সৌরভের সঙ্গে আমার আলাপটাই হয়েছিল ঝগড়া দিয়ে। তখন টিভির কিছু টক-শোতে আমি নিয়মিত অংশ নিতাম। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস মতোই বলতাম কথা। আমি জানতাম না যে, সেইসব অনুষ্ঠান ও মনোযোগ দিয়ে দেখত। সত্যি বলতে কি, ও যে একজন রাজনৈতিক কর্মী তাই জানতাম না। একটি দু’টি কবিতার অনুষ্ঠানেই ওকে দেখেছিলাম। চিনেছিলাম অল্প, একজন তরুণ কবি হিসেবেই। ওই টিভির অনুষ্ঠানগুলো দেখার পরে একদিন একটি অনুষ্ঠানে আলাপ করেছিল ও নিজেই। এবং সেই আলাপ শুরুই হয়েছিল রাজনৈতিক তর্ক দিয়ে। তর্ক থেকে ঝগড়া। এর কিছুদিন পরে ও নিজেই আমার ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করে আমাকে। ঝগড়া রূপান্তরিত হয় সখ্যে।
মনে আছে একবার শান্তিনিকেতনের একটি কবিতা উৎসবে ও ঝোঁক ধরল যে, আমার সঙ্গে একই রুমে থাকবে। আমি ওকে বলেছিলাম যে, “আমি তো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি, খুব ভোরে উঠে কালই কিন্তু একটা অন্য অনুষ্ঠানে চলেও যেতে হবে আমাকে। তোর অসুবিধে হবে না তো?” দু’দিকে ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিল, “কিচ্ছু অসুবিধে হবে না”। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব ভাবলেও সেদিন খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে পারিনি। দেখছিলাম, একের পর এক ফোন আসছিল ওর কাছে। আমারও তখন ফোন আসত ঘনঘন। কিন্তু আমার চেয়েও বেশি ফোন আসছিল ওর কাছে। তার কয়েকটি পুরোই রাজনৈতিক। আর অনেকগুলোই নানা মানুষের সাহায্য চেয়ে করা ফোন। আমি নিজেও যখনই ইনি অসুস্থ বা ওঁর সাহায্য দরকার বলে ওকে জানিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, “দেখছি দাদা”। আবেগে চলত, বড়ো একটা মনও ছিল ওর। বলতে দ্বিধা নেই যে, অনেক সময়ে আমার বলা কোনও কোনও কথা শুনেছেও ও। হয়তো ওর কোনও কাজ আমার ভালো লাগেনি, ওকে স্পষ্ট বলেছি, কেন করলি এই রকম–ও প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, ওই ঠিক, তারপরে আমার যুক্তি বুঝে মেনেও নিয়েছে ভুল হয়ে থাকলে। তবে কিছু ব্যাপারে ও ছিল অনড়–এটাও দেখেছি। এ কারণেই হয়তো ওর বন্ধু যেমন ছিল অনেক, তেমনই ওকে অপছন্দ করার লোকেরও অভাব ছিল না।
কবি হিসেবে কেমন ছিল সৌরভ? দ্রুত উন্নতি করছিল। ওর কোনও লেখা পড়ে ভালো লাগলে ওকে জানিয়ে দেখেছি শিশুর মতো খুশি হয়েছে ও। পড়ত প্রচুর। অনেক কবির কবিতার লাইন স্মৃতি থেকে বলতে পারত। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় ওকে একজন বড়ো কবির ওপরে তাৎক্ষণিক চমৎকার বক্তৃতা করতে আমি দেখেছি জীবনানন্দ সভাঘরে। গত বছর লকডাউনের সময় বিভিন্ন কবিদের কবিতা নিয়ে রোজ সন্ধেবেলা যে-লাইভ অনুষ্ঠানগুলি সৌরভ করছিল ফেসবুকে, সেগুলি থেকেও স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল পাঠক হিসেবে কত উন্নত ছিল ও।
দীর্ঘদিন ওর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না আমার। ফেসবুকে ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে শুনে আমি নিজেই ওকে মেসেঞ্জারে মেসেজ করে জানতে চাই ও কেমন আছে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়। দিন তিনেক আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। তারপর আমিই ওকে বলেছিলাম যে, ফোন বন্ধ করে দে, ফোনে এত কথা বলিস না, সবাইকে উত্তর দিতে হবে না এখন। আরও অনেকেই নিশ্চয়ই একই কথা বলেছিলেন ওকে। ও ফোন বন্ধ করে দেয়। আমি একেবারে শেষে ওকে বলেছিলাম, ঘাবড়াস না, লড়তে হবে। ও একটা নীল আঙুল পাঠিয়েছিল আমাকে। এখনও মেসেঞ্জারে জ্বলজ্বল করছে সেই নীল আঙুলটি। শুধু সৌরভ লড়াইটা থামিয়ে দিয়েছে।
সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে বাংলা কবিতার অপূরণীয় ক্ষতি হল এই কথা বললে তা হবে সত্যের অপলাপ। কিন্তু যদি এটাও না বলি যে, ওর অনুপস্থিতি বাংলা কবিতার জগতটি পলে পলে অনুভব করবে তাহলে সেটিও অনৃতকথন হবে। বাংলা কবিতার নন্দন তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাঁরা ওকে না খুঁজলেও, নন্দন চত্বর ওকে ঠিকই খুঁজবে।