গদ্যানুশীলনে অরুণিমা চ্যাটার্জী

তারার দেশ থেকে মৃণালিনীর চিঠি

পরম পূজনীয় রবিবাবু,

তারার দেশে ভালো আছি। আমার বেলা, রাণু, সমীন্দ্র আমায় ঘিরে এই অনন্ত আকাশ বাগিচায় ফুল হয়ে ফুটে আছে। তোমার গাজীপুরের সৌখিন গোলাপ বাগিচায় ফুটে ওঠা গোলাপগুলোর জন্য এখন বড় কষ্ট হয়। ফুল হয়ে ফুটে, ঝরে যাওয়ার সময়টুকুর মধ্যে কত অব্যক্ত যন্ত্রণা, ছলনা প্রবঞ্চনা পাপড়িগুলো বাতাসে
ফিসফিস করে বলে যেত ! আমি টের পেতাম।
হে চঞ্চল কবি ! সুদূরের পিয়াসী, অনুভূতির কারবারি, তোমার কবিতার জন্ম হতো সেখান থেকে। ওরা যে বলি প্রদত্ত। মহৎ কাজে তোমার বড় আমি থাকতো নেহাৎই উদাসীন। আর আমি ব্যস্ত থাকতাম তোমার ছোট আমিকে নিয়ে। আমরা তারা ফুলেরা ঝরে পড়ি না। শঙ্খ ধ্বনি, কাঁসর ঘণ্টা মাঙ্গলিকের স্মৃতি বহন করে ঠান্ডা নরম আলোয় ভেসে যাই ! মিলিয়ে যাই চরাচরে। আমি মৃণালিনী। তোমার স্ত্রী, তোমার সহধর্মিনী হয়ে ওঠার স্পর্ধা কোনদিন দেখাতে পারিনি।

তোমাকে নিয়ে চর্চা, গবেষণা চলছে তো চলবেই। আমার কি মনে হয় জানো ? যতদিন এই ছোট্ট উপগ্রহটি এক বিস্ফোরক উল্কাপাতে একটি অস্তিত্বহীন ছাইয়ের স্তূপ না হয়ে উঠছে, তুমি থাকবে মানুষের ঘুমন্ত চেতনায়। আর আমি ! আমি থাকবো তোমার বিশ্বস্ত, অসম্পূর্ণ মানসী হয়ে, নেপথ্যে মানুষের মুখরোচক কৌতূহলে। তোমার আমার স্বর্গীয় প্রেম ! যাকে তুমি বলো অমরাবতীর অবগাহন তা আমাদের হয়নি। আমার ছোট্ট মায়া আঁচলে তোমাদের শিলাইদহের জমিদারির গরীব প্রজারা যে সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিল, আমার সাধ্য কি ! সেই আঁচলে তোমাকে বাঁধি। আর সেই চেষ্টাই বা করি কেন ? যার জাগ্রত চেতনায় প্রকৃতির পূর্ণাঙ্গ ব্যবচ্ছেদ, অথবা আত্মদর্শন ভাষা খুঁজে পায় সোনার তরীর ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধতাকে অসীমের হাতছানিতে ভাসিয়ে দেওয়ার ! তাকে সসীমতার অঙ্গনে বাঁধার চেষ্টা করা কি আমার পক্ষে শোভন হতো ?

তবে গাজীপুরের নিভৃত যাপনে যে আঠাশটি কবিতা তুমি রচনা করেছিলে, তোমার মানসী কাব্যগ্রন্থে, লোকমুখে শুনতে পাই, সেই খন্ডিত, অসম্পূর্ণ মানসী যে আমিই ! বিশ্বকবির খেয়াল ! তবে একদমই যে চেষ্টা করিনি, এমনটাও নয়। সেবার শিলাইদহে ! অসহ্য গরম পড়েছিল সেদিন। ঝাঁঝা রোদে মাঠ ঘাট পুড়ছিল, দৈনন্দিন তালিকাভুক্ত ছোট্ট ভাত ঘুমটায় তোমাকে একদম শিশুর মত লাগছিল। নিদ্রার সময় মানুষকে বড় পবিত্র মনে হয়, আর তুমি তো দিব্য পুরুষ ! রূপে, বর্ণে, মেধায় চেতনায় পবিত্র আদিপুরুষ। পাখার বাতাস করতে করতে মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম তোমায়। শ্বেত শুভ্র ললাটে বিন্দু বিন্দু স্বেদ। হঠাৎই এক অনৈসর্গিক অনুভূতির শিহরণ দামাল ঝড়ের মতো আমার ছোট আমিটাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল ! এ এক অন্য বিপুল মহৎ আমি। যেখানে মৃণালিনী জোড়াসাঁকোর প্রাসাদ বাড়ির বৃহৎ যৌথ পরিবারের বধূ নয়, এক অখ্যাত ভীরু কর্মচারীর আত্মজা নয়, বিশ্বকবির সহধর্মিনী নয়, প্রয়াতা প্রতিদ্বন্দ্বী নতুন বৌঠানের জা নয় ! আমিই বিশ্ব মানবী। আমি ভূমি কন্যা। আমি বারবার ফিরে আসি, দয়িতের জন্য। তির তির করে কাঁপছিল আমার জামরঙা ওষ্ঠ। জননী হয়েছি বারবার, প্রণয়িনী হতে পারিনি। একবার কি এই শ্যামলা বরণ, জামরঙা ওষ্ঠ চন্ডীদাসের অংশুমালা হয়ে উঠতে পারে না !

