|| শাম্ভবী সংখ্যা ২০২১ || T3 শারদ সংখ্যায় অয়ন ঘোষ

মাতৃরূপেন

“এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাবো না/ বলে বলবে লোকে মন্দ কারো কথা শুনব না।”

ভাদুরে বেলা আদুরে আদুরে পেরিয়ে আশ্বিন এলেই মনে হয় ওই যে ঘরের মেয়ের আসার সময় হলো। আগের দিনে বাড়ির পুজোয় সাবেকি দালান বা বারোয়ারী আটচালায় রথের দিনই কাঠামো বাঁধা শুরু হয়ে যেতো। চার ছেলেমেয়ে তাদের বাহন, অসুর, মোষ, সিংহ, সাপ সব মিলিয়ে একান্নবর্তী পরিবারের ছবি একই চলচিত্রে। টানা টানা চোখ দিয়ে মা যেন সবটা দেখছেন আর দশ হাতে সবকিছু সামাল দিচ্ছেন। সুযোগ পেলেই দল বেঁধে আমরা ভিড় করতাম দালানে, আমাদের চোখের সামনে এক’মেটে, দো’মেটে হতে হতে গড়ে উঠত একটা গোটা সংসার। ঠাকুর গড়তেন পটুয়া দাদু আর তার সঙ্গে আসা জোগাড়ে কিন্তু মনে হতো যেন আমরাই গড়ছি। তিল তিল করে মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী হয়ে উঠতেন। আমাদের তো বারো মাসে তেরো না, সাত সতেরো পার্বণ। কিন্তু দুগ্গা পুজোর ধারে কাছে কেউ নেই। এতো শুধু পুজো নয়, এ যে শারদ উৎসব। সেপ্টেম্বরে যে না দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা ঠাকুর এসে দেখে গেলেন ধরিত্রীতে সব ঠিকঠাক আছে কিনা, তেমনি শুরু হয়ে গেলো উৎসবের মেজাজ।

তা এই যে আমাদের ঘরের মেয়ে ফি বছর শারদে আমাদের কাছে আসেন এই প্রথা শুরু হলো কবে থেকে সেটি একটু দেখে নেওয়া যাক। পৌরাণিক তথ্য অনুযায়ী বসন্তেই দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন ঘটত যা এখনও ঘটে বাসন্তী পুজোর বা অন্নপূর্ণা পুজোর মধ্যে দিয়ে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী শরৎকালে দেবীর বোধনকে ‘অকাল বোধন’ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। ‘অকাল’ বলার কারণ, এটি নাকি দেববন্দনার উপযুক্ত সময় না। হিন্দু ধর্মের প্রথা অনুযায়ী বসন্ত কাল বা উত্তরায়ণের সময়টি হলো দেবর্চনার সবচেয়ে উপযুক্ত বা পবিত্র সময় কারন উত্তরায়ণের সময় দেব দেবীরা জাগ্রত ও সক্রিয় থাকেন। শরৎ বা দক্ষিনায়ণের সময় হলো দেবদেবীদের বিশ্রামের সময়। পুরাণ অনুসারে দক্ষিনায়ণের সময়টিকে অসুর আধিপত্যের সময় হিসেবে ধরা হয়। সেই হিসেবে মা দুর্গাকে যেহেতু ভুল সময়ে আবাহন করা হয়েছিল, তাই এটি অকাল বোধন হিসেবেই পরিচিত। রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করার জন্য শ্রীরাম নাকি এই অসময়ে দুর্গাবন্দনা করেছিলেন, সমুদ্র সৈকতে। যদিও এর কোনো উল্লেখ বাল্মীকির রামায়ণে নেই। এটি একান্তই কৃত্তিবাসী রামায়ণের কল্পনা। এছাড়া কালিকা পুরান ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুযায়ী রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময়, দেবকুল রামের পক্ষ নেয়। রামের মঙ্গলের জন্য সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা দেবী দুর্গার বোধন ও পূজা করেন। কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ন কিন্তু বলছে দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে স্বয়ং রামচন্দ্র এই পুজো করেন একশত আটটি নীলপদ্ম দিয়ে। আশ্বিন মাসের ষষ্ঠীর দিন রামচন্দ্র এই পুজো শুরু করেছিলেন ও অষ্টমীর দিন রামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মা দুর্গা তার সামনে প্রকটিত হয়ে তাকে আশীর্বাদ প্রদান করেন। অষ্টমীর ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দুর্গা রামের অস্ত্রে প্রবেশ করে তাকে রাবণ বধের শক্তি প্রদান করেন। দশমীর দিন রাবণের বধ হয়। পুরাণ অনুযায়ী এই সন্ধিক্ষণেই মা দুর্গার চামুণ্ডা স্বরূপ চণ্ড-মুন্ড নামে দুই অসুরকে বধ করে। এছাড়া শরৎ কালে দুর্গা পূজার প্রচলনের আরো বিবিধ মত রয়েছে। শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুসারে রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নিজেদের হারানো হারানো রাজ্য ও অধিকার ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্য মেধা ঋষির পরামর্শে মা চণ্ডীর আহ্বান করেন শরৎ কালে। অন্য মতে ত্রিদেবের পরামর্শে মহিষাসুরকে বধ করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন এই শরতেই।

