সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৩৯)
সালিশির রায়
কিস্তি – ৩৯
শুধু তার ইজ্জত লূঠের বোবা কান্নায় যেন ভারী হয়ে ওঠে ভোরের বাতাস। চোখের পাতায় এসে পড়ে সূর্যের আলো। চোখ করকর করে ওঠে। কিছুতেই চোখের পাতা মেলতে পারছিল না সে। কিন্তু কপালে শীতল স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে দেখে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে মা। শরীরে একটা সুতো পর্যন্ত নেই তার। খড়ের কুটোয় ঢাকা রয়েছে শরীর। বুঝতে পারে মেয়ের লজ্জা ঢাকতে মা’ই ওই ব্যবস্থা করেছে। সারা গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। স্তন – যোনী সহ শরীরের সর্বত্র আচড়ানো – কামড়ানোর দাগ। সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে নিমাঙ্গ। ওঠার শক্তি পর্যন্ত নেই। ওঠার চেষ্টা করতেই ঘুরে পড়ে যায় সে। বেশ কিছুক্ষণ ওইভাবে পড়ে থাকার পর একসময় মায়ের কাঁধে ভর দিয়ে কোন রকমে উঠে দাঁড়ায়।মা তার কাপড়ের একটা অংশ দিয়ে কোন রকমে ঢেকে দেয় মেয়ের লজ্জাস্থান। তারপর মায়ের কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোন রকমে বাড়ি পৌঁছোয় সে। বিকাল পর্যন্ত বেহুঁশ হয়েই পড়ে থাকে।
হুশ ফিরতেই দেখে খাবার নিয়ে মাথার কাছে বসে আছে মা। খেতে ইচ্ছেই করছিল না। কেমন বমি বমি ভাব হচ্ছিল তার। তবু মা জোর করে তাকে চাট্টি ঝোলভাত খাইয়ে দেয়। খাওয়ার পর গায়ে একটু বল পেতেই স্নান করেতে যায়। নিজেকে কেমন অপবিত্র মনে হয় তার। তাই দীর্ঘক্ষণ ধরে স্নান করেই যায়। এক সময় মায়ের তাড়ায় পুকুর থেকে উঠে আসে। আসার সময় দেখতে পায় দূর থেকে সবাই তাকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছে। সে কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। একটু থিতু হওয়ার পর মা বলে , চল ঘর বাড়ি ফেলে দিয়ে তোর মামার গাঁয়ে পালিয়ে যায়। এরা আমাদের এখানে আর থাকতে দেবে না।
—- না মা , অত সহজে আর গ্রাম ছেড়ে যাব না। আর আমাদের হারানোর কিই বা আছে ? গ্রাম যদি ছাড়তেই হয় তাহলে এর শেষ না দেখে আমি ছাড়ব না।
— তুই একা ওদের সঙ্গে কি করে লড়াই করবি ?
— একা কে বলল , সঙ্গে আমার এই মা’টা তো আছে।
বলে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে — কি মা, তুমি থাকবে না আমার সঙ্গে ?
— মেয়ের পাশে মা কি না থেকে পারে। আমি আছি তোর সঙ্গে।
—- বেশ , তাহলে আজ রাত থেকেই শুরু হবে আমাদের লড়াই।
সেদিন রাতে দুচোখের পাতা এক করে না মা–মেয়ে। শুধু একবার করে দরজা খুলে দেখে গ্রামের লোক সবাই ঘুমিয়ে পড়ল কিনা। কারণ কাল থেকেই তাদের উপর নজরদারি চলছে। ওরা যাতে ঘটনার কথা পুলিশ প্রসাশনকে জানাতে না পারে তার জন্য পালাক্রমে তাদের বাড়ির চারিদিকে প্রহরা বসানোও হয়েছে। দেখতে দেখতে একসময় নিশুতি হয়ে আসে রাত। অঞ্জলি দরজা থেকেই দেখতে পায় প্রহরার ছেলেগুলো দুরে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে ঘুমিয়ে পড়েছে , আর কেউ কোত্থাও নেই। সে মাকে নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে আসে। তারপর মাঠের আলপথ ধরে হেটে হেটে পৌঁছোয় পাঁচ কিলোমিটার দুরের মোতিপুর থানায়। সবে তখন ভোরের আলো ফুটেছে। চায়ের দোকানের সেই জ্যেঠু ঠাকুরকে ধুপজল দিচ্ছেন। মার আর সে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চিনতে পারেন জ্যেঠু। এগিয়ে এসে বলেন — বাবার খোঁজ মিলল ?
