ধারাবাহিক গল্পে আলিনূর চৌধুরী (পর্ব – ৭)

তুলির অন্তর্ধান
বিস্তৃত বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদে তোলপার করছে দুরন্ত ঘোলাজল। উজান ভেঙ্গে নিয়া আসে পলির পাহাড় এবং ভাটি এলাকায় পলিতে জেগে উঠে নতুন নতুন চর এবং উর্বর করে আবাদি জমি। একদিকে যেমন জেগে উঠে বিস্তৃর্ণ চর অপর দিকে আবাদি ও ভিটাবাড়ি ভেঙে সয়লাব করে দেয়। নিঃস্ব হয়ে পড়ে সর্বগ্রাসি নদীর তান্ডবে অগনিত মানুষ। এবারের বানের জল ফেঁপে ফুলে উঠেছে অল্পদিনেই, ফসলি মাঠ পানিতে কানায় কানায় ভরে গেছে। চারিদিকে তাকালে সে জল সূর্যের কিরণে চকচক করে,প্রতিসরণ ঠিকরে আসে চোখে। মাজা পানিতে পাটগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। আমন ধানের লকলকে সবুজ কান্ড, পাতা বাতাসে দোল খায়। অরণ্যের ন্যায় এই আমন খেত হলো মাছের আশ্রয় স্থল,অভয়ারণ্য।
নজরে ভাসে শুধুই জলের দিগন্ত,এর যেনো কোন শেষ নেই। কবে নামবে এই বানের জল কে জানে। তাড়াতাড়ি নামলেই ভালো নচেৎ ভোগান্তি আছে। আউশ ধান এবার ঠিকমত সকলে কাঁটতে পারেনি চাষিরা । পাঁকার আগেই বানের জলে তলিয়ে গেলো।যারা আগোরি বপন করেছিলো তাদেরটা পেঁকে যায়,তারাই কাঁটতে সক্ষম হয়েছে। বেশীর ভাগ চাষির ভরাডুবি হয়।
এ সময়ে কাম কাজ নাই বললেই চলে। মাছ
ধরা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। তাও এ কাজ অনেকে করে সখের বশে। অনেকে আবার পেশা হিসেবে মাছ ধরে। সারারাত জেগে, নদীর বুকে, খালের পাড়ে, মাছ ধরে থাকে। বড়সি,দামুন, দুয়াইর, দিয়ার, চালা, দড়ি জাল,ঠেঁলা জালি, ফান্দি প্রভৃতি দিয়ে মাছ ধরে থাকে তারা।
হাছেন শেখের নেশা হলো – বড় দিয়ার, ফান্দি জাল ও ঠেলা জালি এ সবে মাছ ধরা। যখন নতুন বানের পানির স্রোত ঢেলে পড়ে তখন পানিতে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। নানা জাতের দেশি মাছ, ভাগনা, টেপসি,বাইটকা , কচা, রুই কাতল টেংরা পুটি শোল টাকি বাইলা বাইম কালবাউশ চান্দা,চিংড়ি এসব প্রচুর ধরা পড়ে। সেদিন হাছেন শেখ ঠেলা জাল দিয়া ভাগনা মাছ ধরে কয়েক খালোই। এত মাছ তো আর খেয়ে শেষ করা যায় না। তাই রোদে শুকিয়ে শুটকী করে।সে শুটকি সারা বছর খায়।
বাইরচরে যখন নৌকা এলো, শান্তিনগরের মাথা উঁকি দিলো। স্রোতের বেগ এখানে অনেক কম। নৌকা পালের হাওয়ায় তরতর করে এগিয়ে চলছে। আকাশে মেঘের গর্জন হলেও শেষ মেষ বৃষ্টি আর হলো না। মেঘও কেটে গেলো।সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে, আকাশ গাঙে জমাটবদ্ধ রক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে। সূর্য রশ্মির লাল আভা পানিতে চিকচিক করছে।
দেখতে দেখতে নৌকা গ্রামের উত্তর মাথায় পৌছলো। হাছেন বললো- কাসেম, নাও সরকার বাড়ির জুলি দিয়া ডুকাইয়া দিস। মহিষ বাড়ির ঘাটে চাপাইয়া দিবি, সবার সুবিধা হবো, বুঝলি?
হ। ঠিক আছে। ঐহানেই চাপাইয়া দিমুনি।
নৌকা যখন মহিষ বাড়ির ঘাটে ভিড়লো, তখন কাল সন্ধ্যা।আবছা আবছা দেখা যায়। এটা মহিষ বাড়ি বলেই সকলে চিনে। নামের হেতু হলো- এটা জয়েন সেকের বাড়ি তার প্রায় এক কুড়ি মহিষ পালে। মহিষ পালন তার প্রধান আয়ের উৎস। মহিষের জন্যই সকলে মহিষ বাড়ি বলে চিনে, জানে। বাড়ি ডুকলো,ডুকেই তুলিকে ডাক দিলো- তুলি মা, তুই কনে?
কাছে আয় তো মা। কোনো সাড়া নাই।
জয়গুন বললো- তুলি তো ঘরে নাই। হাজিবাড়ি গেছে।
ক্যা! হাজিবাড়ি ক্যা?
ঐ বাড়ি কামলি মায়া জহুরার ভুতে ধরছে। ফকির আইছে ভুত ছাড়াইতে, তাই দেখতে গেছে।
কও কি! হন্ধা না অইতেই ভুত!
কোন ফকির আইছে?
আব্দুল হাই মুন্সি।
ও! আচ্ছা। ব্যাগ নেও। আমারে এক বন্ধি পানি দেও। হাত পা ধুইয়া নেই।
জয়গুন কাশার বন্ধিতে পানি ভইরা দিলো। হাছেন হাতমুখ ধুয়ে – বললো – হাজিবাড়ি গেলাম।
তুমিও ভুত দেখতে যাও!
হ।যাই। দেখি কি কান্ড।
হাজিবাড়ি গিয়ে যা দেখলো। জহুরার দুই হাত গামছা দিয়ে পিছনে বাঁধা। ফকিরের সামনে হাটু গেড়ে বসা। ফকির ওর সামনে ঝাড়ু নিয়ে টুলে বসে আছে। তন্ত্রমন্ত্র পাঠ করছে আর ঝাড়ু দিয়ে ঝারছে। জওয়াব ছয়াল করছে। তোর নাম কি, কোথায় থাকস, কেনো ওকে ধরলি? ছাড়বি কি না বল,না ছাড়লে বোতলে বন্ধি করুম ইত্যাদি।
জহুরার জবানিতে ভুত বলছে আমি ওকে ছাড়বো না।
ফকির রেগে মেগে আগুন। সোজা কথায় ছাড়বি না! আচ্ছা দাঁড়া তোকে কেমনে ছাড়াতে হয় আমার ভালো করেই জানা আছে। এই বলেই জহুরার মাথাসহ চোখ মুখ নাক আরেকটা গামছা দিয়ে বেঁধে ফেললো। তারপর পানি ঢালা চললো,বিরতিহীন অনেক ক্ষণ। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম তবু স্বীকার করছে না ছেড়ে যাবার। অবশেষে বালতি ভর্তি পানিতে মাথা ডুবিয়ে ধরে রাখলো কিছু ক্ষণ, এক বারেই কাজ হলো। তখন স্বীকার করলো ভুতে, হ। ছাইড়া যামু।
ফকিরে জিগায়, আরো কোনো দিন ওকে ধরবি?
না। ধরুম না।
এই এলাকা ছাইড়া যাবি। কোনো দিন ডুকবি না।
হ। ডুকমুনা। ভুতের কথা গ্যানা গ্যানা কথা।
এখনি ছাড়, যাওয়ার সময় পানি ভরতি এই বালতির আঙটা কাঁমড় দিয়ে তুলে নিয়ে যাবি।
বলতেই জহুরা বালতির আঙটা কাঁমড়িয়ে তুলে নিয়ে চললো। কিছুদূর যেতেই উঠানে অজ্ঞান হয়ে ধপাস করে পড়ে গেলো।
ফকির সস্তি পেলো। বললো- ভুত ছেড়ে গেছে। ওকে নিয়ে যাও, ঘরে শুয়াইয়া দেও। একটু বিশ্রাম নিক। সব ঠিক হয়া যাইবো।
ধরাধরি করে নিয়ে গেলো মমিনার ঘরে বারান্দায়।
হাছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। মেয়েটার উপর দিয়ে কত ধকল গেলো। সেটা ভুতের না জহুরার বুঝতে বাকী রইলো না।
চলবে