• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়

তবু অনন্ত জাগে…

ঘরের কোনে অবহেলায় পড়ে থাকা ছোট টেবিলটা আজ অনেক দিন পর আবার কাজে লেগেছে। পুরোনো, রংচটা টেবিলটাকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ধবধবে সাদা চাদরে। জুঁই আর রজনীগন্ধার সুগন্ধে ভরে আছে দু’কামরার ফ্ল্যাটের ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং রুম। টেবিলের ওপর সাদা মালায় ঢাকা পড়ে যাওয়া শমিতার ফটোটার দিকে একবার তাকালেন অগ্নিবেশ। এটা শমিতার অনেক পুরোনো ফটো। বিয়ের আগের। সম্বন্ধের জন্য শমিতার এই ফটোটারই একটা ছোট সাইজ এসেছিল অগ্নিবেশের বাড়িতে। না, এটাতেও শমিতার মুখে হাসি নেই, তবে কপালের মাঝে সেই অতি পরিচিত যতি চিহ্নটাও নেই। অগ্নিবেশের মনে হল বিয়ের আগে হয়তো শমিতা এতোটাও প্রাণান্তকর ছিল না।
“আমি এবার আসছি মেসোমশাই। বাদবাকি খাবার-দাবার সব ফ্রিজে তুলে দিয়েছি।”, ঠিকে-ঝি অনিমার কথায় সম্বিত ফিরল অগ্নিবেশের। উনি মাথা নেড়ে সন্মতি জানাতে গিয়েও থমকে গেলেন, তারপর দরাজ গলায় প্রশ্ন করলেন,”তোমার ছেলেমেয়েদের জন্য নিয়েছো তো?”
অগ্নিবেশের প্রশ্ন শুনে অনিমা একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। শমিতা বেঁচে থাকতে কোনোদিন আধখানা বিস্কুটও দেয়নি অনিমাকে, আর সে পরপারে পৌঁছতে না পৌঁছতেই তার স্বামী অনিমাকে বলছে ছেলেমেয়েদের জন্য খাবার নিয়ে যেতে; নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না অনিমা। ঠিক শুনেছে কি না পরখ করার জন্য জিজ্ঞেস করল,”মেসোমশাই কি আমাকে কিছু বললেন?”
ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে অগ্নিবেশ বলল,”আমি একা আর কতো খাবো, অল্প কিছু রেখে বাকিটা তোমার বাড়ির জন্য নিয়ে যাও।”
অগ্নিবেশের প্রস্তাবে খুশিতে ভাসতে ভাসতে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল অনিমা।
শমিতার ফটোর দিকে আবার চোখ চলে গেল অগ্নিবেশের। মনে পড়ে গেল কিছু পুরোনো কথা।
এগারো জন ভাইবোনেদের মধ্যে অগ্নিবেশ ছিল লেখাপড়ায় সবচেয়ে ভালো। তাই বাবা খুব ছোটবেলাতেই অগ্নিবেশকে পাঠিয়ে দিয়েছিল হোষ্টেলে, যাতে হই-হট্টগোল থেকে দূরে থেকে পড়াশোনায় মন দিতে পারে, বংশের মুখ উজ্বল করতে পারে। অগ্নিবেশও নিরাশ করেনি বাবাকে। মন দিয়ে পড়াশোনা শেষ করে জুটিয়ে নিয়েছিল মোটা মাইনের চাকরি, বাবার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল অর্থিক সাহায্যের হাত। সবকিছু বেশ ভালোই চলছিল, কিন্তু তখনকার দিনে চাকুরে ছেলেকে বেশিদিন আইবুড়ো রাখা ছিল তথাকথিত হিতাকাঙ্খীদের চক্ষুশূল। তাই বোনেরা অবিবাহিত থাকা সত্বেও শুরু হল অগ্নিবেশের জন্য পাত্রী দেখা।
মায়ের ইচ্ছা ছিল সুদর্শন, সুপুরুষ, রাজপুত্রের মতো ছেলের জন্য পরমা সুন্দরী বউমা আনবেন। আর বাবার ইচ্ছা ছিল উচ্চ-বংশের মেয়ের সাথে উচ্চ-শিক্ষিত ছেলের সম্বন্ধ করবেন। শেষ পর্যন্ত বাবার কথাই থেকেছিল। শমিতা ছিল অধ্যাপকের কন্যা। ছয় বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। দেখতে শুনতে তেমন আহামরি ছিল না তবে লেখাপড়ায় ভালো ছিল। শমিতার ফটো দেখে অগ্নিবেশের তেমন পছন্দ হল না, কেমন একটা জবুথবু, জড়োসড়ো মার্কা মেয়ে। কিন্তু অগ্নিবেশ মুখে কিছু বলল না। দাদা, বাবা-মায়ের অমতে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে পৃথগন্ন হয়েছে, সে শোক মা-বাবা এখনও সামলে উঠতে পারেনি, এর ওপর যদি অগ্নিবেশও বিয়ের ব্যাপারে নিজের মতামত ফলাতে শুরু করে তাহলে বাবা-মা বড়ই কষ্ট পাবে। তাই পাত্রী অপছন্দ হওয়া সত্বেও অগ্নিবেশ বিয়েতে সন্মতি দিল। বাবা ঘটা করে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেন।
