গদ্যের পোডিয়ামে অনুপ ঘোষাল

আমার শহরে বৃষ্টি এলে
বৃষ্টি এলেই আমার শহরে চিঠি উড়ে আসে। উড়ে আসে ছবি, ছবিতে ভর দিয়ে খিলখিল করতে করতে উঠে দাঁড়ান,অনিঃশেষ নীলমণি ফুকন।
বৃষ্টিতে ভিজে গেলে আমার শহরে বেজে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। শ্রাবণের ধারার মতো চুপিসারে কৈশোর পেরিয়ে যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর থেমে থাকা পরী। পিছনে পড়ে থাকা স্কুল ব্যাগ আর মিলেনিয়াম পার্কের মাঝে তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নতুন আসা অঙ্ক ম্যাম আর গুলিয়ে যাওয়া প্রোবাবিলিটির সূত্র। মোহরকুঞ্জের প্রতিটা ঘাসে লাল নীল ভালোবাসা ফুটে উঠছে বেঁচে থাকার আলোয়।
আমার শহরের প্রতিটা গলির একহাঁটু জলে শুধু কাগজের নৌকো ভাসাবে বলে পাবলো নেরুদা পড়তে বসে কেউ। শুধু লোডশেডিংটা হল না বলে এবারেও চার তলার সৃষ্টিকে বলা হল না অনেক অনেক কথা। কদম ফুল গাছটার মরা ডালটা কিছুতেই এবারও ঝাপ দিয়ে পড়ল না ইলেকট্রিকের তারে!
প্রতিটা মেট্রো স্টেশনে ঝমঝম করে বেজে উঠছেন ভি.বালসারা। উন্মুক্ত দুই বাহুর ভিতরে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ছে সোনালী গমের মতো রাত। অসংখ্য নাছোড়বান্দা চুমুর ভিতরে ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক নরম পুতুল। এক পা এক পা করে বৃষ্টিবোঝাই শহরের গা ঘেঁষে এইমাত্র চলে যাওয়া শেষ ট্রামের ভিতর বসে থাকে একটা হারানো তক্তাপোষ, মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট।
রাত্তিরের কাঁধে হাত রেখে সটান দাঁড়িয়ে থাকে সেন্ট্রাল এভিনিউ। বারবার নিবে যাওয়া সিগন্যাল পোস্টগুলোকে এইমাত্র একলা ফেলে চলে গেল মাঝবয়সী ট্রাফিক পুলিশ। ওঁর ধবধবে সাদা জামায় গাঢ় লাল রংয়ের রসাতলের দাগ। সে দাগে যে গান লেগে আছে তাকে তুমি হাহাকার বলতেই পারো, আমি বলি বেলাভূমি,পবিত্র মেঘের চলন।
ধুয়ে যাওয়া যোগাযোগ ভবন আর নীল সাদা নবান্নের মাঝে রেনকোট পড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সতেরো’শ উনচল্লিশ দিন আর ভেবলে যাওয়া ভালো ছেলের দল। বুকে হাত রাখি,মাঝেমধ্যে মুখে আসে কথা তারপর… বারবার ঢুকে পড়ি কবরখানায়, নিশ্চিন্ত তালশাঁসে। বৃষ্টি আর বাংলাদেশ, প্যালেস্টাইন আর পেঁয়াজের দামের মধ্যে প্রায়োরিটি সেট করার অসম্ভব চেষ্টার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলেন সুকুমার রায়।
বৃষ্টিতে আমার শহর শিয়ালদহ সাবওয়ে , গলা ছেড়ে মহীনের ঘোড়া আর থমকে থাকা রাখালদা’র ক্যান্টিন। শুনশান ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে খুলে রাখা বসু-দত্তের ভিতরে ছটফট করছেন আঁদ্রে মালরো থেকে হেলাল হাফিজ। ঋক্ষ মেষ থেকে অগ্নিবর্ণা তুমি।
বৃষ্টিতে আমার শহরে ছাতা নিতে ভুলে যায় লোক। হাত ধরে হেঁটে যায় ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির দিকে।তাড়াতাড়ি জল নেমে যাওয়ার অস্বস্তি ভুলে যেতে খিচুরি আর বেগুন ভাজার উপর আস্থা রাখে সবাই। বেল, টগরের গন্ধ মেখে আকাশে বাতাসে উড়তে থাকে হাজার হাজার কবিতা। যা আজকের পর আর পড়া হবে না কখনও।
কান পাতলেই শোনা যায় শুভ্রা কাকিমা গাইছেন নিখুঁত মিয়াঁ-কি-মল্লার। মনে পড়ে যায় শুধুমাত্র তোর্সা-র ভাঙাচোরা মালহার শুনব বলে ইতিহাস বই খুলে বসার কথা।
এই কবিতা, এই চিঠি, গান, সিগন্যাল পোস্ট …সব নিজের মধ্যে সেলাই করতে চাই, রেখে দিতে চাই মিলেমিশে থেকে যাওয়া একটা ছবি, একটাই ছবি- সে আমার শহর। আমার চেঁচিয়ে ওঠা, বারবার হেরে যাওয়া,হারতে হারতে লড়াই করা, নির্লজ্জ এডজাস্টমেন্ট, লন্ডভন্ড ভবিষ্যত আর থ্যাৎলানো আমিটাকে নিয়ে বুক চিতিয়ে ভিজতে থাকা আমার শহর, না-বলা কথাদের একান্ত ব্রিগেড।