একটা দুয়োরানি দুপুর, খড়ের বাতায় কাঠের চিরুনীটা গুঁজে রেখে পা টিপে টিপে নেমে গেলো খিড়কির বড় পুকুরটার সান বাঁধানো ঘাটের শেষ ধাপে। সিঁড়িতে বসে পাছাপেড়ে কাপড়টা তুলে নিলে গোড়ালির ওপরে। আলতা পড়া পা দু’খানি কাঁচ জলে আলগোছে ডুবে রইলে ব্রহ্ম কমলের মৃণালের মতো। পা ডুবিয়ে দিতেই জলে শিহরন জাগলো, দুপুরের কাঁচা ঘুম ভেঙে যেতে। কোন আবাগীর বেটি এলি লো, এই ভরদুপুরে জ্বালাতে, শোনা গেলো জল কুমারীর গলা। গাঁয়ের বউ ঝিররা সদ্য ফিরেছে ঘাটের কথা সাঙ্গ করে। এবার ওর বিশ্রামের পালা। এরই মধ্যে এসে হাজির পোড়াচোখে ঘুম না থাকা সেই দুয়োরানি। জলে পা ডুবিয়ে দিতেই তিঁরতিঁর করে কেপে উঠল সোহাগী শরীর। রোগাসোগা ঢেউগুলো হেসে লুটিয়ে পড়ল এ ওর গায়ে। চারপাশে কেউ কোথাও নেই। পাড়ের সমত্থ গাছগুলো ছায়া এলিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে। বিকেলবেলা মেলা কাজ। তখন ঘরে ফিরবে পাখির দল, ডানায় বেঁধে নিয়ে খুদকুঁড়ো। তখন ভারী ব্যস্ততা। কেউ কেউ আবার পথ হারায়, কথা দিয়েও কথা রাখে না। তখন সারারাত দোর আগলে, ছায়ার পিঠে হেলান দিয়ে বসে থাকা। রাত ফুরিয়ে ভোর আসে, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে ভাসান জল, শিশির হয়ে। তারপর একদিন অপেক্ষাও অভ্যাস হয়ে যায়। আলাদা করে কিছু মনে হয় না। এইবেলা তাই জিরেন কাল। বড়গুলোর নিচে ছোট ছোট দস্যি দামাল কিছু জুটেছে। ওরা দিনভোর নিজেদেরই ছায়ার তলায় পাতা লুকোনো খেলে এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন।
এমন সময় এসে বসেছে মেয়ে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে শ্রাবণের প্রথম প্রহরের একখানি জলভার তার পিঠ জুড়ে ডানা মেলেছে। চাতকের অদৃষ্টে জল মাপা থাকলে এক্ষুনি বুঝি এক পশলায় ভিজিয়ে দিত মাটির দেহ মন, দুইই। ভেজাতে তো ভালোই পারে কিন্তু নিজে ভেজে কই! মেঘ পেরিয়ে স্থির শূন্যের মতো রয়ে যায় তার অসনবসন। দূরে চোখের বাইরে নদী রেখা কাঁপে বীনার ছেড়া তারের ন্যায়। সুর ছেড়ে গেছে গানের ভুবন। এখন সাধলেও মন ওঠে না, শরীর যদি বা ওঠে, শরীরের নিয়মে। এই একলা খরতাপের বেলাগুলো তার একান্ত নিজস্ব। এই সময় অপরিমিত দৃষ্টি তাকে বেঁধে না বা একা কথার যৌথ আসরে বেমক্কা যতি চিহ্নের হাত ধরে এসে রস ভঙ্গ করে না, কোন বেহিসেবী রসিক। পা মেলে দিয়ে বসেছে মেয়ে। তেতে পুড়ে সকালের সোনার অঙ্গে কলি পড়েছে। কিন্তু যদি সেই কালির আড়াল সরিয়ে একটু ভালো করে দেখা যায় গত রাতের সোহাগ দাগের সাথে দু’চার খান কালশিটেও পড়তে পারে চোখে। এমনি করেই নরমে গরমে চলছে সংসার সংসার খেলা। এইবেলা পেট কাপড়ে বাঁধা আছে কষি আম খান কতক আর পাকা তেঁতুলের সোটাও আছে বেশ খানিক। কাগজের পুড়িয়ায় আছে নুন লঙ্কা, আছে একটা সদ্য কেটে আনা আঙ্গট কলাপাতা। একটা ঝামা ইটে আম কটাকে ছেঁচে, নুন লঙ্কা মাখিয়ে আঙ্গট পাতায় ঢেলে নীচটা দাঁত দিয়ে কেটে সুরুৎ করে একটা টান দিতেই পাশে এসে বসল কিশোরী বেলা, শুধোলো বেশ আছিস বল, এই আম তেঁতুলের কথায়, লতায় পাতায়।
আছি কি সত্যিই? ওই দূরে শনশন করে হাওয়া উঠল দিগন্তের দুয়ারে মেঘবাড়ির শামিয়ানা খানা এলোমেলো করে দিয়ে। এ পাড়ে, জলের বিছানায় পুরুষ্ট ঢেউ উঠল। টানটান করে পেতে রাখা ছায়ার চাদরখানি দুমড়ে মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে গেল। শুধু তাই না, জলের ই আয়নায় মুখ দেখছিল মেয়ে, বাড়িতে সেসবের জো নেই, নেই প্রাণের কথা কইবার সময় বা শোনবার মানুষটা! সে যে তখন অন্য কারোর গল্পে নায়ক! তাই এই নিষেধ দুপুরগুলোয় সে এসে বসে এই বাঁধা ঘাটের অতিচেনা চাতালের শেষ ধাপে। এটি তার বড্ড প্রিয়। এখানেই একদিন, তখন সদ্য মন ডাকছে শরীরকে বা শরীর চিনছে মনকে, কোন সে বিধুর বেলায় সদ্য স্নাত ডুরে শাড়ির আঁচল থেকে টুপটুপ ঝরে পড়ছিল আলোর আলপনা, দেখা হয়েছিল “কোন সে কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙ্গা বায়”। তারপর ভেসে যাওয়া আর কে আটকায়! আটকায়নি কিছুই যেমন আগলে রাখা যায়নি আঙ্গুলের ফাঁক গলে বয়ে যাওয়া সময়কে। তাই সে রোজ আসে শুধু এটুকু বুঝে নিতে, “গেছে যে দিন, সে কি একেবারেই গেছে!”