লেখাপড়ায় ভালো হলেও অগ্নিবেশ কোনোদিনই অঙ্কে তেমন পারদর্শী ছিল না তাই জীবনের অঙ্কটাও ঠিকমতো কষে উঠতে পারেনি। ও ভেবেছিল শমিতা যখন প্রফেসরের মেয়ে তখন নিশ্চয়ই আদব-কায়দা জানা, উদার-মনস্ক হবে কিন্তু যে ব্যাপারটা ও একেবারেই মাথায় রাখেনি সেটা হল ছয় বোনের মধ্যে শমিতা হল জ্যেষ্ঠা। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই শমিতার হাবেভাবে অগ্নিবেশ বেশ বুঝতে পারল এ যাবৎ কাল ধরে ওর দেখা সমস্ত কুচুটে মহিলার মধ্যে শমিতাই হল সবার সেরা। ছোটবেলা থেকে ছোট বোনেদের হিংসে করতে করতে হিংসা করাটা আজ শমিতার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। অগ্নিবেশের আনা ভালো খাবার পাছে অন্য কেউ খেয়ে নেয় তাই হজম করার ক্ষমতা না থাকলেও সেগুলো গোগ্রাসে গেলা চাই শমিতার, তারপর সারারাত অগ্নিবেশের ঘুমের দফারফা। অগ্নিবেশ নিজের বোনেদের কিছু দিলেই অশান্তি, কেন শমিতার বোনেদের দেওয়া হল না; শমিতার বোনেদের জন্য একই রকম জিনিস এনেও শান্তি নেই, তখন প্রশ্নবাণ, শ্যালিকাদের প্রতি এতো অহেতুক প্রীতি কেন? রোজকার মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে করতে অগ্নিবেশের একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থা। দু’একজন অভিজ্ঞ বন্ধুপত্নী পরামর্শ দিল শমিতাকে নিয়ে দূরে কোথাও সংসার পাততে, যেখানে ওরা দুজন ছাড়া আর চেনাজানা কেউ থাকবে না। অনিচ্ছা সত্বেও অগ্নিবেশ তাই করল।
কিছুদিন বেশ ভালো কাটলো। অগ্নিবেশের একটি পুত্রসন্তান জন্মাল। কিন্তু সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে কিছু শারীরিক গোলযোগ হল শমিতার, শরীর গেল ভেঙ্গে। তারপর আবার যে কে সেই। অগ্নিবেশ কোনো মহিলার সাথে কথা বললেই সন্দেহের চোখে দেখত শমিতা, কুটিল ভাবে প্রশ্ন করত,”ওই মেয়েছেলের সাথে তোমার এতো গল্প কিসের?” অশান্তির ভয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিল অগ্নিবেশ। সংসার চলল শমিতার সর্বনেশে আইন মেনে।
“মেসোমশাই”, অনিমার ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়ল অগ্নিবেশের।
অনিমা হাতে ধরা প্যাকেটটা ফাঁক করে অগ্নিবেশকে দেখাতে চাইল ও কি কি খাবার নিয়েছে। অনিমাকে সে সুযোগ না দিয়ে অগ্নিবেশ তাড়াতাড়ি বলল,”ঠিক আছে। তুমি এখন এসো।”
অনিমা বিদায় নিতেই শোওয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল অগ্নিবেশ।
বহু বছর ধরে খাটের তলায় পড়ে আছে অগ্নিবেশের অতি প্রিয় হারমোনিয়ামটি। কম বয়সে পরিচিতদের বিবাহবাসরে এই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শুনিয়ে অনেক মনোরমার মন হরণ করেছিল অগ্নিবেশ। বিয়ের পর দু’একবার শমিতাকেও হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শোনাবার চেষ্টা করেছিল, আশা ছিল গান শুনে মিষ্টি হেসে পাশে এসে বসবে শমিতা। কিন্তু সে গুড়ে বালি। অগ্নিবেশের গান শোনার থেকে গানে কি কি ভুল হচ্ছে সেটা ধরিয়ে দেওয়ার দিকেই বেশি মনোযোগ ছিল সবজান্তা শমিতার। অগত্যা, অগ্নিবেশের হারমোনিয়াম স্থান পেল ঝড়তি-পড়তি জিনিসের দলে।
অগ্নিবেশের মনে একটু ভয় ছিল, এতো দিনের অব্যাবহারের পরে এ হারমোনিয়াম আবার আগের মতো বাজবে তো? এতোদিন রেওয়াজ নেই, ইচ্ছা থাকলেও গলা দিয়ে সুর বের হবে তো?
অগ্নিবেশ যতটা ভেবেছিল ততটাও খারাপ ছিল না অবস্থা। হারমোনিয়াম বাজিয়ে বেশ কয়েকবার স্বরগম ঝালিয়ে নিল অগ্নিবেশ। সুরে সুর মিলতেই মন ভরে গেল অপরিসীম আনন্দে। অনেক কষ্টে লোহার বেড়ি কেটে খোলা আকাশে ডানা মেলা মুক্ত বিহঙ্গের মতো মনের অবস্থা এখন অগ্নিবেশের। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোনো আনন্দের গান মনে পড়ল না। অগ্নিবেশের এতো বছর ধরে চেপে রাখা কষ্টেরা প্রকাশ পেল একটা মন কেমন করা গানে,
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।