ছোটদের জন্যে বড়দের লেখায় A.F.M Shebgatulla (পর্ব – ২)
সাবির সুবীর পর্ব পর্তুগিজ ঘাঁটি আবিষ্কার পর্ব – ২
(পূর্বের কিছু অংশ -আগেই বলেছি, সাবির সুবীর দুজনই এক স্কুলে, একই ক্লাসে পড়ে। নেমিনাথে মূর্তি আবিষ্কারের পর থেকে তাদের অনেক পরিচিতি বেড়ে গেছে । কলকাতার সংবাদপত্রের কিশোর কিশোরীদের জন্য একটা লেখা জমা দেওয়ার আবদার পেয়েছে। তার ই প্রস্তুতি নিচ্ছে।) গত অংশের পর।
ওদের মাথায় প্ল্যান এলো কোথায় পুরনো ম্যাপ পাওয়া যেতে পারে। গুগল ইমেজে চব্বিশ পরগনার কিছু পুরাতন ম্যাপ আছে। সে গুলো তারা প্রিন্ট আউট করে নিল। আর পুরাতন বই পত্তর থেকে জেরক্স করে নিল। সাবিরের মামার কাছে ল্যাপটপ আছে । দুই বিচ্ছু সাবির আর সুবীর , সাবিরের ফজল মামা মানে টিংকু মামার ল্যাপটপ থেকে উইকি ম্যাপিয়া, আর গুগুলের স্যাটেলাইট ম্যাপ খুলে আর পুরাতন প্রিন্ট আউট করা ম্যাপ সামনে রেখে বোঝার চেষ্টা করছে কোথায় নৌঘাঁটি থাকতে পারে।
বিচ্ছু দুটো দেখলো চব্বিশ পরগনার পুরাতন ম্যাপের মধ্যে রেনেল সাহেবের ম্যাপ যেমন পুরাতন তেমনই বিশ্বাস যোগ্য।কিন্তু কে এই রেনেল সাহেব, পৃথিবীতে সমুদ্র বিদ্যা চর্চায় এই জেমস রেনেল সাহেব এক বড় নাম আজও এক বড় মাপের স্কলার এই ব্রিটিশ সাহেব।তখন ব্রিটিশ শাসন সবে শুরু হবে তখনকার মানুষ এই রেনেল সাহেব। দেখলো রেনেল সাহেব তার ম্যাপে অনেক জায়গায় বৌদ্ধ প্যাগোডার অস্তিত্বের কথা বলে গেছেন! বিচ্ছু দুটো আরো একটা ম্যাপে দেখলো নদীর নাম বিদ্যাধরী। তার তীরে পর্তুগিজ ঘাঁটির কথা উল্লেখ রয়েছে। আর তার বিপরীত তীরে ব্রিটিশ উপনিবেশ। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধে মির জাফর ত চব্বিশ টা পরগনা ব্রিটিশদের উপহার দিয়েছিলেন। তবে পর্তুগিজ জাহাজ ঘাঁটি কোত্থেকে এলো? কিন্তু পর্তুগিজ নৌঘাঁটি যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতে ছিল এটাও সত্য।
সাবির সুবীর বললো দেখ মাথা কাজ করছে না। চল একটু বাদা থেকে ঘুরে আসি। সাউথ গড়িয়া গ্রামের কাছেই বড় পোল। সেখানে তারা এক দৃষ্টে খাল পাড়ে বসে তাকিয়ে আছে যেখানে আকাশ মিশেছে জমিতে। এখানে খাল পাড় ধরে গ্রামের গরু বাছুর যাতায়াত করে। জায়গাটা বেশ নির্জন। আসে পাশের পাড়ার লোকেরা এখানে সকালে আর বিকালে বেড়াতে আসে। দুই বিচ্ছু প্ল্যান করলো আগামী রবিবার ছুটির দিনে কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে সকালের টিফিন করেই বেরিয়ে পড়বে পর্তুগিজ জাহাজ ঘাঁটির উদ্দেশ্যে।
আজ রবিবার, সকাল ন টা। যথারীতি সুবীর সাইকেল নিয়ে সাউথ গড়িয়া থেকে সাবিরের বেনিয়াবৌ গ্রামে এসে হাজির। সাইকেলে ভালো করে পাম দিয়ে দুই বিচ্ছি বেরিয়ে পড়েছে। ওদের গ্রামেরই কাছে পর্তুগিজ নৌ ঘাঁটির উদ্দেশ্যে ওরা বেরিয়ে পরলো। সাইকেলে করে নাটাগাছি গ্রামে এলো। এই গ্রামে বেশ কিছু ঘর বাগদি সম্প্রদায়ের বাস। মূলত ভূমিহীন কৃষিজীবি। কিন্তু কারা এই বাগদি সম্প্রদায়ের লোক। এলো কোথা থেকে। এরা এসেছে সুদূর তামিলনাড়ু থেকে। চব্বিশ পরগনার ফেলে যাওয়া প্রাক্তন সুন্দরবনের আনাচে কানাচে এদের বাস।
নাটাগাছি গ্রামের মেন রাস্তা সোজা গিয়েছে সোনারপুর স্টেশনে। আর সোনারপুর মানে এখন কলকাতা।দুই বিচ্ছু এবার আড্ডিরাবাদের রাস্তা ধরলো।এটা খাল পাড়ের রাস্তা, রাস্তার ধারে ধরেই ক একটা খোলার চালের বাড়ি।পিছনেই বাদা, চৈত্র মাস। চৈতালি ধান এখনও তোলা হয়নি। আসে পাশেই মূলত বাগদি সম্প্রদায় আর তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। এখন যদিও অবস্থার অনেক বদল ঘটেছে। সাবিরের বাবার কাছে থেকে জানা যায়। এক কালে বেনেবৌ গ্রাম থেকে এখানে আসতে গেলে নৌকা চড়ে আসতে হতো। খাল পাড়ের রাস্তায় পড়ে বিশাল অমৃতা আবাসন।এটা একটা ফ্ল্যাট এর কমপ্লেক্স। এই আবাসন বছর দশেক আগের তৈরি। আশেপাশের তথা কথিত নিম্ন বর্ণের মানুষের এলাকায় এই আবাসন ই তথা কথিত উচ্চ বর্ণের মানুষের বাস! মানে বাগদিরা একবার উৎখাত হয়েছিলেন। আর একবার উঠখাত হবে টাকা আর প্রমোটর বাবুদের জন্য। প্রমোটর বাবুদের কিছু কিছু চ্যালা নিজেদের স্বজাতি ও বটে!
