• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব – ১৬)

যুদ্ধ যুদ্ধ

ষোল

আজ নফরগঞ্জের হাট। সাত আট মাইল দূরের পথ।পাঁচ গ্রামের হাটুরেরা সময় করে হাটে পৌঁছতে ভোর ভোর রওনা দেয়। পশ্চিমে সূর্য ঢলে পড়ার অনেক আগে ভাঙ্গা হাট পিছনে ফেলে রেখে ঘরে ফেরার পথ ধরে। তাদের পায়ে পায়ে ধুলো ওড়ে। মাথায় আর কাঁধে পসরা।মোষের গাড়িও দুয়েকটা দেখা যায়। ওসবের মালিকরা অবস্থাপন্ন। জমজমাট হাট বসে সেখানে। অনেক দূরের পথ। তবে যা রোজগার হয় তাতে সব কষ্ট পুষিয়ে যায় মানুষটার। লুকাস খুব সকালে এসে মানুষটাকে ডাক দিল। মানুষটার সঙ্গে লুকাসও হাটে যাবে। ইদানীং সে মানুষটার একনিষ্ঠ সাগরেদ হয়ে উঠেছে।বসতির মানুষগুলো এই নিয়ে খুব ঠাট্টামস্করা করে। লুকাসের পিছনে লেগে মজা লোটে। লুকাস ওসবে তোয়াক্কাহীন।হেসে উড়িয়ে দেয়। মানুষটার গান করা শেষ হলে সে শ্রোতাদের কাছ থেকে পয়সা তোলে। গুনেটুনে মানুষটার হাতে তুলে দেয়। মানুষটা খুশি হয়ে লুকাসকে কিছু পয়সা দেয়। সঙ্গে থাকায় মনে খানিক বলও পায় মানুষটা। আজ তার ঘুম ভাঙ্গতে সত্যিই দেরি হয়ে গেছে। এতবেলা পর্যন্ত ভয়ের স্বপ্ন, সুখের স্বপ্ন, আরও কত হিজিবিজি স্বপ্নই না দেখল সে। কিন্তু কই সে সবে পারু তো একটি বারের জন্যও ধরা দিল না! ভাবতেই মনটা কেমন বিস্বাদ হয়ে ওঠে মানুষটার।চলতে ফিরতে যাকে সে সবসময় দেখছে সেই পারু তাকে দূর ছাই করে চলে। তবে এই পর্যন্ত পারুকে সে যতটুকু বুঝেছে তাতে করে মেয়েটা যেকোনও ছেলের মনে ধরারই মতো। দয়ামায়ার শরীর, নিজের সিদ্ধান্তে দৃঢ়, কঠিন প্রত্যয়ী।সত্যাশ্রয়ী। এসব গুন সব মানুষের থাকে না। ফলে পারুকে সবাই একটু সমীহ করেই চলে। মানুষটাও ব্যতিক্রম নয়। সমীহ সেও করে। ভয়ও কম পায় না। তার মধ্যেও ওর প্রতি একটা মুগ্ধভাব, প্রেমপ্রণয়ের ইচ্ছা, চোরা যৌন টান অনুভব করে। মালতিবউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক দিন হল। এই দীর্ঘ সময়ে নারীসঙ্গ হয়নি তার আর।নতুন করে নারীসঙ্গ, জীবনের সুস্থিতির বড় সাধ মানুষটার। তড়িঘড়ি সে কাঁধে গামছা ফেলে নিমকাঠি দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে স্নানের জন্য পুকুরের দিকে হাঁটা লাগাল। পিছনে পিছনে লুকাস। হঠাৎ মানুষটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটুর জন্য জোর বাঁচা বেঁচে গেছে সে। বেখেয়ালে আরেকটু হলে শুয়োরের বিষ্ঠায় পা দিয়ে দিয়েছিল আর কী!
মুহূর্তে হাঁক দিল মানুষটা, দয়াল, দয়াল!
দয়াল বসতির বাইরে বসে দা দিয়ে একটা বাঁশের টুকরোকে দুফালা করার চেষ্টা করছিল। মানুষটার ডাক শুনে তার হাতের কাজ থেমে গেল। দ্রত হেঁটে সে মানুষটার কাছে এসে দাঁড়াল।
কিছু বলবেন গোঁসাই? জিজ্ঞেস করল।
হ, কইতাছি, তমাগ ঐ নরকে যাওনের বাহনগুলারে যত শিগগির পার বিদায় কর, তা নাইলে আমার আচার বিচার বেবাক পয়মাল করব ওগুলা। কঠিন গলা মানুষটার।
দয়াল অধোবদন হয়ে বলল, আর তো মাত্র কটা দিন গোঁসাই, ওগুলোকে বিদায় করব।
পাকা আমের আঁটিতে যেমন রাজ্যের মাছিরা জমায়েত হয়ে রস গ্রহণ করে তৃপ্ত হয় তেমনি মানুষটাকে ঘিরে একগাদা হাটুরের দল মানুষটার গাওয়া, যৌবনবতী কন্যা, গানটা শুনে বড় আনন্দ পাচ্ছে ।সদ্য বাঁধা গানটায় সুর দিয়ে এই প্রথম হাটে গাইল মানুষটা। গানটা গাওয়া শেষ হতেই জমায়েতটা সমস্বরে প্রায় দারুণ দারুণ বলে চিৎকার করে উঠল।
আঃ, কী ফাটাফাটি গান গাইলে গো গোঁসাই। একেবারে জমিয়ে দিয়েছ। তোমার জবাব নেই!