সে ঘাড় নেড়ে না বলার পর, জ্যেঠু ফের জিজ্ঞেস — তাহলে আবার থানায় কেন ?
দোকানে সে সময় কোন খদ্দের ছিল না। তাই সে আর মা সামনের বেঞ্চে বসে জ্যেঠুকে সমস্ত খুলে বলে। শুনেই আঁতকে উঠে জ্যেঠু বলেন , আজকের দিনেও এমনটা সম্ভব ? আমরা কি জঙ্গলের রাজত্বে বাস করছি ?
সে কোন কথা বলতে পারে না। নিঃশব্দে তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জলের ধারা। তা দেখে জ্যেঠু বলেন — কেঁদো না মা , শক্ত হও। তোমার সামনে এখন কঠিন লড়াই। যাও থানায় গিয়ে কি হয় দেখ। তবে তুমি যা বললে তাতে পুলিশ সহজে এই অভিযোগ নেবে বলে মনে হয় না। শাসক দলের কর্মী সমর্থকরা জড়িয়ে আছে তো , তাই নেতাদের অনুমতি না পেলে মামলা করবে না।
— তাহলে কি হবে জ্যেঠু ?
— চিন্তা কোর না। আগে ঘুরেই এসো তো। পুলিশ কি বলে শুনে এসো। তারপর দেখি কি করা যায়।
জ্যেঠুর আশঙ্কাই সত্যি হয়। এদিনও থানার দায়িত্বে ছিলেন সেদিনের সেই ডিউটি অফিসার। তিনিও তাকে দেখে চিনতে পারেন। তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন — আবার কোন বাবা হারাল তোমার ?
কথা শুনেই গায়ে জ্বালা ধরে যায় তার। তবু সে শান্ত স্বরে বলে, না এবারে কেউ হারায় নি।
—- তাহলে ?
সে অফিসারকে ঘটনার কথা খুলে বলতেই জ্যেঠুর মতোই চমকে ওঠে তিনি বলেন — মারাত্বক ব্যাপার , ১৩ জন মিলে করল ?
লজ্জায় মুখ নিচু হয়ে যায় তার। ভেবে পায় না একজন পুলিশ অফিসারের এই কি শালীনতা বোধ ? মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার এই কি রীতি ?
অফিসারের অবশ্য অত মাথা ঘামানোর গরজ নেই। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন ফোনে। কানে মোবাইল চেপে শুধুই হ্যা স্যার আর হু স্যার করে চলেন। অঞ্জলি আন্দাজ করে — অফিসার নিশ্চয় তার ওপরওয়ালার সঙ্গে কথা বলছেন। কথা শেষ হলে তাদের দিকে ফিরে বলেন — তোমরা বাইরের বেঞ্চে একটু বসো। বড়বাবু খোঁজ খবর নিয়ে জানাচ্ছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেজে ওঠে অফিসারের ফোন। ফোন ধরেই বলেন — বুঝে নিয়েছি স্যার , আর বলতে হবে না। কিছুদিন আগেই এই মেয়েটিই একটা ছেলের সঙ্গে মিসিং ডায়েরি লেখাতে এসেছিল। সেদিনই স্যার ছেলেটাকে দেখে আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিল। ঠিক আছে স্যার , আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি।
অঞ্জলি বুঝতে পারে ডিউটি অফিসার এতক্ষণ বড়বাবুর সঙ্গেই কথা বলছিলেন। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতেই ডিউটি অফিসার বলেন ,বড়বাবু ওখানকার পার্টির নেতাদের ফোন করেছিলেন। তোমরা তো আচ্ছা ধড়িবাজ আছ। সেদিনের সেই ছেলেটার সঙ্গে লটরপটর করে ধরা পড়ে এখন গাঁয়ের লোকেদেরই ফাঁসাতে এসেছো ?