বিচ্ছুদুটি চলে এসেছে যেখানে খাল তিন দিকে প্রবাহিত হয়েছে সেখানে। এবার তারা সাইকেল থামিয়ে ম্যাপ টা বার করলো। প্রশ্ন, এবারে কোথায় যাবো। ম্যাপ দেখে বুঝতে পারলো খালের যে শাখা গড়িয়ার দিকে গেছে ওটা আদি গঙ্গা থেকে এসেছে। কিন্তু বইতে ওরা দেখেছিল যে এই খাল গিয়ে পড়েছে বিদ্যাধরী নদীতে। তার মানে আদি গঙ্গা থেকে আসা এই খাল ধরে তাদের এগোতে হবে। মানে ওদের এবারে রাস্তা পরিবর্তন করতে হবে। ডানদিকে যেতে হবে অন্য খাল বরাবর তবেই এই খাল গিয়ে পড়বে বিধ্যাধরীর তীরে সেই পর্তুগিজ জাহাজ ঘাঁটিতে।
সাবির সুবীর কে বললো। দেখ আমরা বইতে কিন্তু পড়েছি আদি গঙ্গা নামে কোনো নদী ছিল না। নদীটার নাম জাহ্নবী। গঙ্গার এই ধারাটা শুকিয়ে যাবার পর এর নাম হয়ে যায় আদি গঙ্গা। সুবীর বললো আচ্ছা ওয়ারেন হেস্টিংস এর আমলে ওই নদী সংস্কার হয়ে ছিল না? সাবির বললো হুম, হেস্টিংস এর আমলে ‘ মিস্টার টলি ‘ নামে এক সাহেব ব্রিটিশ রাজ কর্মচারী ওই আদি গঙ্গাকে সংস্কার করেন। আর ওই টলি সাহেবের নামেই টালি নালা, আর এই টালি নালার তীরে যে বাজার হাট বসত, সেখান থেকেই টলিগঞ্জ, সেখান থেকেই টলিউড!
সুবীর সাবির কে বললো তার মানে আমরা যে তিন দিকের প্রবাহের খাল থেকে নতুন রাস্তা ধরেছি ওটা কি সেই টালিনালা? সুবীর বললো আজ্ঞে হ্যাঁ বন্ধু। তুই আগে বলিস নি কেন?! আমি আরো ভালো করে দেখতাম । তোকে দেখতে কে বারন করেছে! সাবির সুবীর কে বললো।
সুবীরের ডাকে সাবির আবার থামলো। ম্যাপ দেখ তে। যেখানে ওরা তিন দিকে খাল যেতে দেখেছ। ওখানে আসলে চার দিকে খাল গিয়েছে। ওরা দেখলো টালি নালা এখানে প্রায় শুকিয়ে গেছে। তাই মরসুমি আনাজ চাষ করেছে গ্রামের লোকেরা খালের উপরেই। এমনিতে এই জায়গাটা বেশ নির্জন। আর একটু সাইকেল চালিয়ে দেখলো টালি নালার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। খাল টাও একটু একটু করে আসে পাশের জমির সাথে মিশে যাচ্ছে।
খালে র রাস্তা ছাড়িয়ে মেন রোড উঠে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোতে থাকে বিচ্ছু দুটি। এমন সময় বইতে পড়া আর দিব্যেন্দু কাকার কাছে থেকে শোনা সেই গ্রামে এসে পড়ে ওরা। এখানেই সেই পর্তুগিজ জাহাজ ঘাঁটি! ওরা খুঁজতে থাকে। এখানেই কি সেই ফেলে আসা সুন্দরবনের ভিতর লোকালয়ের থেকে বহু দূরে সেই জাহাজ ঘাঁটি। এই কি সেই ঘাঁটি যেখান থেকে ওরা আবার আসে পাশের গ্রামের মেয়েদের কে তুলে নিয়ে গিয়ে দুর দেশে বিক্রি করে দিত।। বা ক্রীতদাসী করে রাখতো!এই কি সেই পর্তুগিজ জাহাজ ঘাঁটি যেখানে থেকে বাঙালি যুবতীদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে পর্তুগিজদের সাথে বসবাস করতে করতে সেই বাঙালি যুবতী কখন যে নিজের স্বজাতি, ভাষা ভুলে একটু একটু করে গোয়ানিজ বা পর্তুগিজ হয়ে যেত! এই কি সেই ঘাঁটি যেখান থেকে পর্তুগিজরা ব্রিটিশদের কে জানান দিত। আমরাও আছি!!