|| কালির আঁচড় পাতা ভরে কালী মেয়ে এলো ঘরে || T3 বিশেষ সংখ্যায় আকাশ কর্মকার ও নীতা পাত্র কর্মকার

কৃষ্ণবর্ণা

    গল্পটা কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের নয়; মূল শহর ছাড়িয়ে একটু দূরের মফঃস্বল এলাকা নারায়ণগড়। এক কালে নাকি সেই সেখানের জমিদারবাড়ির বড়ো দাদাঠাকুর হরিনারায়ণ চৌধুরী ছিলেন এখানের একমাত্র জমিদার, বেশ রাসভারী মানুষ ছিলেন তিনি। ওঁর আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয় বাড়ির অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা কালি; আজও সেই পুজোর জাঁকজমক দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। রাজা নেই, রাজবাড়ির আভিজাত্য আগের তুলনায় ম্লান কিন্তু কালীপুজো উপলক্ষ্যে সমগ্র অঞ্চল জুড়েই আজও সাজো সাজো রব ওঠে।

       বাড়ির ছোট ছেলে রাজনারায়ণ বিবাহযোগ্য হলে তার দাদুর দেওয়া কথামতো তার বাগদত্তা চিত্রার  সহিত মহাধুমধামে চার হাত এক হয়ে যায় শুভলগ্নে। গায়ের রঙ সংসারের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারক না হলেও শান্তি-অশান্তির মাপকাঠি নিশ্চিত হয়ে আসছে যুগ-যুগান্তর ধরে। চৌধুরী বাড়ির নতুন বৌ গৃহকর্মে নিপুণা, ঘরোয়া কিন্তু কতখানি সুশ্রী তা নিয়েই দ্বন্দ্ব কলহে জেরবার নবদম্পতির দাম্পত্য জীবন। দাদুর দেওয়া কথামতো চিত্রার সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়ার পর থেকেই বিবর্ণ হতে লাগল ক্রমাগত তাদের সংসার-তাদের জীবন। রাজনারায়ণ কোনোভাবেই তার স্ত্রীকে মন থেকে মেনে নিতেও পারে নি, এমনকি তাকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেও অস্বীকার করে। সময় যতো এগোতে লাগল ততই নিঃশব্দে আলগা হতে লাগল সম্পর্কের বাঁধন। 

       এই ভাঙা সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝেই রাজনারায়ণের জীবনে বসন্তের আগমন ঘটে তার বৌদির পিসতুতো বোন লাবণ্যের পদার্পণে। চৌধুরী পরিবার ঠিক যেমনটি ছোট বৌমা খুঁজছিল ঠিক তেমনই রূপের আলোয় উজ্জ্বল নারী লাবণ্য। লাবণ্যের আসার পর থেকেই চিত্রার জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল প্রতি মুহূর্তে। ইতিমধ্যে বাড়ির কালীপূজার সময় আসন্ন; তাই এবারে পুজোর আগেই ঠিক হয়ে গেছে যে, বাড়ির বৌ চিত্রাকে যে কোনো ভাবে তার বাপেরবাড়িতে রেখে দিয়ে আসা হবে। চিত্রার বাপের বাড়িতেও আছে বলতে বৃদ্ধা মা এবং তার দুই দাদা-বৌদি এবং তাদের সন্তানরা। তার অবস্থা জলে কুমীর-ডাঙায় বাঘ এই ধরনের, যেদিকে যাবে সেদিকেই শুধু লাঞ্ছনা-অপমান। 

       চিত্রাকে বাপের বাড়িতে রেখে দিয়ে আসার জন্য রাজনারায়ণ তৈরী; গতরাতে একপ্রকার সে বলেই দিয়েছে এই বাড়িতে আর তার ঠাঁই হবে না। এবার বাঁচতে হলে সে বাপের বাড়িতেই থাকবে, আর মরে গেলেও তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। চিত্রা ভালোভাবেই জানে এসবই পূর্ব পরিকল্পিত; এবং সে লাবণ্যর চৌধুরী বাড়ির পুত্রবধূ হিসেবে আসার আভাসও পেয়েছে। কিন্তু তার যে বাপেরবাড়িতেও সুখ নেই; কিন্তু কি আর করা যায়, যেতে তো হবেই। দেখা যাক্ সেখানে কিরকম আপ্যায়ণ করা হয় তাকে। এসব ভাবনার মধ্যে দিয়েই পেরিয়ে চলল সময়, চিত্রাও পৌঁছে গেল তার পিতার আলয়ে এবং রাজনারায়ণ চৌধুরী এগিয়ে চলল তার নতুন জীবনের পথে। 

            আবারও চৌধুরী বাড়ির কালীপূজা উপলক্ষ্যে সমগ্র এলাকা মুড়ে ফেলা হয়েছে কৃত্রিম আলোয়, এদিকে চৌধুরী বাড়ি্য আলো হয়ে এসেছে লাবণ্য। পুজো পেরোলেই এক শুভলগ্নে রাজনারায়ণ বসতে চলেছে দ্বিতীয় বারের জন্য বিয়ের পিঁড়িতে; এবারে কনে সুশ্রী, ঘরোয়া-গৃহকর্মে নিপুণা বিশেষণের লক্ষণ মেলা ভার। অন্যদিকে চিত্রার জীবন নরকের চেয়েও অধম হয়ে উঠছিল দিনদিন; এই জীবনের থেকে সেও খুঁজছিল মুক্তির পথ। 

          কালীপূজার রাত পেরোনোর আগেই চৌধুরী বাড়ির সদস্যরা ছুটল স্থানীয় হাসপাতালে, সৌজন্যে লাবণ্যের চোখে আতসবাজীর ফুলকির আঘাত। দীপাবলীর আলোয় সুসজ্জিত রাতে অমাবস্যার চেয়েও গভীর নিশি নেমে এলো চৌধুরী বাড়িতে। চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসার পরেই জানিয়ে দিলেন লাবণ্য হারিয়েছে দৃষ্টিশক্তি। খবর গিয়ে পৌঁছাল চিত্রার কাছেও; কিন্তু সে কিই বা করতে পারে। নিজের সতীনের আঘাতে উৎসবে মাতবে নাকি তার সামাজিক বরের পাশে এসে দাঁড়াবে এই দুঃসময়ে? সময় এগোতে লাগল, শুরু হল লাবণ্যের জন্য চোখের খোঁজ। কোথাও আর মিলছে না চোখ; এদিকে ক্রমাগত আশা হারাচ্ছে সকলেই। যে লাবণ্যকে ঘিরে নতুন করে সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখছিল রাজনারায়ণ, আজ সেও আঁধারের চাদরে মুড়ে ফেলছে নিজেকে একটু একটু করে। আর লাবণ্য! তার কথা নতুন করে কিই বা বলি, শুরুর আগেই নেমে এসেছে যবনিকা। এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে খবর এলো, চোখ পাওয়া গেছে, আগামীকাল কলকাতা নিয়ে যাওয়া হবে লাবণ্যকে চক্ষু প্রতিস্থাপনের জন্য। লাবণ্য ধীরেধীরে সুস্থ হয়ে ফিরে এলো বাড়িতে, সবাই জানল এসবই মা কালীর আশীর্বাদ। মা ছাড়া আর কেই বা তার সন্তানকে রক্ষা করতে পারবে? 

             দিন পনেরো পর চিত্রার বাড়ি থেকে একটা চিঠি এলো, ঘটনাচক্রে চিঠিটা এসে পড়ল সেই লাবণ্যের হাতেই প্রথম। সমগ্র চিঠিটা পড়ে স্তম্ভের মতন দাঁড়িয়ে রইল সে, সম্বিত ফিরল রাজনারায়ণের ডাকে। চিত্রার কাছে এরচেয়ে ভালো সুযোগ ছিল না তার কালো হয়ে জন্মানো অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য। হাতের শিরা কাটর আগে সে সজ্ঞানে চিঠিতে লিখে যায়, মৃত্যুর পর তার চক্ষুদানের কথা এবং তা যেনো শুধুমাত্র লাবণ্যকেই দেওয়া হয়। অতঃপর তার দাদা যোগাযোগ করে সেই হাসপাতালের চিকিৎসকের সঙ্গে এবং তারপর সমস্ত নিয়ম মেনেই আজ চিত্রার চোখ দিয়েই লাবণ্যের জীবনের আঁধার ঘুচল; আঁধার ঘুচল চৌধুরী বাড়ির ছোট ছেলের জীবনেও। 

       সমাজের ধুলো জমা দেওয়ালগুলোর আনাচেকানাচে মাকড়সার জালের মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে এরকম অজস্র কুসংস্কার, যার শিকার চিত্রার মতন অগণিত নারী। খালি চোখে হয়তো সর্বদা প্রকট হয়না সবকিছু তবুও যুগ যুগান্তর ধরে গল্পের ন্যায় বিরাজমান। 
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।