• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় (পর্ব – ১০)

গোলকচাঁপার গর্ভকেশর

কিচেনে ঢুকে আদিত্য শিন্ডে যা দেখল তাতে ওর চক্ষু একেবারে চড়কগাছ হয়ে গেল। ননস্টিক তাওয়ার ওপর মেথিশাকের পরোটা ভাজছে সুরভি আর সিঙ্কের পাশে প্লাস্টিকের চুবড়িতে রয়েছে আরও বেশ খানিক গাঢ় সবুজ পাতাওয়ালা টাটকা ডাঁটা; সেগুলো বাজার থেকে কেনা নোংরা মাটি লাগানো শেকড়-বাকড়ওয়ালা নয় বরং সুন্দর করে কাঁচি দিয়ে কাটা।
এতো বছরের সংসার, আদিত্যর কোঁচকানো ভুরুর দিকে তাকিয়েই ওর মনের ভাবখানা আন্দাজ করে ফেলল সুরভি। তাওয়ার পরোটাটাকে খুন্তি দিয়ে উল্টে একগাল হেসে বলল, “তুমি খেতে ভালোবাসো তাই গুরপ্রীত ভাইসাহাব আজ সকালেই দিয়ে গিয়েছেন। ওদের কিচেন গার্ডেনের, এক্কেবারে ফ্রেশ।”
উত্তর পেয়ে ব্যাজার মুখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো আদিত্য। ও খেতে ভালোবাসে না ছাই, ও কি আর গুরপ্রীতের এ সব পাঁয়তাড়া বোঝে না, এ সবই সুরভিকে হাত করার চেষ্টা। সুরভিটাও এতো ভোলেভালা, এত্তো বোকা, সবকিছু দেখেও কিছুই বুঝতে পারে না। আদিত্য দু’একবার সাবধান করে দিতে গিয়েছিল, সুরভি তো সে সব কথা কানেই তুলল না, উল্টে আদিত্যকে ছোট্ট ধমক দিয়ে বলল,” এ সবই তোমার মনের ভুল। গুরপ্রীত ভাইসাহাব ওমন লোকই নয়, উনি একেবারে মাটির মানুষ। আর তাছাড়া বাড়িতে লাভলি জি-র মতো অতো সুন্দর বউ থাকতে উনি এদিক ওদিক ছোঁকছোঁক করবেনই বা কেন?’, কথাটা যে সুরভি একেবারে ভুল বলেছে তা নয়। গুরপ্রীত সিং পান্না-র স্ত্রী লাভলি সবদিক দিয়েই সুরভির থেকে অনেক বেশি সুন্দরী। লম্বা, চওড়া, ফর্সা, টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট, স্টেপকাট চুল। শরীরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা সালোয়ার-কামিজের ভেতর থেকে সুপক্ক শ্রীফলের মতো বক্ষ যুগল আর ওজনদার তরমুজের মতো পশ্চাৎদেশ দিনের আলোর মতোই প্রতীয়মান। এক কথায় বলতে গেলে একেবারে আশির দশকের ফিল্মি হিরোইনদের মতো চেহারা; গুরপ্রীত সে সব ফেলে সুরভির মতো একটা সাদামাটা মোটাসোটা আটপৌরে ভাবিজি টাইপ হাউস-ওয়াইফের দিকে তাকাতেই বা যাবে কেন ?
বছর খানেক হল এই রাজগৃহ হাউসিং সোসাইটিতে ভাড়া এসেছে গুরপ্রীত সিং পান্না; গোঁফ, দাড়ি, পাগড়ি সমেত সুপুরুষ চেহারা আর মুখে ঝরঝরে ইংরেজি। গুরপ্রীত আগে আর্মি অফিসার ছিল, সেখান থেকে অবসরের পর এখন একটি সিকিউরিটি এজেন্সির সি,ই,ও। গুরপ্রীতের মেয়ে পাম্মি আর আদিত্যর মেয়ে নিকান্তি একই স্কুলে পড়ে, একই পুল-কারে চড়ে স্কুলে যায়। এখানেও একেবারে মুখোমুখি ফ্ল্যাট আদিত্য আর গুরপ্রীতের, বারান্দায় দাঁড়ালে না চেঁচিয়েই বেশ খানিক গল্পগাছা করা যায়। আর এই গল্প করা নিয়েই বেঁধেছে যত গোল। পাম্মি আর নিকান্তি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করে, সুরভি আর লাভলি পরস্পরের রান্নাঘরের খবরাখবর নেয়। গুরপ্রীতও নিজের পরিচয় দিয়ে আলাপ জমাতে চেয়েছিল আদিত্যর সাথে। কিন্তু লম্বা,চওড়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ফরফরে ইংরেজি বলা, ভুঁড়িবিহীন, পেশীবহুল গুরপ্রীতের সামনে কেমন যেন কুঁকড়ে গিয়েছিল বেঁটেখাটো, কালোকোলো, আবাল্য মারাঠি মিডিয়ামে পড়াশোনা করা আদিত্য; ওর ছোটোখাটো চেহারাটা গুরপ্রীতের পার্সোনালিটির সামনে যেন আরও অনেকখানি ছোট হয়ে গিয়েছিল। তাই গুরপ্রীতকে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে আদিত্য। কিন্তু সামনাসামনি ফ্ল্যাট হলে তা হওয়ার নয়, ইচ্ছা না থাকলেও রোজ অন্তত একবার মুখদর্শন করতেই হয় অনাকাঙ্ক্ষিত অপছন্দটির। আর আদিত্যর ক্ষেত্রে সেই ব্যাপারটি ঘটে