T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় অনুরাধা দেব
by
·
Published
· Updated
হিয়ার মাঝে
“ম্যাডাম , এবার ধীরে ধীরে চোখ খুলুন।” নন্দিনী চোখ মেলে দেখলো সে হাসপাতালে শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে বেশকিছু লোকজন কিন্তু কাউকে ই সে চিনতে পারছে না। শুধু তার মাকে চিনতে পারলো।একজন ভদ্রলোক ও একটি ছোট বাচ্চা তার বেডের একদম পাশে দাঁড়িয়ে। সে তাকাতেই ভদ্রলোক তার হাত চেপে ধরলেন। নন্দিনী বিরক্ত হলো। ডাক্তার
বাবু ইশারায় জয়ন্তকে বাইরে ডাকলেন। “মিস্টার রায় ,মেনেনজাইটিস টা ওনার ব্রেইন কে সামান্য ড্যামেজ করে দিয়েছে। কিছু মেমোরি মুছে গেছে।ছোটবেলার কথা সব মনে থাকবে কিন্তু রিসেন্ট পাস্ট এর কথা মনে থাকবে না। তবে চিন্তার কিছু নেই, ভয় পাবেন না। ধীরে ধীরে সব স্মৃতি ই ফিরে আসবে। একটা যোগসূত্র যদি থাকে, যেটা প্রথম থেকে এখনো পর্যন্ত ওনার সর্বক্ষনের সঙ্গী তাহলে সেটা কে বারবার ওনার সামনে আনতে হবে। ”
“রবীন্দ্রসংগীত!” জয়ন্ত অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে।এতক্ষণ ও যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।
” ডাক্তার বাবু , রবীন্দ্রসংগীত নন্দিনীর ধ্যান-জ্ঞান সব। ” ডাক্তার বাবু খুশী হয়ে বললেন , ” বাহ্ ! তাহলে তো সমস্যা অনেকাংশে মিটে গেল। ওনার ঘরে যতটা সম্ভব ,লো ভ্যলিয়ুমে গান চালিয়ে রাখবেন, সেটাই ওনার লস্ট মেমোরি রিভাইভ করতে হেল্প করবে।” জয়ন্ত ডক্টর বাসুর হাতটা ধরে বললো , ” আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ! আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবো না।”
দিন সাতেকের মধ্যে নন্দিনী বাড়ি ফিরে আসলো। দোতলার কোণার ঘরে থাকার ব্যবস্থা। নন্দিনীর মা শান্তা দেবী রয়েছেন মেয়ের সাথে। নন্দিনী র বাবা ও দাদা ,দুজনের ই মত ,শান্তা কয়েকদিন থাকুক বিশেষতঃ মেয়ে যখন মা ছাড়া কাউকে চিনছে না। নাতির দায়িত্ব বর্তমানে ঠাকুমার উপর। সবার ই চোখে মুখে চিন্তা র ছাপ। ডাক্তার এর কথামতো ,নন্দিনীর ঘরে মাঝে মাঝেই গান চলে। কোনো সময় সে চোখ বুজে গান শোনে আবার কোনো কোনো সময় গুনগুন করে গান গায়।
নন্দিনী জানে এটা বাবার বন্ধুর বাড়ি। খোলামেলা বলে ওকে এখানে আনা হয়েছে। বাপের বাড়ি উত্তর কলকাতায় , ঘিঞ্জি এলাকা।
” চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে”-হঠাৎ শান্তা খেয়াল করলেন নন্দিনীর চোখে জল! “মণি , কাঁদছিস কেন ?” “কই না তো ! মা , এই গানটা গেয়েই তো মেডেল পেয়েছিলাম, তাই না?” শান্তা সায় দেন। খুব ধীরে ধীরে দিনগুলো কাটতে থাকে। গান বাজতে থাকে আপনমনে। রোজ একবার করে সবাই ঘুরে যায়।বেশিরভাগ সময় নন্দিনী আধোঘুমে থাকে।তার সমস্ত চেতনা জুড়ে দিবারাত্র রবিঠাকুরের বাণী ছড়িয়ে পড়ে।দেখতে দেখতে ছ’মাস কেটে যায়।
” আমার পরান যাহা চায় ,তুমি তাই , তুমি তাই গো !” নন্দিনী ভাবে এই গান টা কোথায় যেন গেয়েছিলাম । অনেক লোকজন ,সানাই ,রজনীগন্ধা ,হাসাহাসি ,উজ্জল আলো – বিদ্যুৎ চমকের মতো ওর মাথায় যেন একটা ঝিলিক খেলে গেল। অরুনিমার বিয়েতে, বাসরঘরে!
সেই দিনই তো জয়ন্ত এর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। “জয়ন্ত !জয়ন্ত ” করে চীৎকার করে ওঠে সে। জয়ন্ত পাশের ঘরেই ছিল , সে ও দৌড়ে আসে।কোনো কথা না বলে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে নন্দিনী। চোখ বেয়ে অঝোর জলের ধারা। জয়ন্ত ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায় ,পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। এরপর বেশ কয়েকটা দিন গেল।
” আছে দুঃখ , আছে মৃত্যু!” নিজের অজান্তেই নন্দিনীর হাতটা পেটের কাছে চলে যায়। কি ব্যথা ,কি যন্ত্রণা! এর ভেতরে ই তো তাদের প্রথম সন্তান… । এরপরই তো নন্দিনী অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মনে পড়েছে ! ডাক্তার এর পরামর্শে ওরা পুরী বেড়াতে যায় । সমুদ্রের সামনে গিয়ে নন্দিনী ও যেন ছেলেমানুষ হয়ে যায়। “চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে , উছলে পড়ে আলো!” সেই বাঁধভাঙা জ্যোৎস্না রাতেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উত্তাল হয়েছিল দুজনে। আর তারপরই শুভম এলো তাদের জীবনে। “শুভম”
শুভমকে সে এতদিন ভুলে ছিল!
” মা ,মা …ও মা ! ” নন্দিনী চিৎকার করতে থাকে। শান্তা দেবী নীচতলা থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে আসেন।” কি হলো কি? এত জোরে চীৎকার করলে শরীর খারাপ হবে যে!”
” মা! শুভম কোথায়?আমি এতদিন ওকে ভুলে কিভাবে ছিলাম ? আমি ওকে চিনতে পারিনি ! ও কত কষ্টই না পেয়েছে?” শান্তা মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন , ” তোর মনে পড়েছে? এখন তো ও ইস্কুলে। একটু বাদেই এসে পড়বে।” নন্দিনী তাও অবুঝের মত কাঁদতে থাকে। শাশুড়ি মা ও চলে আসেন ততক্ষণে। ” বৌমা , এ তো তোমার দোষ নয় । তোমার অসুখ সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। আজ তোমার আরাধ্য দেবতা ,তোমার রবি ঠাকুর আবার সব স্মৃতি ফিরিয়ে দিলেন।”
স্কুল থেকে ফিরে ,পাঁচ বছরের শুভম দেখে ,মা
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখামাত্রই জড়িয়ে ধরে ,আদরে আদরে অস্থির করে তোলে। সবার সামনে এমন আদর খেতে একটু লজ্জা করলে ও শুভম বুঝতে পারে মা ভালো হয়ে গেছে।