আজ শুধু শুকনো প্রশংসা নয়, ঠুনঠাং শব্দ করে পয়সাও পড়ল অনেক। কুড়োতে কুড়োতে লুকাস হাঁপিয়ে ওঠে। তবুও তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দবোধ খেলা করতে থাকে। মানুষটার রোজগার বাড়লে তারও যে প্রাপ্তিযোগ বাড়ে। ওই থেকে একটু একটু করে পয়সা জমিয়ে সয়েনিকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে তিন রাত্রি সহবাস করার ব্যবস্থা করবে। করবে তো বটেই কিন্তু গোঁসাইমানুষটা আজকাল কী যে হেঁয়ালি কথাবার্তা বলছে তার মাথামুন্ডু সে কিছুই বুঝতে পারছে না। নিয়মটিয়মগুলো না মানলে সয়েনি যদি আবার তার হাতছাড়া হয়ে যায়! বড় আশঙ্কার মধ্যে আছে লুকাস।
সাঁইত্রিশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা, আজকের হাঁটে মানুষটার রোজগার হল। একদিনে এত রোজগার কোনওদিন হয়নি তার। মনটা তাই বেশ উৎফুল্ল। লুকাস আব্দার করে বলল, আমাকে কিন্তু আজ দুটো টাকা বেশি দিতে হবে গোঁসাই!
পাবি। কিন্তু এখন আর দেরি করন যাইব না, আকাশ কালা কইরা যা মেঘ করছে, নামলে আর রেহাই নাই!
ভিড়টা পাতলা হয়ে গেলে মানুষটা পুরো পাঁচটা টাকা লুকাসকে দিল। দুজনে হাটের বাইরে বেরিয়ে আসছে। একসময় মানুষটা বলল, তুই গিয়া ভ্যানরিক্সায় উইঠা বয়, আমি ঐ দোকানটা থিকা একটা জিনিস কিন্যা এখনই আইতাছি।
শুনে লুকাস তো অবাক। বলল, আজ হঠাৎ ভ্যানরিক্সায় ফিরবেন কেন গোঁসাই?
মন চাইল, ধইরা নে সখ হইছে আমার। রোজগারপাতি ভাল হইলে মন ভাল থাকে। তখন নানা সখ মিটাইতে মন চায়। যা যা, যা কইতাছি শোন।
মানুষটা রাস্তাটা পার হয়ে দোকানটায় ঢুকে পড়ল। মনোহারী দোকান। একটা শক্তপোক্ত বড় তামার তাবিজ কিনল সে। ইতিমধ্যে লুকাসও কী মনে করে ভ্যানরিক্সার দিকে না গিয়ে সেও দোকানটায় এসে ঢুকল।
ফিরা আইলি যে? মানুষটা লুকাসের এই ব্যবহার ঠিক মেনে নিতে পারছে না। যেন লুকাস ওর পিছু নিয়েছে কিছু গোপন খবর জানতে।
লুকাস বলল, একটা পুঁতির মালা আর চার জোড়া কাঁচের চুড়ি কিনব। তা আপনি কী কিনলেন, তাবিজ?
যেন ধরা পড়ে গেছে মানুষটা, আমতা আমতা করে বলল, হ, কিইনা রাখলাম,কামে লাগব।
কেনাকাটা সেরে দোকান থেকে বেরিয়ে দুজনে রাস্তায় নামল। লুকাস আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করল, দয়ালদাদু বুঝি আপনাকে পারুদির সঙ্গে অগস্টিনের সম্পর্কের কথাটা বলেছে?
না, বলে নাই এখনও। কিন্তু আমারে তো আগে থিকা ব্যবস্থা নিয়া রাখন লাগব, নাকি? দরকার হয় তো আমি নিজে থিকা দয়ালের কাছে কথাটা তুলুম। আমার একটা দায়িত্ব নাই!
কিন্তু আমার মনে হয়, এই সম্পর্ক ভাঙ্গার কাজটা আপনি না করলেই ভাল হয়। ভালবাসার সম্পর্ক যারা ভাঙ্গে প্রভু তাদের ক্ষমা করেন না।
থো ফালাইয়া তগ প্রভু! ঐ ছেলেটা পারুরে বিয়া কইরা সংসার করব ভাবছস? সে আশায় ছাই। এ হইল গিয়া দেহের ক্ষুদা, বুঝলি? মিইট্টা গেলেই আর পারুর দিকে ফিইরাও তাকাইব না। আরেকটা কথা কই তোরে, সাবধান সাবধান, আমি যে পারুর জইন্য তাবিজকবজ কিনছি তা কাউরে কস বুঝি!