তবে ভারতীয় ভূখণ্ডে দুর্গা পুজোর প্রচলন নিয়ে আরো ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। ভারতের আদি সভ্যতা, দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃ পুজোর চল ছিল। আর্য সংস্কৃতি দেবী না দেব পূজায় অভ্যস্ত বেশি ছিল কিন্তু অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবী আরাধনার। দেবী বন্দনা আদ্যাশক্তির প্রতীক হিসেবে করা হতো। সেসময় অনার্য পরিবার ছিল মাতৃতান্ত্রিক। এই মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাপেক্ষে তৈরি হয় মাতৃ আরাধনার ধারনা। নৃতাত্বিক পন্ডিতদের মতানুযায়ী ভারতীয় ভূখণ্ডে মাতৃ পূজার প্রচলন আরো প্রাচীন। প্রায় ২২ হাজার বছর পূর্বের প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে দেবী পূজার চল ছিল। সিন্ধু সভ্যতার সময়ে তা আরো গঠনমূলক ও সুচারু হয়। সিন্ধু সভ্যতায়, দেবীমাতার, ত্রিমস্তক দেবতা ও পশুপতি শিবের পুজো করা হতো বলে জানিয়েছেন ঐতিহাসিকরা। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে মা’ই প্রধান। তিনিই সংসারের কেন্দ্র শক্তি, সেই ধারনা থেকেই মাতৃদেবী শক্তির আধার ও পরম ব্রহ্ম। শাক্ত মতানুসারে রহস্যরূপিনী কালিকা শক্তিই পরম পুরুষের আদিশক্তি। তার থেকেই বিশ্ব চরাচর সৃষ্ট। তিনিই পরমা বিদ্যা। অন্যান্য দেব – দেবী তারই প্রকাশ মাত্র। মহাভারতও বলছে দুর্গা কালিকা শক্তির আরেক রূপ। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী প্রথম দুর্গা পূজা করেন শ্রীকৃষ্ণ, দ্বিতীয়বার করেন ব্রহ্মা ও তৃতীয়বার করেন ব্রহ্মার মানস পুত্র মনু, ক্ষীরদ সাগরের তীরে। তবে কলিকা পুরাণ রামের প্রথম দুর্গা পূজা করার কথা বলছে।

সে যাই হোক, দুর্গা শব্দটি কিন্তু একটি প্রাচীন শব্দ। তৈত্তেরীয় আরণ্যকে দুর্গা শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়:

তাং অগ্নিবর্ণাং তপস্য জলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম
দূর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরমে নমঃ।।

অর্থাৎ, অগ্নিবর্না তপপ্রদীপ্তা সূর্যের ন্যায় যার বরণ, যিনি কর্মফলের প্রার্থিত হন, সেই দুর্গাদেবীর আমি শরণ নিই, হে সুন্দররূপে ত্রাণকারিনী, তোমায় নমস্কার।