এক্কেবারে দিনের শুরুতে। রোজ সকালে নিজের বসার ঘরের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দায় বসে সূর্যের দিকে মুখ করে বেশ কিছুক্ষন নিশ্চিন্তে কপালভাতি প্রাণায়াম করতো ছোট্টখাট্টো চেহারার আদিত্য, কিন্তু গুরপ্রীত আসার পর থেকে সে সব বন্ধ করতে হয়েছে। কারন, লম্বা-চওড়া গুরপ্রীতও ঠিক ওই সময়েই নিজের লম্বা-চওড়া বারান্দা যাকে এখানে সবাই ‘টেরেস’ বলে, সেখানে দাঁড়িয়ে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে, যদি কখনও আদিত্যর চোখে চোখ পড়ে যায় তাহলে মধুর হেসে কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করে। সকাল সকাল অপছন্দের মানুষের সাথে কুশল বিনিময়, একেবারেই পছন্দ নয় আদিত্যর। অগত্যা, এখন নিজের বেডরুমে খোলা জানালার সামনেই সারতে হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা। তবে এখানেই শেষ নয়, ছুটির দিন বিকালে একটু আপনমনে বারান্দায় দাঁড়াবে তার উপায় নেই, চোখের সামনেই চক্ষুশূল। গুরপ্রীত হয় ওর পরমা সুন্দরী বউয়ের সাথে বড় বারান্দায় পাতা ছোট টেবিলটায় বসে বাহারি কফি মগ হাতে নিয়ে গল্পগুজব করছে নয়তো নিজের মনে রট-আয়রনের কালো র‍্যাক-এর ওপর রঙিন সেরামিকের দামী টবে রাখা সবুজ গাছগুলোর পরিচর্যা করছে। এই দুটোই আদিত্যর কাছে সমান বিরক্তিকর। একেই তো গুরপ্রীতের ওই রকম সেক্সি বউ, দেখলে মুনি-ঋষিদেরও চিত্ত চাঞ্চল্য হয় তার ওপর আবার ওর ওই রকম বড়োসড়ো বারান্দা। আদিত্যর বারান্দায় ভিজে জামাকাপড় মেলার জন্যই স্থান অকুলান তাই বারান্দার এক কোণে একটা মাত্র তুলসী গাছ ছাড়া আর কোনো গাছই নেই, সে জায়গায় গুরপ্রীতের টেরেসে টেবিল-চেয়ার, উইন্ড-চাইম, আর গাছের পর গাছ; মরশুমি ফুলের গাছ, বাহারি পাতার গাছ আর যেটা দিয়ে সুরভিকে এতো ইমপ্রেস করেছে সেই কিচেন গার্ডেন। মেথিশাক, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা, ক্যাপসিকাম, টমেটো সব আছে সেই বাগানে। তবে এ সবই মেনে নিয়েছিল আদিত্য, ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। কিন্তু দিন পনেরো আগে যা ঘটলো তাতে আদিত্যের সহ্যের সীমা একেবারে পগার পার হয়ে গেল।
করোনা ভাইরাসের কর্মক্ষমতা কমানোর জন্য সেদিন সকাল থেকেই জারি হয়েছিল জনতা কারফিউ আর বিকালে ছিল সার্বজনীন হাততালি দেওয়ার আহ্বান। সবার মতোই বিকেল পাঁচটার একটু আগে সপরিবারে নিজের বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল আদিত্য, গুরপ্রীতও ওর টেরেসে এসে গিয়েছিল নিজের পরিবার সমেত। ছন্দবদ্ধভাবে হাততালি দেওয়া শুরু হল। আদিত্য দেখল সুরভি আর গুরপ্রীত একে ওপরের দিকে তাকিয়ে অল্প অল্প হাসছে। জ্বালা ধরা মন নিয়ে জোরে জোরে তালি বাজাতে লাগলো আদিত্য। হঠাৎ গুরপ্রীত কাউকে কিছু না বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সেই যে ঢুকলো আর বের হওয়ার নাম নেই। আদিত্য ভাবলো ভালোই হয়েছে, আপদ বিদায় হয়েছে। কিন্তু তারপর যা হল…
ঘরের ভেতর থেকে একটা ঢোল নিয়ে বেরিয়ে এল গুরপ্রীত; হিন্দি সিনেমায় যেমন ঢোল বাজিয়ে পাঞ্জাবী মেয়েরা বিয়ের আগে নাচের অনুষ্ঠান করে, ঠিক সেই রকম। সিনেমায় মহিলারা ঢোলটাকে একটা চামচ দিয়ে বাজায় কিন্তু গুরপ্রীত দু’হাত দিয়ে জোরে জোরে চাপড় মারতে লাগল ঢোলটার দুদিকে, আর সেই দেখে আদিত্যর দু’পাশে দাঁড়ানো মা-মেয়ের সে কি আনন্দ, নিকান্তি হেসে গড়িয়ে পড়ল আর সুরভি তো স্থান-কাল ভুলে হাসতে হাসতে একেবারে ঢলে পড়ল আদিত্যর গায়ে। চরম বিরক্তিতে হাততালি দেওয়া মাঝখানেই থামিয়ে দিয়ে আদিত্য চলে গেল ঘরের ভেতর।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।