সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৪৩)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৪৩ 

তারই মধ্যে তাকে উজ্জীবিত করে তোলে এক অন্যরকম আশার আলো। সন্ধ্যের দিকে তাদের বাড়িতে এসে পৌঁছোন অরুণস্যার আর থানার সামনের সেই দোকানী জ্যেঠু।তাদের দেখেই মনটা অনেকখানি শান্ত হয়ে যায় তার। মনে হয় যেন কত আপনার জন। সে তাড়াতাড়ি দুটো মোড়া এনে বসতে দেয়। বসার পর প্রথমে মুখ খোলেন অরুণস্যার। মমতা মাখানো গলায় তিনি বলেন — মা রে , তোকে সান্ত্বনা কিম্বা সহমর্মিতা জানানোর কোন ভাষা আমার জানা নেই।তাই সেই চেষ্টাও আমি করব না। শুধু একটা কথাই বলব সময় সব সইয়ে দেয়। তাই ওই বিষয়টা একটা দুর্ঘটনা বলে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা কর। আর শয়তানগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইটা জারি রাখ।
— কিন্তু এত বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমি একা কি করে লড়ব স্যার ?
— তুই নিজেকে একা ভাবছিস কেন ? এই লড়াইয়ে আমরাও আছি তোর পাশে। শুধু আমরাই নয় , তুই হয়তো জানিস না আরও অনেকেই তোর পাশে আছে। নানান বাধ্য-বাধকতার কারণে ইচ্ছাস্বত্ত্বে ও সরাসরি তারা তোর পাশে এসে দাঁড়াতে পারছে না ঠিকই , কিন্তু জেনে রাখ অনেকের সমর্থন তোর সঙ্গে রয়েছে। সেটাও কিন্তু কম কথা নয়।
— সেটা আমি উপলব্ধি করতে পারছি স্যার। আর সেই জন্যই তো লড়াইটা এতদুরে আনতে পেরেছি।
— কিন্তু এখানেই থেমে গেলে তো চলবে না। শয়তানগুলোর চরম সাজার পাশাপাশি যারা তাদের আড়াল করার চেষ্টা করছে সেই মুখোশগুলো সবার সামনে টেনে খুলে দিতে হবে। তাদের বড়ো বড়ো কথা বলাটা বন্ধ করে দিতে হবে।
—- আমি কি তা পারব স্যার ?
— পারতে তো তোকে হবেই। সালিশি সভার মতো এই রকম নির্মম প্রথার বিরুদ্ধেও তোকেই লড়তে হবে। সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সালিশি সভার নির্মমতা কাকে বলে তা তোর থেকে কে’ই বা ভালো জানে ? সেই কথাটা মনে রেখেই লড়তে হবে তোকে। নাহলে তোর মতো হয়তো আরও অনেক অসহায় মেয়েকে সর্বস্ব হারাতে হবে।
সে এগিয়ে গিয়ে অরুণস্যার আর দোকানি জ্যেঠুকে প্রনাম করে বলে , আপনারা আর্শিবাদ করুন আমি যেন তা করতে পারি। আপনাদের সঙ্গে কথা বলে আমি মনের মধ্যে অন্যরকম জোর খুঁজে পাচ্ছি।
তারা দুজনেই তার মাথায় হাত রেখে বলেন , আমাদের আর্শিবাদ সবসময় থাকবে।
—- সে আমি জানি। জ্যেঠু না থাকলে আমি হয়তো অভিযোগটাই লেখাতে পারতাম না। এতদিন হয়তো সব ধামাচাপা পড়ে যেত।
অরুণস্যার বলেন, — ওনার মতো কিছু মানুষ আছে বলেই তো এখনও পৃথিবীটা বাসযোগ্য আছে।
উনি সত্যিই নমস্য মানুষ। সামান্য একজন চায়ের দোকানদার হয়েও উনি যে সৎসাহস দেখিয়েছেন তা আজকের দিনে বিরল।
— এই তো আমাকে লজ্জায় ফেললেন। আমি অত বড়ো কিছু নই। দীর্ঘদিন ধরে থানার সামনে দোকান করে আছি। ওই দোকান থেকেই আমার সংসার চলে।তাই চোখের সামনে বহু অন্যায় অবিচার দেখেও আমাকে চুপচাপ হজম করে নিতে হয়। নাহলে হয়তো পুলিশ আমার দোকানটাই গুঁড়িয়ে দেবে। কিন্তু জানেন স্যার , মনে সবসময় একটা অপরাধ বোধ
কাজ করে। সেই অবরাধ বোধের তাগিদেই সাংবাদিকদের মাধ্যমে যতটা পারি অসহায় মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি — অস্বস্তির সঙ্গে কথা গুলো বলে থামেন জ্যেঠু।
আর প্রত্যুত্তরে অরুণস্যার বলেন — আপনার অবস্থান থেকে আপনি যেটুকু করেন সেটুকু যদি আর কিছু মানুষ করতেন তাহলে সমাজটা আরও সুন্দর হয়ে যেত। আমি তো সেই কথাই এতক্ষণ অঞ্জলিকে বলছিলাম। বাধ্যবাধকতার জন্য সরাসরি না আসতে পারলেও এভাবেই অনেকেই তার দিকে সাহার্য্যে হাত বাড়িয়ে দেবে।
— আপনি ঠিকই বলেছেন মাষ্টারমশাই। সাংবাদিকরাও বলেছে তারাও এর শেষ না দেখে ছাড়বে না।

আরও কিছুক্ষণ তাকে সাহস যুগিয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে জ্যেঠু আর অরুণস্যার তার হাতে কিছু করে টাকা জোর করে ধরিয়ে দেন। সে ফিরিয়ে দিতে গেলে তারা বলেন — আমরা নিজের রক্তের সম্পর্কের কেউ নই বলেই কি আমাদের কাছে থেকে নেওয়া যাবে না ?
—- কি যে বলেন স্যার , আপনারা আমার আপনার চেয়েও আপন। এমনিতেই আপনাদের কাছে আমার ঋণের অন্ত নেই। তাই ঋণের বোঝা আর বাড়াতে চাইছি না।
— বেশ , তাহলে ঋণের পরিমাণটা না হয় আর একটু বাড়ুক। যখন সুদিন আসবে তখন না হয় সুদ সহ ফিরিয়ে দিস। তাছাড়া যুদ্ধে শুধু শক্তি আর সাহস থাকলেই চলে না , চাই রসদও।
এই টাকা’কটা তোমাকে সেই রসদ যোগাবে। আমরা না হয় রসদ যুগিয়েই তোমার পাশে থাকব। তুমি আর কোন সংকোচ কোর না।
বলেই তাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দরজার বাইরে পা রাখেন তারা। সুদের প্রসঙ্গ উঠতেই আর একজনের কথা মনে পড়ে যায় তার। সে এমনি করেই বার বার সুদ সহ আসল ফেরত দেওয়ার কথা বলত সে। তার কাছে সেই ঋণ তো থেকেই গেল। তারও কি কোন ঋণ নেই অঞ্জলির কাছে ? তার কথা সে আর মনে করতে চায় না। বরং স্যার আর জ্যেঠুর কথাই ভাবতে থাকে সে। একটা ভালো লাগায় ভরে ওঠে তার মন। এ পর্যন্ত যারাই তার কাছে এসেছে তাদের সবারই কোন না কোন স্বার্থ রয়েছে। কেবল এই দুটি মানুষ কোন রকম স্বার্থ ছাড়াই তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। স্বীকার করে নিয়েছেন বাধ্যবাধকতার কথা। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলেই বুকে অনেকখানি বল পেয়েছে সে। এদের কথা সে কোনদিন ভুলতে পারবে না।

ভুলতে পারবে না সাংবাদিকদের ভূমিকাও। তারা না থাকলে তো পুলিশ আর পার্টির নেতারা কোথাকার জল কোথাই মেরে দিত তার কেউ কোন কুলকিনারা পেত না।তাদের মতো অসহায় মেয়েদের জন্য সংবাদমাধ্যমের আজ বড়ো প্রয়োজন। নাহলে বিচারের বানী নিরবে নিভৃতে কেঁদেই মরবে। ক্রমশ রাত বাড়ে। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা পাড়া। এমনিতেই আদিবাসী পাড়াগুলি নিস্তব্ধই থাকে। কিন্তু সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন, পুলিশ- প্রশাসন, মজা দেখতে আসা মানুষজনের ভীড়ে দিনভর আজ পাড়া এত বেশি সরগরম হয়েছিল যে তারা চলে যেতেই অন্যান্য রাতের চেয়েও যেন নিস্তব্ধতা আর ও বেশি জাঁকিয়ে বসে।তার মনে হয় বাড়িটাও যেন গিলতে আসছে তাকে।
মা গিয়ে অনেকক্ষণ আগে বিছানা নিয়েছে। ক্লান্তিতে তারও শরীর যেন টলছে। কিন্তু নানা দুঃশ্চিন্তায় ঘুমোতে যেতেও পারছে না। এ সময় কারও সঙ্গে চিন্তাগুলো ভাগ করে নিতে পারল মাথার ভারটা কিছুটা হালকা হত। ভাগ করে নেওয়ার ভাবতেই দিদির কথা মনে আসে তার। দিদিকে একটা খবর পাঠাতে পারলে ভালো হত। কিন্তু কি ভাবেই বা খরব পাঠাবে সে। এতদিন তো সেই কাজটা একজন করে এসেছে। আবার সেই তারই কথা ঘুরে ফিরে চলে এল। না তার কথা আর কিছুতেই মনে করতে চায় না সে। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে সে মা’কে নিয়ে নিজেই যাবে দিদির বাড়ি। তার জন্য না হোক , ভাইয়ের জন্য তাকে দিদির বাড়ি একবার যেতেই হবে।কিছুদিনের মধ্যেই পুজোর ছুটি পড়ে যাবে। তখন হোষ্টেল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক ছিল সে গিয়ে ভাইকে নিয়ে আসবে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তাকে গ্রামে আনাটা ঠিক হবে না। এমনিতেই এখন ও অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। তার ব্যাপারটা ভাইয়ের মনে কেমনভাবে রেখাপাত করবে কে জানে ? তাছাড়া পাড়ার লোকেরা টিকাটিপ্পনী করলেই বা তার প্রতিক্রিয়া খুব একটা ভালো হবে বলে তার মনে হয় না। তাই দিদিকে বলতে হবে কোন একটা কারণ দেখিয়ে এবারের ছুটিটা ভাইকে যেন তার বাড়িতেই রাখে। আচমকা উঠোনে কিছু ভারি পায়ের শব্দে ছিঁড়ে যায় তার চিন্তাজাল।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।