ঋগ্বেদের দেবীসুক্ত যা দুর্গাপূজায় চণ্ডীপাঠের পূর্বে পাঠের বিধান আছে, সেই সুক্তে দেবীকে পরমা প্রকৃতি, নির্বিকারা ও জগতের ধাত্রীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। দুর্গা শব্দের অর্থ যিনি আমাদের সকল দুঃখ, যন্ত্রনা, ক্লেশ, ভয়, দুর্গতি হরণ করেন। স্কন্দপুরান অনুযায়ী, মা দুর্গা কেবল রুরু দৈত্যের পুত্র দূর্গাসুরই না, আরো অনেক যেমন মধুকৈটভ, শুম্ভনিশুম্ভ, মহিষাসুর ইত্যাদি অত্যাচারী অসুরকে নিধন করে জগৎবাসীর দুর্গতি নাশ করেন তাই তো তিনি দুর্গা – “তত্রৈব চ বধিষ্যামি মহাসুরম”। মা জগতের কল্যাণময়ী, তিনিই জগৎ জননী। ভক্তদের তিনি ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, প্রদান করেন তাই তিনি সর্ব কামার্থদায়িনী। জগৎ সংসার তারই দেওয়া অন্নে প্রতিপালিত তাই তিনি অন্নদা। রুদ্রের হ্লাদিনী শক্তি তিনি, তাই তার আরো এক নাম রুদ্রানী। শত আঁখির দ্বারা তিনি এই বিশ্ব সংসারের সবকিছু লক্ষ্য করেন তাই তিনি শতাক্ষী। তিনি বিষ্ণুর শ্রেষ্ট ভক্ত তাই তার নাম বৈষ্ণবী। তার গাত্র কাঁচা সোনার ন্যায় তাই তিনি গৌরী। পর্বত দুহিতা বলে তিনি পার্বতী। তিনি রূপান্তর কল্পে কল্পে তার মায়ায় আমাদের বশ করে রাখেন, সেই কারনে মহামায়া। মাতৃরূপিনী এই মা আমাদের সন্তানের ন্যায় প্রতিপালন করেন, রক্ষা করেন। তাই চণ্ডীতে তাকে বন্দনা করা হয়েছে:

বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপাতংস্থিরূপা চপালনে।
তথাসংহৃতি রূপান্তে জগতোহস্য জগন্ময়ে।।

সমস্ত দেবতার তেজ থেকে তিনি আবির্ভূতা হবার পর, ঋকমন্ত্রে নিজের পরিচয় দেবতাদের সামনে রাখেন বলে পুরানে বর্ণন করা হয়েছে। সেই ঋকমন্ত্রই হলো ঋগ্বেদের দেবীসুক্ত। এছাড়াও বেদের রাত্রিসুক্তে কালিকা শক্তি, শ্রীসুক্তে লক্ষ্মী ও বাণীসুক্তে সরস্বতীর বন্দনা করা হয়েছে। শুক্ল যজুর্বেদের বাজসায়নী সংহিতায় অম্বিকা দেবীর, সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্রে ভদ্রকালীর, কেন উপনিষদে দেবী উমার কথা পাই, এগুলি সব মা দুর্গারই ভিন্ন ভিন্ন নাম। এছাড়া যাজ্ঞিকা উপনিষদে, দূর্গার গায়ত্রী আছে – “কাত্যায়নায় বিমতে কন্যাকুমারীং ধীমহি তন্নো দুর্গি প্রচোদয়াৎ”। সম্বোধন পদে দূর্গা এখানে ‘দুর্গি’ হয়েছে। কাত্যায়নী, কন্যাকুমারী এগুলোও যে দুর্গার অপরাপর নাম তা আমরা অনেকেই জানি। সুতরাং আমাদের ঘরের মেয়ে উমা অনাদিকাল থেকে যে এই ভারতভূমিতে পূজিতা হয়ে আসছেন তা নিয়ে দ্বিমত থাকা উচিত না।