তুমি পাশ ফিরে শুলে। হঠাৎ গুড় গুড় করে মেঘ ডেকে উঠলো। আমার ভেতর ঘরে ঝড়, বাইরে প্রলয়ঙ্করী কালবৈশাখী তাণ্ডব। আমার ভেতর ঘরের প্রাকার বালির বাঁধের মতো চুরচুর করে ভেঙে পড়ল। ছুট ছুট ছুট। আমার বিশ্রস্ত আঁচল, খোলা চুল ! বাহ্য জ্ঞান নেই। দূরের
ঘাসবন আর ময়না পাড়ার মাঠ সব মিলেমিশে একাকার। ব্রজের গোকুলও ছিল অদূরে। ঘোমটা খসে গেছিল, আমার কাজল দীঘল চোখের প্রশংসা শৈশবে শুনেছিলাম। সেই চোখ দিয়েই কতদিন পর আমি আকাশ পানে চাইলাম। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা আমার তৃষ্ণার্ত চাতক হৃদয় শুষে নিচ্ছিল ফুটিফাটা চৌচির মাটির মতোই। নিখুঁত মঞ্চসজ্জা। মৃণালিনী আর কৃষ্ণকলি, আজ মিলিমিশে একাকার ! হঠাৎই জানলার ওপার থেকে তোমার মন্দ্র গুরুগম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো।
” কি করছো মৃণাল ! এমন ছেলেমানুষী করলে চলে ? নিউমোনিয়া হলে কি বিপদ হবে বলো তো !”

কোথায় যেন শুনেছিলাম ,মেয়েমানুষের বুদ্ধি নাকি হাঁটুর নিচে থাকে ! কিন্তু অনুভূতি ! আবেগ ! সেগুলো তো আমাদের সহজাত দোষ।
তোমার সাথে ঘটনাচক্রে বিয়ে হয়ে গেল আমার। আদব কায়দা, নিয়ম কানুন, সাহেবীআনা, অত অত লোক ! প্রাসাদ বাড়ি। এ এক অন্য পৃথিবী। আমার চেনা বৃত্তের একদম বাইরে। কি একটা কানাঘুষো চলতো তখন অন্দরমহলে। আমি তখন বালিকা বধূ। বোঝার মতো পরিণত বয়েস আমার হয়নি। তবু তোমার মার খাস ঝি, নামটা এখন আর ঠিক মনে নেই। খুব যত্ন করে তোমার আর দিদির মানে তোমার নতুন বৌঠানের কথাটা আমার কানে তুলেছিল। আমার কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে, তার স্বগতোক্তি ছিল, “দুগ্গা দুগ্গা ! এ ছুঁড়ি তো মাটির ঢেলা, কিছুই বোঝে না ! শোনো মেয়ে, সে কিন্তু খুব সহজ মানুষ নয়, অনেক লেখাপড়া, ভালো করে বরকে আঁচলের গিঁট দিয়ে বেঁধে রেখো।”
আমি ফিক করে হেসে ফেলেছিলাম। যাকে নিজের করে পেলামই না, তার মনের হদিস আমি তলব করি কেন ? তারপর একদিন ঘুমের মধ্যে জড়ানো গলায় তুমি কি সব বিড়বিড় করছিলে। কানের কাছে মুখ এনে, অস্পষ্ট জড়ানো গলায় শুনলাম, তুমি নন্দনকানন নন্দনকানন বলছো। মেয়ে মানুষের শৈশব কৈশোর থাকতে নেই গো ! সে জন্মেই মেয়ে মানুষ। তাই ওই মূর্খ বালিকা বধূ বুঝতে পেরেছিল, তোমাদের মানে তোমার আর নতুন বৌঠানের এই প্রাসাদ বাড়ির ছাদ বাগানটাই হলো তোমাদের নন্দনকানন।

একদিন কি হয়েছিল জানো ? নিশুতি রাত! চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। গোটা বাড়িটাই পরম সুপ্তিতে। তুমি ঘুমিয়ে আছো, নিশ্চিন্তে। তোমার তপ্ত কাঞ্চনবর্ণে জানলা দিয়ে আসা জ্যোৎস্না যেন পিছলে যাচ্ছে। তোমার একটা বাহু এসে পড়ল আমার বুকে। নেহাৎই অজ্ঞান ঘুমের ঘোরে। আমি কেঁপে উঠলাম। খুব ইচ্ছা হলো, একবার তোমাদের নন্দনকাননটা এই জ্যোৎস্নাস্নাত শুভক্ষণে দেখে আসার। হাতটা সরিয়ে আঁচল গুছিয়ে দোর খুললাম। পা টিপে টিপে উঠে গেলাম সেই মস্ত ছাদে। কোথায় নন্দনকানন ! গাছগুলো ভালোবাসা আর যত্নের অভাবে শুকিয়ে মৃতপ্রায়। ফুল নেই, শুকনো ডালপালাগুলো নির্বাক নিস্পন্দ। ওরা যেন কারোর প্রতীক্ষায়। ফুটফুটে জ্যোৎস্নাও যেন বড় ম্লান ম্রিয়মাণ। হঠাৎই চোখে পড়ল আবছা আলো আঁধারিতে এক নারী মূর্তি। পাঁচিলের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ পানে চেয়ে অনন্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে। তার মুখ ভালো করে দেখা যায় না। আমি তো কবিতা লিখতে পারি না ! তবু মনে হলো ইলোরার ভাস্কর্য বুঝি প্রাণের স্পন্দন পেয়েছে। বাতাসের অস্ফুট মর্মর ধ্বনিতে তাঁর দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে
গেল আমার অনাবৃত হৃদয়। বলোতো বালিকা বধূর অনুভূতি না থাকলে টের পেতাম এসব ? যেমন নিঃশব্দে এসেছিলাম তেমনই নিঃশব্দে ফিরে এলাম উনি টের পাওয়ার আগেই। হায়রে নিয়তি ! আমি করবো ওনাকে ঈর্ষা ? প্রবঞ্চনা যন্ত্রণা, এক বুক হতাশার যে মূর্ত বিষাদ মূর্তি আমি দেখেছিলাম, তা আমার হৃদয়পটে, চিরস্থায়ী হয়ে রইলো। আমার বিয়ের চার মাস পর উনি চলে গেলেন। প্রভাব প্রতিপত্তির ইমারতে চাপা পড়ে গেল অখ্যাত শ্যাম গাঙ্গুলীর বিদুষী তনয়া। তবু তো দুঃখ টুকু ছিল ওনার আশ্রয় , সম্বল। আমার কি অবলম্বন ছিল বলতে পারো ? আমি স্বামীর স্নেহধন্যা, পাঁচ সন্তানের জননী সুখী কবি পত্নী।

আমার মৃত্যুর পর তুমি স্ত্রীর পত্রে লিখেছিলে, মৃণাল নামটি তোমার বিশেষ পছন্দের। তাই ওই বইটি আমার বড় প্রিয়। নামের একটু সম্মান, মাধুর্য থাকবে না ! শুধু একটা প্রশ্ন রাখি হে পূজনীয় পতিদেব, মৃণালের বুকে যে সাহস, মস্তিষ্কে যে বুদ্ধি, আর দেহে যে রূপ দিয়ে তুমি তার চালচিত্র এঁকেছো, একটু চেষ্টা করলে মৃণালিনী কি খানিকটা মৃণাল হয়ে উঠতে পারত না ! আমার কিন্তু কোন অভিযোগ নেই। তুমি বিশ্বনন্দিত দিব্য পুরুষ। সকল নারীর আরাধ্যা। শুধু ঈশ্বরের কাছে একটু মিনতি, মনুষ্য জন্ম যদি দাও, একজন পরান সখা পাঠিয়ো আমার জন্য, যে শুধু বিশেষভাবে আমারই।
ইতি তোমার পরিণত বালিকাবধূ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *