সালিশির রায়
কিস্তি – ১৪
দৃশ্যটা আজও ভুলতে পারে নি অঞ্জলি। পাঁচদিনের মাথায় নিরাপদেই শিকার পরব থেকে বাড়ি ফেরে বাবা। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে অঞ্জলিরা। এ কয়েকদিন দুশ্চিন্তায়, দুশ্চিন্তায় কেটেছে তাদের।একে বাবার বয়েস হয়েছে , তার উপরে পাড়ার বিষ নজর রয়েছে তাদের উপরে। বাবাকে একা পেয়ে কিছু করবে কিনা সেই ভাবনাই এই ক’টা দিন তাদের দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। দুশ্চিন্তাটা সেই শুরু হয়েছিল সালিশি সভার পর থেকে। সেই থেকেই তারা খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। তাদের সমাজে একবার কারও কাছ থেকে সালিশি সভায় জরিমানা আদায় করতে পারলে তাকেই বারে বারে পাকে প্রকারে বলির পাঁঠা করা হয়। সালিশি সভা ডেকে তার কাছে থেকেই জরিমানা আদায় করে পাড়ার লোক।
শিকারের সময় বাবার পায়ে পা লাগিয়ে সেই রকম কোন অজুহাত খাড়া করা হতে পারে বলে তাদের আশংকা ছিল। কিন্তু বাবাকে শিকারের ভাগ নিয়ে ফিরতে দেখে হাসি ফোটে তাদের মুখে। শুরু হয়ে যায় পরবের তোড়জোড়। বাবার আনা মাংস রান্না করতে বসে বৌদি। অঞ্জলি মনে মনে ভাবে , বাবাকে তো এতটুকুও ভক্তি নেই , কিন্তু বাবার আনা মাংসে ভক্তি ষোল আনা। তখন দাদাকে শিকারে যেতে দিলে বাবাকে এত কষ্ট করতে হত না। অথচ রান্নার পর বৌদি, দাদা আর তার জন্য আলাদা করে ভালো মাংসগুলো তুলে রেখে বাবাকে শক্তগুলো দেয়। বাবার দাঁতে জোর নেই। তাই নিজের শিকার করে আনা মাংস ভালো করে খেতেও পারে না মানুষটা।
দেখে খুব কষ্ট হয় তার। ইচ্ছে হয় আচ্ছা করে দু’কথা শুনিয়ে দেয় বৌদিকে। কিন্তু ওই রকম একটা ছোট ব্যাপার নিয়ে পরবের দিনে কিছু বলতেও তার রুচিতে বাঁধে। একবাড়িতে থেকেও বৌদির ওই মানসিকতা দেখে তার মন কেমন যেন কু গায়। মনটা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যরকম ভালো লাগায় ভরে যায় তার মন। হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট ঝুলিয়ে পরবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ঢোকে হৃদয়দা। তাকে দেখে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় তার। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাড়িতে সবাই বিশেষ করে দাদা-বৌদি থাকায় চোখাচোখি ছাড়া কোন কথা হয় না। হৃদয়দা মিস্টির প্যাকেটটা তার হাতে দিয়ে দাদার সংগে গল্পে মেতে ওঠে। বাইরে তখন ধামসা-মাদলের সঙ্গে গান করতে করতে কোমর দুলিয়ে নাচছে পাড়ার মেয়েরা। তারই কেবল ঘরবন্দী হয়ে রয়েছে। তাই মনটা বিষন্ন হয়ে যায় তাদের।
সেটা লক্ষ্য করেই হৃদয়দা লাভপুরে সিনেমা দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। শুনে তো বৌদি এক পায়ে খাড়া। ঠিক হয় দাদা- বৌদি যাবে একটা সাইকেলে আর সে যাবে হৃদয়দার সাইকেলে। পাশাপাশি যেতে যেতে ইচ্ছে করেই হৃদয়দা পিছিয়ে পড়ছিল। আর সেই ফাঁকে টুকটাক কথা হচ্ছিল তাদের। সিনেমা দেখে মোগলাই পরোটা খেয়ে ফিরেছিল তারা। টাকাটা দাদাই মিটিয়েছিল। কিন্তু হৃদয়দা বাবা — মা আর ভাইয়ের জন্য আলাদা করে কিনে নিয়েছিল। হৃদয়দার এই বিবেচনা বোধটা তার খুব ভালো লাগে। হাসি ঠাট্টায় দিনটা বেশ ভালোভাবেই কেটে যায় তাদের। ভুলে যায় পাড়ার পরবে অচ্ছুৎ হয়ে থাকার কথা। কিন্তু পরব পেরিয়ে যেতেই আচমকা তাদের পরিবারে যেন প্রবল বেগে আছড়ে পড়ে ঘুর্ণিঝড়। তার দাপটে আরও একবার বেসামাল হয়ে যায় তাদের পরিবার।