কি বলবে ভেবে পায় না অঞ্জলি। ডিউটি অফিসারের মুখের দিকে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে সে। তারপর বলে, নেতাদের কথাটাই সত্যি মনে হোল আপনাদের ? একবারও মনে হোল না একটি মেয়ে নিজের সম্পর্কে কি এই রকম মিথ্যা অভিযোগ আনতে পারে ? এই বুদ্ধি নিয়ে পুলিশের চাকরি করেন আপনারা ? না , নেতাদের কাছে বিচার–বিবেচনা বাঁধা দিয়ে বসে আছেন ?
অঞ্জলি লক্ষ্য করে কাল থেকে যেন তার উপরে কিছু ভর করেছে। ঘটনাটা ঘটার পর থেকে তার ভয় ভীতি কোথাই যেন উবে গিয়েছে। একটা লড়াকু ভাব কাজ করছে তার মধ্যে। সে শুনেছে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সব হারানো মানুষেরা এমনি করেই মরীয়া হয়ে ওঠে। নাহলে এর আগের দিন থানায় এসে সে এভাবে কথা বলার কথা ভাবতেও পারে নি। কিন্তু ডিউটি অফিসারও তার ওই সব কথার কোন গুরুত্বই দেন না। তিনি বলেন , — ওরে আমার কে রে , জ্ঞান দিতে এসেছেন। পালা, এখান থেকে খানকি মাগি। না হলে এবার দেব রুলার ঢুকিয়ে পাক কতক ঘুরিয়ে।
বলে হাতের রুলারটা দেখিয়ে চূড়ান্ত অশ্লীল একটা ভঙ্গি করেন।
তার কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। মনে হয় সপাটে গোটা কতক চড় বসিয়ে দেয় অফিসারের গালে। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। মনের ইচ্ছা চেপে রেখে সে বলে — বেশ, আপনিও ভালো করে শুনে রাখুন আমি এর শেষ না দেখে ছাড়ব না। অভিযোগ ধামাচাপা দিয়ে আপনারা পার পাবেন না। তার জন্য যতদুর যেতে হয় আমি যাব।
—- যা যা, তোর কোন নাগর , মায়ের কোন ভাতার আছে তাদের কাছে যা। আর এখানে বেশি ভ্যানতারা করলে লকআপে ঢুকিয়ে —-
আর শুনতে পারে না অঞ্জলি। মায়ের হাত ধরে থানা ছেড়ে বেরিয়ে আসে সে। চায়ের দোকানের কাছে পৌঁছোতেই জ্যেঠু বলে, তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। কি হয়েছে সব বুঝছি। দেখি কি করা যায়। একজনকে খবর পাঠিয়েছি। তোমরা ততক্ষণ চা খাও।বলে জ্যেঠু তাকে আর মাকে একটা করে কেক আর এক গ্লাস করে চা দেয়। চা খেতে খেতেই কাঁধে ক্যামেরা আর হাতে মাইকের মাইক্রোফোনের একটা জিনিস হাতে নিয়ে দুজন ছেলে এসে পৌঁছোয়।জ্যেঠুকে উদ্দেশ্য করে বলে — কই কাকা , এত জরুরি তলব কেন ? কি কেস ?
জ্যেঠু ওদের হাতেও দু’গ্লাস চা তুলে দিয়ে পাশে ডেকে নিয়ে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কি যেন বলেন। তারপর তাদের কাছে এসে বলে, ওরা খাসবার্তা চ্যানেলের সাংবাদিক। তোমরা ওদের সঙ্গে যাও। মনে হয় একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।ছেলে দুটো তাদের নিয়ে কাছেই একটা বাড়িতে নিয়ে যায়। ক্যামেরা খুলে তার মুখের সামনে মাইক্রোফোনের মতো জিনিসটা ধরে সেদিনের ঘটনা নিয়ে নানা রকম জিজ্ঞাসাবাদ করে। মাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাকে থানা গেটের সামনে দাঁড় করিয়েও ছবি তোলে ওরা।তারপর তাদের জেঠুর দোকানে বসিয়ে দিয়ে বলে, আপনারা এখানে কিছুক্ষণ বসে টিভি দেখুন। আমরা এক্ষুনি আসছি।