আমাদের বাংলাদেশ ভালোবাসার মাটি দিয়ে তৈরি। আমাদের বিশ্বাস দাঁড়িয়ে আছে স্নেহ ভালোবাসা ও মানবিকতার ওপর। “ভাইয়ের মায়ের এতো স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ/ ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি” – এই হলো আমাদের অনাদি কালের আকুতি। তাই এই শস্যশ্যামলা বঙ্গদেশে, মা বাপের ঘরে আসেন তার ভরা সংসার নিয়ে, দিন চারেকের জন্য কৈলাসপতিকে ছেড়ে। তার আনন্দময়ী রূপ বিষাদ ক্লান্ত জীবনকে আনন্দে ভরে দিয়ে যায়। এখানে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, মানুষ তার ঈশ্বরকে আপন করে দেখতে শিখেছে। ভক্তিমার্গের এই দর্শন খুবই মনোরম। তার মন খারাপের বিদায় ভারাক্রান্ত করে তোলে মন। কাঠামো থেকে রঙ, মাটি, খড় খসে পড়লে, বেদীর ওপর জাগ-প্রদীপের আলো স্তিমিত হয়ে আসে। পুনরায় এক বছরের প্রতীক্ষা। বঙ্গদেশে দুর্গা পুজোর শুরু কিভাবে হয়েছিল সেই বিষয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। বাংলায় সাধারণত আমরা দেবীর যে মূর্তিটি দেখি, সেটি সপরিবার মূর্তি। এখানে দেবী সিংহবাহিনী ও অসুরদলনী। দেবীর ডান পাশে লক্ষ্মী ও গণেশ, বামে সরস্বতী ও কার্তিক। পুরাণ বা শাস্ত্র অনুযায়ী এরা কিন্তু কেউই দেবীর সহজাত সন্তান নন কিন্তু কি ভাবে যে সপরিবার মূর্তি কল্পনা করা হলো, সেটিই এক বিষ্ময়। অনেক মনে করেন বাংলায় দুর্গা পুজোর শুরু মধ্য যুগ থেকে। ইতিহাস অনুযায়ী ১৫০০ শতকের শেষার্ধে এই পুজো প্রথম শুরু হয়। সম্ভবত দিনাজপুরের জমিদার প্রথম এই পুজো করেন। এই প্রতিমার রূপ কিন্তু একেবারে অন্যরকম ছিল। এই মূর্তির চোখ গোলাকার ও উজ্জ্বল। দেবী এখানে সিংহ বাহিনী নন, তিনি সাদা বাঘের ওপরে সওয়ার, পাশে রয়েছে সবুজ সিংহ। আবার অন্য এক মত অনুযায়ী রাজশাহীর তাহেরপুর এলাকার জমিদার কংসনারায়ণ প্রথম শারদীয়া দুর্গা পূজা করেন। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গা পুজোর অনুষ্ঠান করেছিলেন। কলকাতায় সাবর্ন রায় চৌধুরী পরিবার ১৬১০ সালে প্রথম দুর্গা পুজো করেন। এই ভাবে ধীরে ধীরে এই পুজো গোটা বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে কিন্তু এটা পারিবারিক পুজোই ছিল। ধনী ব্যক্তিরা এই পুজোর আয়োজন করতেন। সাধারণ মানুষের যোগদান সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। সাধারনের বারোয়ারী পুজো আরো অনেক পরে শুরু হয়। ১৭৯০ সালে গুপ্তি পাড়ার ১২ জন ইয়ার বা বন্ধু মিলে একসাথে পুজোর আয়োজন করেন। বারো জন ইয়ার থেকেই বারোয়ারী কথাটি প্রচলিত হয়। ১৯১০ সালে কলকাতায় প্রথম বারোয়ারী পুজো হয় যা বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব নামে খ্যাত।

মা দুর্গা আমাদের কাছে একাধারে দেবী আবার অন্য দিকে নিজের কন্যারূপে বিরাজমান। তার একরূপ মাতৃমূর্তি অন্য রূপে তিনি অসুরবিনাশী। শুভ অশুভের চিরকালীন দ্বন্দ্বে তিনি পবিত্রতার প্রতীক। তিনি অশুভের বিনাশ করে শুভর সূচনা করেছিলেন। তিনি বরাভয়দায়িনী ও অসহায়ের আশ্রয়। দেবীপক্ষে তাঁর বোধন। বোধন অর্থে জাগরিত ও চেতন করে তোলা। তাই মাতৃরুপিনীর বোধন মন্ত্রে আমাদের বোধ জাগ্রত হোক ও মন মানবিক হোক এই কামনা রইল তাঁর শ্রী চরণে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।