বিপদটা আসে অন্যদিক থেকে। সেদিন মা বাড়ির পিছন থেকে ছাতা( মাশরুম জাতীয় ছত্রাক ) তুলছিলেন। সেই সময় সেখানে দাঁড়িয়ে দেখছিল মঙ্গলিকাকী। তা দেখে মা দয়া দেখিয়ে কিছু ছাতা তাকে দেয়। সেই দয়া দেখানোটাই কাল হয় মায়ের। সেই ছাতা রান্না করে খাওয়ার পর তাদের কিছু হয় না। কিন্তু মঙ্গলিকাকীদের বাড়ির সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। বমি-পাইখানা করতে করতে মরণাপন্ন দশা হয় তাদের। টানা চারদিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফেরে তারা। আর তারপরই সব রাগ গিয়ে পড়ে মায়ের উপর। প্রথম দিকে মা’কে দেখে পুকুর ঘাটে গুজগুজ ,ফুসফুস চলতে থাকে। অশনি সংকেত টের পায় অঞ্জলিরা।
বিকাল বেলায় কান্নার রোল ওঠে মঙ্গলিকাকীদের। বাড়ি থেকেই তারা শুনতে পায়, হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে আসার পর আবার বমি-পাইখানা শুরু হয় মঙ্গলিকাকীর শ্বশুর তারণদাদুর। তাতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয় তারণদাদুর। তারপর আর বিষয়টি কানাঘুষোর পর্যায়ে থেমে থাকে না। বরং পরিবারের উপরে ঝড়টা আছড়ে পড়ে। পাড়ার লোকেরা তাদের বাড়িতে চড়াও হয়। শোকের আবহ ভুলে ঝগড়ায় পেয়ে বসে সবাইকে। তাদের মধ্যেই মেয়েদেরই গলা শোনা যায় বেশি। সুরোকাকী, মঙ্গলিকাকীরা মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, তুই ডাইনী – ফোকোস। তুইই তুক করে লোকটাকে খেলি। ভালোয় ভালোয় স্বীকার কর, নাহলে ঝেটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেব।মা খুবই বিব্রত হয়ে পড়ে। পাড়ার লোকেদের কি যেন বোঝাতে যায়। কিন্তু ওদের চিৎকারে চাপা পড়ে যায় মায়ের কথা।
পাড়ার মেয়েরাই মায়ের মুখ নেড়ে বলে, তোর কোন কথা শুনতে চাই না। একই ছাতা খেয়ে তোদের কিছু হল না কেন বল ? তোর মনেই পাপ আছে না হলে লোকটা মরার পর সবাই দেখতে গেল , কেবল তোদের বাড়ির কেউ গেল না কেন ? এই এক মুশকিল। বিনা দোষে কাউকে যদি একবার অপরাধী সাব্যস্ত করে দেওয়া হয় তাহলে তার মনে এক ধরণের অপরাধ বোধ শুরু হয়ে যায়। মনে হয় সত্যিই বুঝি তার কারণেই এমনটা ঘটেছে। মানসিক দৃঢ়তাটাই হারিয়ে যায়। তখন সে জোরের সঙ্গে নিজেকে নিরপরাধ বলার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলে। তাকে নিয়ে আলোচনা এড়াতে সে তখন আলোচকদেরও এড়িয়ে চলতে শুরু করে। আর সেটা অপরাধজনিত কারণেই ধরে নিয়ে আলোচকদের পোষিত ভুল ধারণাটাই আরও বদ্ধমূল হয়ে ওঠে। তারণদাদুর ক্ষেত্রেও সেই ঘটনাই ঘটে।
