হৈচৈ ছোটদের গল্পে ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

ভুতেরাও ভটভটি চালায়

রাত তখন একেবারে দুপুর হয়েছে। মানে গভীর রাত। সেদিন অমাবস্যা ছিল। তাই গাঢ় কালো আঁধার চারিদিকে। আকাশে যেন কে আলকাতরা লেপে দিয়েছে।
এমন সময় একটা বিকট আওয়াজ উঠল ভট ভট- ভট ভট ভট- ভট ভট ভটাস ভট-
দেওয়ালি তো পার হয়ে গেছে। এমন সময় পটকা বোমা ফাটায় কে? তাও আবার রাত দুপুরে। আবার আজকাল শব্দবাজি তো নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। চলে গেছে নিষিদ্ধ বাজির তালিকায়। সুসিদ্ধ আর প্রসিদ্ধ বাজিগুলোর পর্যন্ত পোড়াবার সময় নির্ধারণ হয়ে গেছে, যখন তখন আর বাজি পোড়ানো যায় না। তাহলেও এই গভীর রাতে এমন বিকট আওয়াজ করে বাজি ফাটায় কে?
সবাই ঘুম ভেঙ্গে উঠে পড়েছে। এই বিকট শব্দে কার আর ঘুম হয়। কালিদাদুর বয়েস সত্তর বছর। সত্তর বছর আগে কালিপুজোর গভীর রাতে তার জন্ম হয়েছিল বলে নাম রাখা হয়েছিল কালিচরণ।
-এ হল সেই ভট ভটির আওয়াজ। আমাদের ছেলেবেলায় চলত।
কথাটা বলল কালিদাদু। তিনকুল গিয়ে যার এখন মাত্র এক কুলে এসে ঠেকেছে।
কালিদাদুর টলমল পায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গলাও কাঁপে। সেই কাঁপা গলাতেই বলল, তোরা একালের ছেলেছোকরা সব। বাইক চালিয়ে যাস ফটাফট। কিন্তু জানিস কী বাইকের ইতিহাস?
বাইকের ইতিহাস! এই মরেছে এটা আবার কবে ইতিহাসের সিলেবাসে জুড়ল? ক্লাস এইটের সুরথ ভাবতে বসে গেল। ভাবনা নয় দুর্ভাবনা এক ধরণের। বাইকের ইতিহাস যদি সিলেবাসে ঢোকে তবে তো সেটা ক্লাসে পড়ানোই হয় নি। এদিকে এনুয়াল পরীক্ষা তো এগিয়ে এল। যদি কোশ্চেনে এসে পড়ে তো কী হবে?
ভয়ে সেও দাদুর মত গলা কাঁপিয়ে বলল, দাদু কাল আমাদের এই বাইকের ইতিহাসটা বলে দেবে? না মানে ভাবছি যদি পরীক্ষায় এসে পড়ে তো কী হবে?
-সে আমাদের ছেলেবেলায় বড় বড় দুচাকার বাইক চলত রে দাদুভাই। সে যেমন বিশাল আকারের দৈত্যের মত ছিল তেমনি দৈত্যের মত বিশাল আকারের লোকগুলোই চালাতো। আসলে সাইকেল হলেও মোটরে চলত তাই বুঝি লোকে ডাকত মোটর সাইকেল বলে।
-তারপর? বড় বড় চোখ করে প্রশ্ন করল সুরথ। ভাবল বাইকের ইতিহাস তো তবে বেশ মজার। অবশ্য ইতিহাস তার বেশ ভালো লাগে। যেমন ভালো লাগে গল্প শুনতে। আর ইতিহাস তো আসলে গল্পই।
বিরাট সাইজের এই দুচাকার গাড়ির একজস্ট পাইপ বা ধোঁয়া বেরোবার পাইপগুলোও বেশ বড় আর মোটা হত। গ্যাসেই তো গাড়ি চলে। চাকা ঘোরানোর পর সেই গ্যাস বাইরে আসার পথ খোঁজে। আর অমনি পাইপের ভেতর দিয়ে গ্যাসের বড় বড় বুদবুদের বাইরে আসতে আসতে অমন ভট ভট করে বিকট আর বিশাল আওয়াজ করত। তাই আওয়াজ উঠত ভট ভট করে। আর আমরা বলতাম ভটভটি।
ভটভটির ইতিহাস শুনে বেশ ভালো লাগল সুরথের। এই ব্যাপার। এ তো বেশ সহজ। মনে থাকবে। পরীক্ষায় এলেও সে দিব্বি লিখে দেবে।
