কুউউউউ… কুউউউউউ…
দেবদারু গাছের ঢেউ খেলানো ঘন সবুজ পাতার ভেতর থেকে ভেসে এলো কোকিলের মন কেমন করা ডাক।
চারিদিকে এখন মৃত্যুর মিছিল, করোনা ভাইরাসের করাল ছায়া গ্রাস করেছে গোটা পৃথিবীকে; তবুও প্রকৃতির নিয়মে এসেছে বসন্ত। আর তাই কোকিলটা এখনও মাঝে মাঝেই অশান্তভাবে ডেকে উঠছে। কাকে ডাকছে ও? ওর সঙ্গীকে? কি বলতে চাইছে ডেকে ডেকে? এই অসময়েও আমার ভালোবাসা চাই, তোমাকে কাছে চাই। না কি ও জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্বের কথা? বলতে চাইছে আমি এখনও বেঁচে আছি?
দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস চলে গিয়েছে অনেকদিন তাই আনমনে একটা ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ বোলাচ্ছিল দেবাঙ্গী। মেয়েদের ম্যাগাজিন; কিভাবে দশ দিনে রোগা হওয়া যায়, মুখে বলিরেখার আগমন আটকানো যায়, চুল পাকা ঠেকানো যায় তার নানারকম ঘরোয়া টোটকা। কোকিলের ডাক শুনে দেবাঙ্গী বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে বাইরের দিকে তাকালো। জানালার পাশের লম্বা দেবদারু গাছটার ডালপালার ভেতর থেকে ডেকে উঠেছে বসন্তের দূত। হাতের ম্যাগাজিনটাকে খাটের ওপর রেখে, জানালার কাছে গিয়ে কোকিলটাকে দেখার চেষ্টা করলো দেবাঙ্গী।
প্রথমে চীনে ধ্বংসসলীলা চালিয়ে তারপর এখন ধীরে ধীরে সারাবিশ্বে নিজের প্রাণঘাতী ক্ষমতার প্রদর্শন করছে করোনা ভাইরাস। ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম নয়। এখন তো করোনা ভাইরাসের প্রকোপ একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে; সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে একটা অজানা আতঙ্ক। অন্যোন্যপায় হয়ে প্রধানমন্ত্রী আজ সকাল সাতটা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত সারা দেশ জুড়ে চৌদ্দ ঘণ্টার জনতা কারফিউ জারি করেছেন। দেশের অন্যান্য প্রান্তের থেকে মহারাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা একটু বেশি, বিশেষ করে এই পুনা শহরে। তাই গত বুধবার থেকে এখানে শুরু হয়েছে লকডাউন। রাস্তাঘাটে লোকজন কম, বাস-অটো, দুচাকা-চারচাকা এ সবের সংখ্যাও গিয়েছে বেশ কমে। নিতান্ত দরকারি কাজ ছাড়া রাস্তায় নামলে পড়তে হচ্ছে পুলিশি জেরার মুখে। বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছুই মিলছে না বাজারে। এর মধ্যেও ভাইরাসের ভয়কে দূরে সরিয়ে চাকরির খাতিরে বাইরে বের হতে হচ্ছে বেশ কিছু মানুষকে। দেবাঙ্গী তাদের মধ্যে একজন। ও কাজ করে “মহা বিতরণ”, মানে মহারাষ্ট্র রাজ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বিভাগে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মতোই ইলেকট্রিসিটিও একটি অপরিহার্য বস্তু, তাই ওদের অফিস এখনও খোলা। আর তাই এখনও রোজকার মতোই সোয়া ন’টায় সাজগোজ করে নিজের গোলাপী স্কুটারটাতে স্টার্ট দেয় দেবাঙ্গী।
আজ সকাল থেকেই জনতা কারফিউ জারি হয়েছিল তাই আজ মালি আসেনি। কোনো গাছে জল পড়েনি, ছোট ছোট গাছগুলো জলের অভাবে শুকিয়ে এসেছে কিন্তু হালকা সবুজ ফুলে ভরা দেবদারু গাছটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে; প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা তিলমাত্র স্পর্ষ করতে পারেনি গাছটাকে। অনেক চেষ্টা করেও কোকিলটাকে কোথাও দেখতে পেল না দেবাঙ্গী। দেবদারু গাছের ঘন সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে পাখিটা, তাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না, শুধু শোনা যাচ্ছে ওর মন কেমন করা ডাক। পাখিটা এই অসময়েও জানান দিচ্ছে এসে গিয়েছে প্রেমের ঋতু, এসে গিয়েছে বসন্ত।
একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা একবার দেখে নিল দেবাঙ্গী। পাঁচটা বাজতে এখনও পনেরো মিনিট বাকি আছে। এবার একটু সাজগোজ করে বারান্দায় বের হতে হবে। অন্যদিন হলে সাজগোজ করার দরকার পড়ত না, তবে আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। দেবাঙ্গীর মতোই এই অসময়েও যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করছে ডাক্তার, নার্স, হসপিটালের স্টাফ, সাফাইকর্মী, পুলিশকর্মী, বাস ড্রাইভার, অটোরিক্সা চালক, সাংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের মতো বেশ কিছু মানুষ। তাই প্রধানমন্ত্রী জনতা কারফিউ-র পাশাপাশি দেশের মানুষের কাছে আরও একটি আবেদন জানিয়েছেন, যারা প্রাণের মায়া না করে এখনও কাজ করে চলেছে তাদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য বিকেলবেলা ঠিক পাঁচটার সময় পাঁচ মিনিট নিজের নিজের দরজায়, জানালায় দাঁড়িয়ে একযোগে হাততালি দেওয়ার। তাই আজ সবাই বেরিয়ে পড়বে নিজেদের বাসস্থানের খোলা জায়গায়, হয় ছাদে নয়তো বারান্দায়; যাদের খোলা জায়গা নেই তারা হয় জানালা নয়তো দরজার সামনে এসে দাঁড়াবে। ঠিক বিকেল পাঁচটায় শুরু হবে হাততালি দেওয়া। অনেকে অবশ্য হাততালি দেওয়ার বদলে শাঁখ বাজানো, কাঁসর, ঘণ্টা বাজানো, চামচ দিয়ে থালা-বাটি বাজানোর প্ল্যান করেছে। তবে রাজগৃহ হাউসিং সোসাইটির কর্মকর্তারা ঠিক করেছেন এখানে শুধু হাততালি দেওয়া হবে। রেসিডেন্টদের সবাইকে একই ছন্দে কেমন করে হাততালি দিতে হবে তার ডেমো দেখিয়ে হাউসিং সোসাইটির হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটা মেসেজও এসেছে গতকাল।
দেবাঙ্গীর চেনা-পরিচিতদের অনেকেই আবার এই আওয়াজ তোলার ব্যাপারটার একটা অন্য মানে বার করেছে। তারা মনে করছে এতে করোনা ভাইরাস দূর হবে, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তারা ইন্টারনেট ঘেঁটে খুঁজে বের করে এনেছে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও। দেবাঙ্গীর খুব হাস্যকর লেগেছিল ওদের কথাগুলো। করোনা ভাইরাস কি বুনো হাতি, যে ঝমাঝম আওয়াজ শুনে পালিয়ে যাবে।
নিজের অজান্তেই আবার ঘড়ির দিকে চোখ চলে গেল দেবাঙ্গীর। ও আর দেরী না করে আধ পুরোনো, রংচটা, পাতলা ম্যাক্সিটার ওপর বড় বড় ফুলছাপ দেওয়া সিল্কের হাউজকোটটা চাপিয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চলে এল। কোনো কারন ছাড়াই বার বার খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নিজেকে। পাতলা গোলাপি ঠোঁট, গভীর দিঘির মতো কালো টানা টানা চোখ, টিকালো নাক সবকিছু সেই আগের মতই আছে, শুধু কিশোরীবেলার রোগা চেহারাটা এখন নয়নশোভন মেদের ভারে দোহারা হয়েছে। তাতে ওর সৌন্দর্য বেড়েছে বই কমেনি। নিজেকে আর একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা গদিআঁটা বেতের মোড়াটাতে বসে পড়ল দেবাঙ্গী, ফর্সা নরম হাত দিয়ে তুলে নিল টেবিলের ওপর রাখা মোটা দাঁতের চিরুনিটা। কোমর অবধি লম্বা ঘন কালো ঢেউ খেলানো চুলগুলোকে আঁচড়াতে গিয়ে আজ আবার ওর চোখে পড়ল সিঁথির দুপাশে দু’একটা পাকা চুল। এতো তাড়াতাড়ি বুড়ি হয়ে গেল ও; এই সাড়ে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই। অজান্তেই ওর বুক ভেদ করে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। ও তাড়াতাড়ি চুল আঁচড়ে একটা ব্যাকক্লিপ লাগিয়ে নিল। ধবধবে ফর্সা গালে ট্যালকম পাউডারের পাফটা বুলিয়ে বুলিয়ে ঢেকে দিতে চাইল মেচেদার গাঢ় বাদামী ছোট ছোট দাগগুলোকে।
সাজগোজ শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল দেবাঙ্গী। এবার পক্ষাঘাতগ্রস্ত মাকে একটু সাজিয়েগুজিয়ে দিতে হবে। কি জানি এখন কেমন আছে মায়ের মেজাজ, সাজগোজ করতে বললেই হয়তো একগাদা কথা শুনিয়ে দেবে। বাবা-মা কোনোদিনই তেমন ভালোবাসেনি দেবাঙ্গীকে। বাবা-মায়ের যত ভালোবাসা, যত আদর সব ছিল ওর দাদা জিগনেশের জন্য। যতদিন না জিগনেশ নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেল ততদিন দেবাঙ্গী ছিল এই পরিবারের এক অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরপায়ে মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল দেবাঙ্গী।