সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৩৮)
সালিশির রায়
কিস্তি – ৩৮
ঝাপসা হয়ে যায় তার চোখ। নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারে না। এই হৃদয়দাকে সে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবেসেছিল। এই হৃদয়দার জন্যই সে নরকে যেতেও রাজি ছিল। এই হৃদয়দাকেই সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ভালোবেসেছিল সে ।এই হৃদয়দার হাতেই সে তুলে দিয়েছিল সর্বস্ব। বিয়েটাই না হয় তাদের হয়নি, কিন্তু সে তো মনে মনে হৃদয়দাকে স্বামী মেনে ছিল। সেই হৃদয়দাই তাকে এই বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে চলে গেল ? তাহলে কি হৃদয়দা তাকে একটুও ভালোবাসে নি। তার শরীরের মোহে ভালোবাসার অভিনয় করছিল এতদিন।শরীরের মোহ কেটে গেলে এমনিতেই তাকে ফেলে পালাত, কোনদিনই বিয়ে করত না। কিন্তু সব ব্যাপারে তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথাটা সে অস্বীকার করবে কেমন করে ? তাহলে নানা ভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানোটাও কি শরীরে পৌঁছানোর সিঁড়ি ছিল মাত্র ?
আরও অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসে তার মনে। কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পায় না সে। ক্রমে রাত ঘন হয়ে আসে। মশারা ছেঁকে ধরে তার সারা শরীর। দু’হাত বাঁধা থাকায় তাকে সব কিছু সহ্য করে নিতে হয়। এক সময় সনাতন এগিয়ে এসে ঘোষণা করে সালিশির রায়। কিছুটা নিম্নস্বরে সে বলে , আমাদের সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে একবার জরিমানা ধার্য্য হয়ে গেলে তা আদায় না হওয়া পর্যন্ত ছাড় মেলে না। কিন্তু ওই হারামজাদীর টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই আমরা মোড়ল পরিষদ ঠিক করছি গায়ে গায়ে ওর জরিমানার টাকা উসুল করে নেওয়া হবে।কথাটা শুনে হতভম্ভ হয়ে যায় অঞ্জলি। কথাটার অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না তার।
তাই সে চিৎকার করে বলে ওঠে — না, আমি এ বিচার মানি না।
জবাবে সনাতন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, এখন মানি না বললে হবে ? তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে বাইরের ছোঁড়াটার সঙ্গে ওইসব করার সময় মনে ছিল না ? আর এখন আমরা একটু ওইসব করে জরিমানা আদায় করতে চাইলেই যত দোষ। একেই বলে ভালোর কাল নেই। নগদ টাকা নেই বলে আমরা মাথা খাটিয়ে একটা উপায় বের করলাম , কোথায় সেটা মেনে নেবে তা নয় , বলছে বিচার মানি না।
কি বলবে কিছু ভেবে পায় না অঞ্জলি। বাপের বয়সী লোকটা কত সহজ ভাবেই কুইঙ্গিতপূর্ণ কথা গুলো বলে চলেছে। প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে , এখন কথা বলার ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে ফেলে অঞ্জলি। কোন রকমে সে কেবল বলতে পারে , আমি কোন অন্যায় করি নি। তাই এই বিচার আমি মানি না।
মোড়ল বলে, বেশ তাহলে আজ রাতেই পাঁচ গাঁওয়ের সালিশি বসানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তখন কিন্তু ওইসব গাঁয়ের মোড়লরাও জরিমানা উসুল করে নেবে।
অঞ্জলি জানে পাঁচগাঁওয়ের বিচারে ও তেমন কিছু লাভ হবে না। বরং পাঁচ গাঁয়ের পাঁচজন মোড়ল এসে সনাতনের রায়কেই সমর্থন জানাবে। কারণ তারাও তো এই ধরণেরই রায় দেয় নিজ নিজ গ্রামের সালিশি সভায়। তাই তাদের কাছেও সুবিচার পাওয়ার আশা করাটাই বৃথা। কিন্তু সলিল সমাধি নিশ্চিত জেনেও তো ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা করে। অঞ্জলিও সেই ভেবেই বলে , বেশ ডাকা হোক পাঁচ গাঁও।
আদিবাসী সমাজে পাঁচগাঁও অনেকটা উচ্চ আদালতের মতো ব্যাপার। গ্রামের সালিশি সভার রায় মনোপুত না হলে পাঁচগাঁওয়ের ডাক দেওয়া হয়। পাঁচটি গ্রামের মোড়ল বা মোড়ল পরিষদের লোকেরা এসে সালিশির ঘোষিত রায় পর্যালোচনা করে নতুন রায় দেন। কিম্বা ঘোষিত রায়ই বহাল রাখেন।
সেইমতো রাতেই মোটর বাইক হাঁকিয়ে বেরিয়ে যায় সনাতনের ছেলে শোভন। ভোটে জেতার পর সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মোটরবাইকটা কিনেছে ওরা। সেই বাইকে চাপিয়ে কাছাপিঠের পাঁচটি গাঁ পাঁচজন মোড়লকে এনে হাজির করে শোভন। মোড়লদের দেখেই সুবিচারের আশা উবে যায় অঞ্জলির। সে দেখে নেশায় সবার পা টলছে। ভালো করে কেউ কথাই বলতে পারছে না। এরা কি করে বিচার করবে ভেবে পায় না সে। সেই অবস্থাতেই ওদের আরও মদ খাওয়ায় সনাতন।অঞ্জলির বুঝতে পারে তারই রায় যাতে বহাল থাকে সেইজন্য ওইসব মোড়লদের মদ খাইয়ে বশ করে নেওয়া হোল। বিচারের নামে এরপর তো প্রহসন হবে। শেষ আশা ভরসাটুকু ও হারিয়ে যায় তার। আর শয়তানগুলোর হাত থেকে বাঁচার কোন পথ নেই। তাই মনে মনে সে নিজের মৃত্যু কামনা করতে শুরু করে।বাড়ির সবার কথা খুব করে মনে পড়ছে তার। বাবার সঙ্গে কি আর কোনদিন দেখা হবে ? অন্য সবার সঙ্গেই কি দেখা হবে ? মা ঘরে একা কি করছে এখন ? চোখের সামনে মেয়ের হেনস্থা দেখতে পারবে না বলেই বোধহয় মা আসতে পারে নি সালিশি সভায়।মনে মনে সে বলে, মা গো শয়তানদের হাত থেকে আমাকে বাচাও। মনের কথা মনেই থেকে যায়। কিছুক্ষণ পর সালিশি সভায় এসে বসে পাঁচ গাঁয়ের পাঁচ মোড়ল। বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে জড়ানো গলায় তারা বলে , শোন সবাই , আমরা বিচার করে দেখলাম সনাতন ঠিক রায়ই দিয়েছে। আমরা ওর রায়েই রায় দিয়ে বলেছি গায়ে গায়েই জরিমানা উসুল করে নিতে হবে। তাহলে আর কেউ অনাচার করার সাহস পাবে না।
ওই কথা শোনার পরই হই হই করে ওঠে উপস্থিত জনতা। তখন বোধহয় মধ্য রাত পার হয়ে গিয়েছে। তবুও অনেকেই দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। তাদের মধ্যে সব বয়েসের মেয়েরাও রয়েছে। তাদের সামনে দড়ি খুলে তাকে পিছনের বাঁশ বাগানের দিকে টেনে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে থাকে শোভন — অশোকেরা। সে হাত ছাড়িয়ে শেষবারের মতো ছুটে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু উপস্থিত জনতা তাকে তাড়া করে ধরে ফের তুলে দেয় শোভনদের হাতে। সে হাত জোড় করে সবার উদ্দেশ্যে বলে, আমার বাবা হারিয়ে গিয়েছে। মা থেকেও না থাকার সামিল। তোমরা এখানে যারা রয়েছ তারা আমার মা-বাবা, দাদু-ঠাকুমা, দাদা-দিদির মতো। আমি কোন অন্যায় করি নি। তবু জরিমানা মেনে নিচ্ছি। শুধু আমাকে কিছু দিন সময়ের ব্যবস্থা করে দাও। আমি আস্তে আস্তে সব মিটিয়ে দেব। তোমাদের বাড়িতেও আমারই বয়সী মেয়ে রয়েছে। তাদের কথা মনে করে আজ আমার ইজ্জত বাচাও। বলে সে হাত জোড় করে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কারও মুখ থেকে একটা কথাও শোনা যায় না। সব যেন ভাবলেশহীন পাথরের মুখ মনে হয়। ততক্ষণে তাকে বাঁশ ঝোপের খড়ের কুটোর উপর নিয়ে গিয়ে ফেলে শয়তানের দল। সবার চোখে হিংস্র হায়নার দৃষ্টি। ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেয় তার পোশাক। একের পর এক হামলে পড়ে হায়নার দল। তার সারা শরীর আঁচড়ে-কামড়ে খুবলে খায় হিংস্র জানোয়ারের মতো। যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে বাঁচাও বাঁচাও বলে আত্মচিৎকার করে ওঠে অঞ্জলি। কেউ সে চিৎকার শুনে এগিয়ে আসে না। নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে তখনও মজা দেখছে একদল মানুষ। অঞ্জলি দেখে শয়তান দুটো তো বটেই , দাদু, বাবা, কাকার বয়সী মানুষগুলোও একের পর এক ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপরে। নির্বিচারে ধর্ষণ করে চলে তারা। অদুরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ধর্ষকদের কারও, মা কারও স্ত্রী। ওইসব মহিলাদের সামনে নির্মম ভাবে লুট হয়ে যায় একটি অসহায় মেয়ের ইজ্জত। ঠিক কতক্ষণ ওই নারকীয় নির্যাতন চলেছিল জানে না অঞ্জলি। পর পর ১১ জনের ধর্ষণের পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। শুধু তার ইজ্জত হারানোর বোবা কান্নায় যেন ভারী হয়ে ওঠে ভোরের বাতাস।
ক্রমশ…