তার জাঠতুতো দাদা প্রমথর কিন্তু দেরি সয় না। সম্প্রতি সে ভর্তি হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। কিনেছে একটা ছোট ড্রোন। মাঝে মাঝেই উড়িয়ে দেয় সেটা আর রিমোট টিপে নিয়ন্ত্রণ করে। আর দেখে সেই ড্রোন যা দেখায়।
ভালো করে দেখেশুনে হতাশ হয়ে বলল, না দাদু, কোথাও তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ড্রোন অনেক দূরেও উড়িয়ে নিয়ে গিয়েও তো তোমার ভটভটির আওয়াজ পেলুম না। তার হেডলাইটের আলোরও তো পাত্তা নেই।
প্রমথর ড্রোন ফিরে এল। কিন্তু ভটভটির আওয়াজ তো থামে না। সে বিকট আওয়াজ আগে তবু দূরে শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন তো সে ক্রমে কাছে সরে আসছে। এবার কানের একেবারে সামনে। যেন মাথার ওপরে। যেন পুজোর ঢাক তাদের মাথার ঠিক ওপরে বাজছে।
সিধু ঠাকুমা ছুটে এসে বলল, হ্যাঁগো তিনি তো ছাদে এলেন বলে মনে হয়। এখন কী হবে?
সিধু ঠাকুমার আসল নাম হল সিদ্ধেশ্বরী। আগেকার মানুষের তো এমনই নাম হত। আর সে তো কালিদাদুর বৌ। তাই সে ঠাকুমা। কালিদাদু চোখ তুলে বলল, সে? এতদিন পরে?
সিধু ঠাকুমা বলল, সে ছাড়া আর কেউ নয়। সে তো এমন আওয়াজ তুলত জানো না?
জানে অবশ্য কালিদাদু। কিন্তু ভুলে গিয়ে থাকবে হয়ত।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই ঢাক বাজাটা মানে ভটভটির আওয়াজ থেমে গেল। সবাই তো উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল। আবার তার ড্রোন চালালো প্রমথ। ড্রোন চালানো হয় যে রিমোট দিয়ে তার সঙ্গে লাগানো যায় একটা মোবাইল। ড্রোন যা দেখে তার ছবি চলে আসে সেই মোবাইলে। প্রমথ সেই মোবাইলের স্ক্রীনে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল।
একটু পরেই দাদু জিজ্ঞেস করল, কী হল রে?
-হ্যাঁ তুমি ঠিক বলেছ দাদু। এটা একটা মোটর বাইক বটে। তবে রঙ কালো আর একেবারে অন্ধকারে মিশিয়ে আছে।
সিধু ঠাকুমা বলল, তা থেমে তো গেল ভটভটিটা। কিন্তু কোথায় থামল দেখলি কিছু?
-ছাদের ওপর থেমেছে ঠাকুমা।
-আর যে চালাচ্ছে সে? সিধু দাদুর প্রশ্ন।
-কালো মত জ্যাকেট পরে কালো মত একটা ভুঁটকো লোক।
সুরথ তো অবাক। বলল, এত কিছু দেখা যাচ্ছে?
-তুই নিজে দেখবি আয়। ভাইকে ডাক দিল প্রমথ।
দেখে তো দারুন ভয় পেল সুরথ। তবু একটু সাহস সঞ্চয় করে বলল, ছাদে উঠল কেমন করে দাদা? মোটর বাইক ছাদে ওঠে কেমন করে?
প্রমথ বলল, তাই তো। আমিও ভাবছি রে। দাদু তুমি জানো?
দাদু উঠে পড়ল। চটপট সিঁড়ির দিকে উঠতে উঠতে বলল, শিগগির চল ছাদে যেতে হবে। সিধু ঠাকুমা অমনি পিছু নিল। পিছু নিল প্রমথও। অগত্যা পিছু নিতে হল্ক সুরথকেও। ভয় থাকলেও কৌতূহল যাবে কোথায়? তাছাড়া নিচে আর কেউ রইল না। তাই নিচে থাকলে তো ভয় বেশি।
সরু সিঁড়িতে ভিড়। সুরথের বাবা মা এখন এখানে নেই তাই। নাহলে আরও ভিড় বাড়ত। সিঁড়ির দরজায় চাবি লাগানো থাকে। ঠাকুমা চাবি আনতে ভুলে গেছে। তারপর একবার প্রমথকে একবার সুরথকে অনুনয়। প্রমথ বলল, আবার পা ব্যথা করতে হবে ঠাকুমা?