লুকাস চুপ।
সামনে মানুষটা হাঁটে। পিছনে পিছনে লুকাস। ভ্যানরিক্সা ধরার জন্য হেঁটে চলেছে দুজনে।কথা নেই। খিদে, জলতেষ্টা দুজনেরই পেয়েছে। একসময় মানুষটা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ঐগুলা কি তর ঐ মনের মাইনষের লেইগা কিনলি নাকি?
লুকাস সলজ্জ হয়ে বলল, হ্যাঁ গোঁসাই, ওকে কোনওদিন কিছু উপহার দিইনি। আজ হাতে দুটো বাড়তি পয়সা এল তাই কিনলাম। খুব খুশি হবে।
ভাল করছস। খুশি রাখ। মাইয়াটারে নিয়া পলাইয়া গিয়া বাইরে থাকনের বড় খরচার চিন্তা যখন মিট্টাই গেছে তখন এই হগল ছোটমোট খরচা না হয় করলিই একটু। এতে কইরা সম্পক্ক ভাল থাকে।
আমি সয়েনিকে পাব তো গোঁসাই, সত্যি করে বলুন না! এখনও সন্দেহ, অবিশ্বাস লুকাসের মনে।
এই গোঁসাই মানুষটারে অবিশ্বাস করতাছস তুই! পাপ আর বাড়াইস না! নিজের বুকে বারকয়েক হাতের টোকা দিয়ে একরকম ক্ষোভের সঙ্গে বলল মানুষটা।
আপনাকে অবিশ্বাস আমি করছি না গোঁসাই। পালিয়ে গিয়ে তিন রাত্রি সহবাসের ব্যাপারটা আপনি বাতিল করে দিলেন যে! ওতেই তো আমার মনটা অস্থির হয়ে আছে। আশঙ্কা হয়, শেষে যদি ওকে না পাই!
পাবি, পাবি, পাবিই তুই অরে, আমি আছি না! এক কথা কয়বার কইরা কইতে হইব তরে?
ল এখন, ক্ষুদায় পরাণ যায় আমার। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরন লাগে।
ভ্যানরিক্সার জটলার দিকে এগিয়ে চলে দুজনে। মোষের গাড়ির মালিক বড় চাষিরা তাদের পসরা বেচে একরকম খালি গাড়ি নিয়ে ঘরে ফিরছে। তাদেরই একজন দূর থেকে দেখতে পেয়ে মানুষটাকে হাঁক পেড়ে কাছে আসার জন্য ডাকছে। গোঁসাইমানুষ, হেঁটে বা পয়সা খরচ করে ভ্যানরিক্সায় যেন ঘরে না ফেরে। মানুষটাকে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে তার গ্রামে পৌঁছে দিয়ে সে একটু পুণ্য অর্জন করতে চায়। আপত্তি করল না মানুষটা। বলল, তোমার মঙ্গল হোক বাবা। তারপর
মানুষটা লুকাসের দিকে বেশ এক আত্মতৃপ্ত অহংকারভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, দেখলি তো আমার কদর!
মোষ দুটোকে যুতে দেওয়া হলে গাড়িতে উঠে বেশ গুছিয়ে বসল মানুষটা। পিছনে লুকাস পা ঝুলিয়ে বসেছে। বেলা মজে আসছে। বাতাসে রোদে পোড়া মাটির গন্ধ। কচরমচর শব্দ করে মোষ দুটো চলতে শুরু করলে মেঠোপথে চাকার দাগ দীর্ঘ হতে থাকে। একসময় পথ ছোট করতে গাড়িটা মেঠোপথ ছেড়ে নাবাল মাঠে নেমে পড়ল। দূরে যেখানে আকাশ মাটি ছুঁয়েছে সেদিকে চলতে লাগল।মাথার ওপর কাস্তের মতো বাঁকের পর বাঁক নিয়ে পাখিরাও ঘরে ফিরছে। তাদের ডানায় মেদুর আলো। এবড়োখেবড়ো মাঠ। গাড়ির গতি মন্থর। দুলকি চালে চলেছে। গাড়িতে বসা মানুষগুলোর শরীর উপরনীচ হতে হতে দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে।
সয়েনিকে পাওয়া এত সহজ হয়ে যেতে অবিশ্বাস ফের দানা বাঁধতে থাকে লুকাসের মনে। পুবাকাশে উজিয়ে ওঠা আঁধারের মতো রহস্য যেন বা জড়িয়ে ধরছে লুকাসকে। কী যে হেঁয়ালি করছে গোঁসাই মানুষটা তার সঙ্গে, বুঝে উঠতে পারে না লুকাস।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।