ে চলেছেন। নূন্যতম পারিশ্রমিকে মানুষকে সুস্থতা প্রদান করাই তার জীবনের লক্ষ্য। শহরের পাশাপাশি প্রতি রবিবার তিনি নিজের গ্রামে একটি চেম্বার করেন যেটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সমগ্র গ্রামবাসীদের জন্য; যে গ্রামেই কেটেছে তার ছেলেবেলা পরিবারের সকলের সাথে। এখন আর গ্রামে পরিবার বলতে ছোটো কাকু – কাকীমা ছাড়া আর কেউ থাকে না; বাবা গত হয়েছেন প্রায় দশ বছর হল, মা শহরেই থাকেন ছেলের সাথে।
গ্রামের বিদ্যালয় থেকে সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সে আসে কলকাতার বুকে চিকিৎসক হবে বলে, যে স্বপ্ন আঁকড়ে তার এতদূর এগিয়ে আসা। কলেজ জীবন প্রথম দিকে ঠিকঠাকভাবে এগোলেও সমস্যা দেখা দেয় দ্বিতীয় বর্ষ থেকে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মেধাবী ছাত্রের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে শুরু করে কলেজের কিছু সিনিয়ররা। এমফিটামিন, মেথাএমফিটামিন, কোডিন ফসফেট, ফেনসিডিল ইত্যাদি নামগুলোর সাথে দিনদিন যোগাযোগ বাড়তে শুরু করে আলির। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নে প্রথম ধাক্কা লাগে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার ফলাফলে; কিন্তু ইতিমধ্যে সে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে মাদকাসক্তের চোরাগলিতে। ছেলের হঠাৎ এরকম অবস্থা দেখে চিন্তান্বিত বাবা দৌড়ে আসেন কলকাতায়, এতকিছুর মধ্যে একটু স্বস্তির খবর এটাই ছিল যে মোহসীনদের পারিবারিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল ছিল, আর্থিক অভাব অনটন সেভাবে বাসা বাঁধতে পারেনি তাদের পরিবারে। বাবা ছেলের এরকম শারীরিক মানসিক অবস্থা দেখে থতমত খেয়ে যান, যে ছেলেকে শহরে পাঠিয়েছিলেন এক নামী চিকিৎসক করবেন বলে, আজ তো সেই হয়ে উঠেছে রোগী। যাইহোক প্রাথমিক পরিস্থিতি সামলে শুরু হয় আলির চিকিৎসা। প্রায় বছর দুয়েকের এক অদম্য লড়াই শেষে ছেলেকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে আবার এই সুন্দর সবুজ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনেন এক পিতা। সন্তানকে সুস্থ করে তোলা, তার ভাঙা স্বপ্নকে আরেকবার জুড়ে দেওয়া এবং তাকে স্বাভাবিক জীবনশৈলী উপহার দেওয়া –এই সবই স্বাক্ষ্যবহন করে চলেছে এক পিতার জেদের কাহিনী যিনি বারংবার নিজেকে নিঙড়ে দিয়েছেন সন্তানের সাফল্যের তাগিদে। দুর্ভাগ্যের বিষয় তিনি সেভাবে কখনোই আলির এই ড. আলি হয়ে ওঠার সাফল্যের স্বাদ আস্বাদন করতে পারেননি, তার আগেই ডাক চলে আসে অন্য জগত হতে।
প্রতি রবিবার যখন আলি আসে তার গ্রামে চেম্বার করতে সেখানে তাকে সাহায্য করে সেই গ্রামেরই ছেলে অমিত। অমিত বরাবর পড়াশোনাতে ভালো থাকলেও সেভাবে এগোতে পারেনি আর্থিক অনটনের জন্য। অমিতরা তিন ভাই বোন, তাদের মধ্যে অমিত সবার বড়ো। মায়ের এবং অমিতের যৎসামান্য রোজগারে চালিয়ে নেয় ওরা, তারমধ্যেই চলে খাওয়াদাওয়া, ভাইবোনের পড়াশোনা সব। যখনই রবিবার সকাল হয় অমিত ডাক্তারবাবুর জন্য চেয়ার টেবিল সব রেডি করে রাখেন, যদি রোগী দেখতে দেখতে দেরী হয়ে যায় খাবারের ব্যবস্থাও করে দেয় সে।
আজ ফাদার্স ডে, রবিবার। তাই সকালে ড. আলি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়েন গ্রামে আসার উদ্দেশ্যে। তবে গ্রামে আসার আগে তার গাড়ি ঘুরে যায় আব্বার কবরের দিকে। আজকের এই বিশেষ দিনে তার শত ব্যস্ততার মধ্যে একবার হলেও সে এখানে আসবেই। বিগত দশ বছরে একবারও কখনো তার অন্যথা হয়নি, কারণ আব্বার জন্যই আলির ড. আলি হয়ে ওঠার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, সেদিন তার আব্বু ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেই সন্তানের আজকের সাফল্য। কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেল সে চেম্বারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু একি! গ্রামে এতো হৈ চৈ কিসের? আবার পুলিশও উপস্থিত। গাড়ি থেকে নেমে আলি এগিয়ে গেল ঘটনা সম্পর্কে জানতে।
গতরাত ছিল ঝড়বৃষ্টির রাত। সবকিছুই স্বাভাবিক চলছিল, অমিতের ভাই বোন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল ভাত খেয়ে। অমিত আর ওর মা অপেক্ষা করছিল ওর বাবার ফিরে আসার। প্রতিরাতে নেশা করে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরা ছিল অমিতের বাবার নিত্যদিনের অভ্যাস। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা, বাড়ির দরজায় অমিতের বাবার টোকা। দরজা খুলতেই হঠাৎ করে সে শুরু করে দেয় গালিগালাজ, তার মায়ের উপর জুলুমবাজি করতে থাকে আরও টাকার জন্য। হাতের সামনে পড়ে থাকা কাটারিটা নিয়ে তার মায়ের দিকে এগিয়ে গেলে সামনে চলে আসে অমিত, গলাটা এক ঝটকায় মাটিতে পড়ে যায়, বাড়ির মেঝে জুড়ে শুধু লাল রক্তের স্রোত। তার মায়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে আশেপাশের ঘরের লোকজনেরা, তাদেরই ডাকে আজ সকালে পুলিশ এসে গ্রেফতার করে অমিতের বাবাকে ছেলের খুনের দায়ে। আলি কিছুক্ষণ সেখানে থেকে অমিতের মা ভাইবোনকে দেখে তাদের পাশে থাকার কথা নিজেকে দিয়ে সেদিনের মত বাড়ি ফিরে আসে সে।
মুদ্রার একপিঠে আলির আব্বু আর অন্যপিঠে অমিতের বাবা – একজন সন্তানের জন্য হাজার ত্যাগ স্বীকার করে তৃপ্ত হন, আরেকজন সন্তানের রক্তে নিজের নেশার খোরাক মেটান। বাবা মানেই তো মাথার উপর ছাদ, তবে কখনো ঝড়বৃষ্টিতে সেই ছাদ ধ্বসে পড়তেও পারে। আমাদের জীবনে বাবারা হিরো, তাদের আলাদা করে তাবড় তাবড় বিশেষণ খুঁজে গ্লোরিফাই করতে হয় না, কিন্তু এই সমাজেই অমিতের বাবারাও বাস করেন। বাবা হয়ে উঠতে একটা মুহূর্ত লাগে, আর বাবা হয়ে বাঁচতে একটা জীবন কম পড়ে যায়।
বি.দ্র. সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। যদি কোথাও মিলে গিয়ে থাকে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ও কাকতলীয়।