মৃত্যুর খবরটা জানার পরই উভয় সংকটে পড়ে অঞ্জলিরা। সহমর্মিতা জানানোর জন্য পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সেক্ষত্রে অবধারিতভাবে তাদের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখে পড়ার আশংকা ছিল। হাতের কাছে পেয়ে সবাই তখন বলত, তুক করে এখন দেখতে এসেছে লোকটা মরল কিনা। সেক্ষেত্রে হাতের নাগালে পেয়ে মারধোর এমনকি পিটিয়ে মেরে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। সেই আশঙ্কাতেই তারা তারণদাদুকে শেষবারের মতো দেখতে যেতে পারছিল না। আবার পাড়ারই একটি লোকের মৃত্যুর খবর পেয়ে তার বাড়ি না যাওয়াটাও মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। অঞ্জলিদের এই টানাপোড়নের মধ্যেই ওরা হইহই করে বাড়িতে চড়াও হয়। ওদের লাগাতার জেরার মুখে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে মা। কেমন যেন অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে মুখে ভীত সন্ত্রস্ত ভাব ফুটে ওঠে।
মায়ের ওই অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হয় অঞ্জলির। সে মায়ের গায়ে হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। মাকে ওদের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে সে বলে , কাকী তোমরা কিন্তু মা’কে শুধু শুধু অপরাধী সাজাচ্ছ।
—- হ্যা , শুধু শুধু বইকি, লোকটাকে তো তোর মা’ই ছাতা খাইয়ে তুক করে মেরেছে। আমাদেরও মারার তাল করেছিল। তোর মা ডাইন, তোর মা ফোকোস।
— এটা তোমরা ঠিক বলছো না কাকী। মা তো তোমাদের বেছে বেছে ছাতা দেয় নি। ওই ছাতা তো আমরাও খেয়েছি। তোমাদের ছাতাটা হয়তো কোনভাবে বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। রান্নার সময়ও তো বিষাক্ত কিছু পড়তে পারে। তারজন্য মায়ের কি দোষ বলো ?
— তুই চুপ কর মাগী। তোর কাছে আমরা সালিশি শুনতে আসি নি। সালিশির জন্য আমরা মোড়লের কাছে যাব। জানগুরুর কাছে যাব।
এই ভয়টাই পাচ্ছিল অঞ্জলি। সালিশিসভার বিষয়টা ভালোই জানা আছে তার। জানগুরুর বিষয়ও অজানা নয়। ওরা সব এক একটা মহা ধড়িবাজ হয়। যারা তার কাছে যায় তাদের দেদ্দার মদ খাওয়ায় জানগুরু। তারপর তাদের কাছে থেকেই কায়দা করে জেনে নেয় ডাইন সাব্যস্ত করা লোকটির পরিবারের নাড়ী নক্ষত্র। নেশায় বেহুঁশ লোকগুলোর মনেও পড়ে না ধড়িবাজ লোকটাকে তারা কি বলেছে। তাই তার কথাকেই বেদবাক্য মনে করে তারা। আর তার উপরেই ভিত্তি করে চলে তার কেরামতি। তার রায়ের উপর ভিত্তি করে সালিশিসভা বসিয়ে জরিমানার নিদান ঘোষণা করা হয়। তাই সালিশিসভা আর জানগুরুর কথা শুনে সে ছুটে গিয়ে ওদের পায়ে ধরে বলে — ও কাকী তোমরা আর যাই করো, জানগুরুর কাছে যেও না। সালিশিসভাও ডেক না। জানোই তো আমাদের আর জরিমানা দেবার ক্ষমতা নেই। এরপর হয়তো আমাদের গ্রাম ছেড়েই চলে যেতে হবে। এতদিন একসঙ্গে আছি , তোমাদের ছেড়ে কোথাই যাব বলো ?
—- তোরা কোথাই যাবি তা আমরা কি জানি।
বলে ওরা পা ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে চলে যায়। আর আসন্ন দুর্যোগের আভাস পায় অঞ্জলি।
ক্রমশ…