সুরথ বলল, ওরে বাবা নিচে কেউ নেই। আমি যাব না।
অগত্যা বুড়ি ঠাকুমাকেই আবার গজ গজ করতে করতে দৌড়োতে হল। বুড়ি ঠাকুমা আর পারে না। দৌড়োতে দৌড়োতে গেল আর হাঁপাতে হাঁপাতে এল।
ছাদের দরজা খোলা হল। আওয়াজ উঠল ভট ভট ভট ভট। সবাই কানে চাপা দিল। কানে যে তালা ওঠার উপক্রম। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভটভটিটা ছাদের চারিদিক দিয়ে এক পাক মেরে এল। ছাদের আলসে মাত্র এক ফুট। সুরথের বাবা দোতলা করার সময় আলসে মাত্র এক ফুটের নিদান দিয়েছে। বলেছে এতে ভালোই হবে। আলো হাওয়া দুই খেলবে। তাই সবাই মানে সুরথ বাদে সবাই ভটভটির এই ছাদ আবর্তনে রীতিমত অবাক। সুরথ তো চোখ বুজে ছিল। আর সে সিধু ঠাকুমাকে জড়িয়ে ছিল। তার বড় ভূতে ভয়। আর তার ধারণা তার দাদা যতই অঙ্ক জানুক বা ড্রোন উড়িয়ে অনেক দূরের ছবি তুলে আনুক, সেও বলবে ছাদে ভটভটি তোলার ক্ষমতা একমাত্র ভূত ছাড়া আর কারোর নেই।
ভটভটিতে বসা ছায়ামূর্তি এখন ভটভটি নিয়ে ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল ভটভটিটা। যেমন লম্বা তেমনি উঁচু। দাদু নাকি বলেছে তারা বাবার একটা জব্বর মোটর বাইক ছিল। সেটা চললেই এমন ভট ভট করে ঢাকের মত আওয়াজ উঠত। যেখান দিয়ে লোকে যেত সেখানের লোক কানে চাপা দিত। তাহলে কি-
দাদু এগিয়ে গেল সামান্য সামনের দিকে। বলল, দাদু?
ছায়ামূর্তি বলে উঠল, দাদুকে মনে আছে?
-বলছ কী দাদু? চিনব না?
-দিনটা মনে আছে?
-আছে দাদু।
এরা দুজনেই কিছু বুঝতে পারছিল না। এরা মানে সুরথ আর প্রমথ। তবে এটা বুঝেছিল এই ভটভটির ওপরে যে বসে আছে সে হল দাদুর দাদু। মানে বড় দাদু।
সঙ্গে সঙ্গে গল্পটা মনে এল দাদু যেন বলেছিল তার এক দাদুর গল্প। যার এমন একটা মোটর সাইকেল ছিল। সে যখন যেত তখন তার আওয়াজে চারপাশের লোকের কান ফেটে যেত।
-আজ সেই দিন। কালিদাদু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল।
-হ্যাঁ সেই দিন। সিধুঠাকুমাও কাঁদল।
ঠাকুমার কোলের ভেতর থেকে ফিশ ফিশ করে সুরথ বলল, কী দিন ঠাকুমা?
ঠাকুমা কান্না মেশা গলায় বলল। যা বলল তা হল এই যে সুরথের দাদুর দাদুর এই গাড়ির দুর্ঘটনা ঘটেছিল ঠিক একশ বছর আগে। একটা বাচ্চা ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে গাড়ি সমেত দাদু ছিটকে পড়েছিল একটা ডোবায়। আর বাঁচে নি। কেউ বাঁচানোর মতও ছিল না।
কিন্তু আজ কেন? প্রতি বছর নয় কেন? মানে প্রতি বছর এই দিনে দাদুর আত্মা কেন দেখা দেয় না? সুরথের মনে প্রশ্নটা জাগল। উত্তর এল আপনা থেকে। মানে ছায়ামূর্তির মুখ থেকেই।
-আজ আমার মারা যাবার একশ বছর পূর্ণ হল। তোরা তো আবার শতবার্ষিকীকে খুব মান্য করিস। তাই এমন দিনে আসা। আর আত্মা তো দিনের বেলা আসতে পারে না। তাই এই রাতের বেলা আসা। সবাই ভালো থাকিস। আর সবাইকে বলে দিস যারা বাইক চালায় তারা যেন নিয়ম মেনে সাবধানে চালায়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *