নতুন বছরের গদ্যে মো. আরিফুল হাসান

বিষ-বিশের বিদায় ও একুশের অভিষেক

নতুন বছরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখতে বসে এবারে আমাদের শুধু মনে পড়বে বিগত বছরের দহন-চিতা। মহামারী করোনার থাবায় ২০২০ সাল আমাদের কাছে এক ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মতো ছিলো। স্বজন হারানোর শোক, জাতীয় নক্ষত্রসমুহের পতন, সামগ্রিকভাবে এ বছরটি বিশ্বের মেরুদণ্ডে বেশ ভালোভাবেই আঘাত করেছে। পৃথিবীর বহুদেশে মৃত্যুহার এতোই অধিক ছিলো যে ভাবলেই চোখে জল চলে আসে। এই বিষ-বিশের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেতে আমরা এখন আশা রাখছি আগত ২০২১ সালের দিকে। কিন্তু কী হবে নতুন বছরে তা কেউ এখনও সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারেনি। করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে। আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে এই অদৃশ্য মানবঘাতী ভাইরাসটি। তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, আশায় বেঁচে থাকে যে আগামী বছরটি হয়তো হবে পৃথিবীর জন্য শান্তির হবে। আমরাও এ কামনাই করি, নতুন বছর যেনো ধুয়ে দেয় সমস্ত মারি-মরা, সমস্ত আহাজারি।
সাহিত্যাঙ্গনের নিবিড় অভিভাবক অনেককে আমরা হারিযেছি এ বছর। চলচ্চিত্র অঙ্গনেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এক কথায় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আকাশজুড়ে এক ভয়াবহ কৃষ্ণবিবর ভর করেছিলো ২০২০ সালে। এ সালটিকে হয়তো খুব সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ এর ক্ষতের গভীরতা এতোই অধিক যে, খুব সহজে তার থেকে উত্তরণের উপায় নেই। বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ইন্তিকাল করেন ২০ সালের ২৩ মার্চ। উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি বাংলা সাহিত্যকে উজ্জ্বল করে রাখছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হওয়া সত্বেও তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিল্পসমালোচনা ও সাহিত্য সম্পাদনার ক্ষেত্রে ছিলেন অনন্য। বাংলা ছোটগল্পে নতুনতরো ভাষা নির্মাণের জন্য তিনি ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। শিক্ষা ও গবেষণায় অবদানের জন্য ২০০৯ সালে পান একুশে পদক। তাঁর মৃত্যু বাংলাভাষায় যে শূণ্যতা স্থাপন করে তা কি এতো সহজেই পূরণীয়?
করোকালে ২০২০ সালে আমরা আরও হারিয়েছি সুফিয়া আহমেদকে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ১৪৪ ধারা ভেঙে ৮ ফাল্গুণ যে ফল্গুধারার মতো লাভার মিছিল বের হয়, তার অগ্রসেনানী ছিলেন এই নারী। ভাষাসৈনিক হিসেবে ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও বিগত বছরে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম নারী ক্যামেরাপারসন রোজিনা আক্তারকে। ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে জ্যেষ্ঠ ক্যামেরাপার্সন পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
কোভিড ১৯ মহামারীতে এভাবেই যখন একের পর এক বাতিঘরগুলো নিভে যাচ্ছে আর জাতি ভুগছে, ধুঁকছে, অতল অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে দিকচিহ্নহীন। তখন আমাদের জ্ঞানের সবচেয়ে দেদীপ্য প্রদীপ হঠাৎ করেই ধপ করে নিভে গেলো। ১৪ই মে চিরবিদায় নিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের স্পর্ধা আনিসুজ্জামান। তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ১৯৫২ সালে বাঙালির মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে “রাষ্ট্রভাষা কী ও কেনো” মিরোনামে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা রচনা করেন। পূর্ববাংলার সেই সংগ্রামশীল জাতির পথচলায় দৃপ্তসাহস সঞ্চার করতে করতে চূড়ান্ত পরিস্ফুটনের দলিলও লিপিবদ্ধ হয়েছে তার হাতে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলার সংবিধানের বাংলা খসরা তাঁর হাতেই রচিত হয়েছিলো। অনেকের চোখেই তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির অভিভাবক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদকে অলংকৃত ছিলেন আনিসুজ্জামান। ভারত সরকার কর্তৃক পান পদ্মভূষণ খেতাব।
‘জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো’র মতো কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা আজাদ রহমান মারা যান ১৬ মে ৭৬ বছর বয়সে। বাংলা খেয়ালকে জনপ্রিয় করে তুলতে তার অবদান ছিলো অনস্বীকার্য। নৃত্যশিল্পী ও নৃত্য পরিচালক হাসান ইমামও মারা যান এই বিগত বিশ-বিষে। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারে যার কণ্ঠে বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের খবর প্রথম ভেসেছিলো কামাল লোহানীর কণ্ঠে। সেই বজ্রকণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায় বিগত বছরের জুন মাসের ২০ তারিখে। এছাড়াও আমরা গেলো বছরে হারিয়েছি চলচ্চিত্রের গানের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরকে। জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি, ডাক দিযাছেন দয়াল আমারে, সবাই তো ভালোবাসা চায়, ভালোবেসে গেলাম শুধু, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে, পড়ে না চোখের পলক— তার এমন অনেক গান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
বাংলাদেশের চিত্রকলার অনন্য নক্ষত্র মুর্তজা বশীর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত পনেরো আগস্ট চিরজীবনের পথে পাড়ি জমান। তিনি বাংলার মহাজ্ঞানতাপস মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ছোট সন্তান। দেয়াল, শহীদ শিরোনাম, কালেমা তাইয়্যেবা, পাখা— শিল্পী মুর্তজা বশীরের আঁকা উল্লেখযোগ্য সিরিজ। তিনি বিমূর্ত বাস্তবতা শিল্পধারার প্রবর্তক। ফিগারেটিভ কাজেও পূর্ব-পশ্চিমের মেলবন্ধনে তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। চিত্রকলায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০০৯ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮০ সালে একুশে পদক এবং ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক পেয়েছেন মুর্তজা বশীর।
করোনাক্রান্ত ২০২০ সালে আমরা আরও হারিয়েছি প্রবীন সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক রাহাত খান, গীতিকার সুরকার সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী, কথাশিল্পী ও নজরুল ইনিস্টিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক রশীদ হায়দার, একুশে পদক প্রাপ্ত চিত্রশিল্পী মনসুর উল করীম, অভিনেতা কে এস ফিরোজ ও অভিনেতা সাদেক বাচ্চুকে। এই দুর্বিসহ বছরটি বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতিতে যে কালো থাবা বিস্তার করেছে তা কাটিয়ে উঠতে যুগের পর যুগ সময় চলে যাবে। তবুও একজন আবুল হাসনাত জন্ম নেবে না। হ্যা, বলছি কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত ওরফে কবি মাহমুদ আল জামানের কথা। বাংলা ভাষার সবচেয়ে সমৃদ্ধ কাগজ কালি ও কলম সম্পাদনায় তিনি রেখেছিলেন মৌলিক সাহিত্যের জোরালো অবদান। এছাড়া একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক আলী যাকেরও ইন্তেকাল করেন বিশ-বিষের ছোবলে। সর্বশেষ কবি মনজুরে মাওলার মৃত্যুতে বাংলার সাহিত্য অঙ্গনে নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। নাট্যকার, নির্দেশক, ও চলচ্চিত্র পরিচালক মান্নান হীরা এবং “কোথাও কেউ নেই’র বদি চরিত্র খ্যাত আব্দুল কাদেরও মারা যান বিগত ২০২০ সালে।
এতো অজস্র মৃত্যুর মাঝেও আমরা যারা বেঁচে আছি আমাদের কাজ হলো আগামীর পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে রেখে যাওয়া। নতুন বছরের অঙ্গীকার আমাদের দৃঢ় হোক, আমাদের জন্য যেনো পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য না হয়ে পড়ে। তাই প্রতিবছর নতুন বছর আসলেই আমরা শুভকামনা জানাই নিকটজন, বন্ধুজন ও স্বজনদের। সকলের মঙ্গল কামনা করে নতুন সূর্যকে স্বাগত জানাই। কিন্তু ভুলে যাইবিগত রাত্রীর জমাটবদ্ধ অন্ধকার। মানুষ এমনই, নাহলে একজীবনের দুঃখ দাহন, মোকের পরিহাস সব সে নিওরণসেলে ধারণ করবে কেনো? আর দারণ করে বেঁচে থাকবেই বা কিকরে? তাই মানুষকে বিস্মৃত হতে হয়, তার অতীততকে বিস্মরণে রেখে তাকে এগিয়ে যেতে হয় আগামীর স্বপ্নরঙিন ডানায়।
মানুষের সুখ-দুখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনার রাতলিপি-দিনলিপি লেখা থাকে সময়ের বাতাসে বাতাসে। জোনাক পোকারা কানে কানে বলে ব্যর্থ মানুষের জীবন সংবিধান। তবুও মানুষ নতুনত্বের প্রতি চিরমোহিত। াগমনী াগামীকে সে নিজের সমৃদ্ধির জন্য ভাবতে পারে। যদিও কথায় আছে যায় দিন বালো যায় আসে দিন খারাপ। তবুও আমরা স্বপ্ন দেখতে আগ্রহীই শুধু নয়, রীতিমত স্বপ্নের মধ্যেই বসবাস করি। আমি বলছি, এই স্বপ্নাচ্ছন্ন জীবন থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। সফল করতে হবে উন্নত জীবনের অভিযাত্রা।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি, গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা, পাশ্চাত্য বর্ষপঞ্জি, ইংরেজি বর্ষপঞ্জি বা খ্রিস্টাব্দ হলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় সর্বত্র স্বীকৃত বর্ষপঞ্জি। ১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পোপ ত্রয়োদশ গ্রোগোরির এক আদেশানুসারে এই বর্ষপঞ্জির প্রচলন ঘটে। সেই বছর কিছু মুষ্টিমেয় রোমান ক্যাথলিক দেশ গ্রেগোরিয় বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে অন্যান্য দেশসমূহেও এটি গৃহীত হয়।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক অব্দ হিসাবে খ্রিস্টাব্দ সারা বিশ্বে স্বীকৃত। এই অব্দের সাথে বিশেষভাবে জড়িয়ে আছেন খ্রিস্টধর্মের নবী ঈসা মসীহ আ.। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Jesus Christ. বাংলা খ্রিস্ট শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে এই Christ শব্দ থেকেই। এর সাথে সংস্কৃত থেকে গৃহীত অব্দ শব্দের স্বরসন্ধিতে তৈরি হয়েছে খ্রিস্টাব্দ । আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই অব্দের শুরু থেকে পরবর্তী অব্দগুলোকে বলা হয় Anno Domini বা AD এবং পূর্ববর্তী অব্দগুলোকে বলা হয় Before Christ বা BC, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। খ্রিস্টাব্দ একুশ সালের শুভেচ্ছা সকলকে। আমা করি বিষবিশের শোক কাটিয়ে ২০২১ সালটি আমাদের জন্য নিয়ে আসবে জীবনের বার্তা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।