গল্পবাজে আলিনূর চৌধুরী – ১

তুলির অন্তর্ধান
বেলা দুপুর। হাছেন শেখের বাড়িতে কান্নার রোল। সে কি আত্নচিৎকার বুক ফাটা কান্না আকাশ ভারী করে তুললো। কিভাবে কি হলো কেউ বুঝতেই পারেনি। হাছেন শেখ কিংকর্তব্যবিমূঢ়,বিষন্ন মনে দাওয়ায় বসে ফ্যালফ্যালে আকাশের দিকে তাকিয়ে এক মনে কি যেন ভাবছে। বাড়ি ভর্তি মানুষে গিজগিজ করছে। সবায় শুধু বলাবলি করছে এইটা কি করলো-এইটা কি করলো মেয়েটি। নম্র ভদ্র ভালো মেয়েটা কি না বিষ খাইলো। কি ওর কষ্ট ছিলো? কষ্ট সইতে না পাইরা বিষ খাইয়া মরলো!
হাছেন শেখের মাইজলা মায়া -তুলি। সেইতো বছর দশেক আগে দেওয়ানগঞ্জ খোলাবাড়ি যমুনার চর -ফজল মিয়ার বড় ছেলে – নুরল মিয়ার সাথে বিয়ে হয়।
বিষ খেয়ে মারা গেলে থানায় না জানিয়ে এবং অনুমতি ছাড়া লাশ দাফন করা যায় না। পাছে কোন হাঙ্গামা না হয় সে কথা ভেবে এলাকার মেম্বার মীর হাজি কে জানালেন। মেম্বার বললেন- তোরা লাশ দাফনের ব্যবস্থা কইরা ফেলা,আমি আছি না? থানায় জানাইয়া দিমু। চিন্তা করিস না।
এক সাগর অশ্রুজলে ভাসিয়ে অবশেষে তুলির লাশ পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। এক সাগর অশ্রুই তো! আরো বইবে কতকাল যে জানে। দুইটি ছোট শিশু রেখেই তুলির অন্তর্দান। হেলাল ও লালু দুটি ছোট্ট শিশু,বড়টার বয়স আট ছোটটার পাঁচ বছর। যে গেছে সেতো চলেই গেছে। এখন এই কঁচি শিশু বাচ্চা দুটির কি হবে এটাই হাছেন শেখের নতুন ভাবনা
মা ছাড়া শিশু কিভাবে থাকবে! সারাক্ষণ শিশু দুটি মা-মা করে কান্না করে । কিছুই খাইতে চায়না। ওরা এখন কার কাছে থাকবে,কেইবা দেখাশোনা করবে সে ভাবনার কোন কুলকিনারা করতে পারছে না হাছেন শেখ। নানী বেঁচে থাকলে তাঁর কাছে না হয় থাকতো। সেও বেঁচে নেই। কি করবেন,কি করা উচিত কিছুই মাথায় আসছে না তাঁর।
হাছেন শেখের দুই ছেলে। আলী আর ছানু। আলী বড় ছানু ছোট। দুই ছেলের বউ আছে,তাঁরা তো পরের ঘরের মেয়ে এ দুঃখ কষ্ট বিপদ বুঝবে কি তারা? বুঝবে না। হাছেন শেখ একদিন বড় ছেলের বউকে বলল- বউ মা তোমরা দুইজন আছো,তোমরা একটু তুলির ছেলে দুইটাকে দেইখো। নাতী দুইডাকে কোথায় ফালাইয়া দিমু! তোমরা ছাড়া কেইবা আর দেখবে?
বড় বউ নূরজাহান বললো- ঐসব বেজাল টেজাল আমি দেখতে পারমুনা। ওদের দাদার বাড়ি পাডাইয়া দেন। নিজের দুইডাই সামলাইতে পারিনা।
হাছেন শেখের বুঝতে আর বাকী রইলো না যে, নাতী দুটি অকূলে ভাসবে। দাদার বাড়ি দাদা দাদী বাঁইচা নাই। জামাই নূরলের ছোট ভাই আছে। সেও খুব অভাবী। দিন চলে খুব কষ্টে। তারা তো এইডা জামেলা মনে কইরা নিবে না। তাছাড়া বাড়ি ঘর তো কবেই যমুনা গ্রাস কইরা নিছে। বাড়ি ভাঙ্গনের পর থাইকা জামাই মেয়ে নাতীসহ তার বাড়িতে থাকে।
ভাবনায় ডুবে যায় হাছেন শেখ। আমি মইরা গেলে নাতী দুইডার কি দশা হবে! হয়তো কেউ চায়াও দেখবে না ওদের । না খাইয়া পথে পথে ঘুইরা বেড়াইবে। কোথায় থাকবে কি খাইবে! এসব ভাবতে ভাবতে বিষন্ন হয়ে পড়ে।আর ভাবতে পারে না।
হেলাল,লালু মা মারা যাবার পর থেকে তাদের ছোট খালা শহর বানুর কাছে থাকে। খালা-তো মায়ের বোন! তাই বোনের সন্তান কে পর করে ভাবতে পারে না শহর বানু। কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে গেছে। ছেলে দুটিকে না খাওয়াইয়া নিজে খায় না। ঘুমানোর সময় ওদের কে তার নিজের কাছেই রাখে। ছেলে দুটিও কেমন যেন সস্তি পায়। মনে হয় মায়ের ছায়াতেই আছে।
হাছেন শেখ তার বড় ছেলে -আলী কে ডেকে বললো-নাতী দুইডা যেভাবে শহর বানুর সাথে জড়াইয়া যাইতেছে তাতে তো সমস্যা জটিল হইয়া যাইবে দেখছি। কি করবো বুঝতে পারতেছিনা। না পারতেছি দুরে রাখতে,না পারতেছি বাঁধা দিতে। উভয় সংকটের কোন কূল কিনারা নাই।
মায়াডারে তো বিয়া দিতে হইবে। বেশী জড়াইয়া গেলে তো বিয়ার সময় জামেলা পাকাইয়া জাইতে পারে।
আলী বললো- তা হইলে কি করবা এখন। দুরে রাখাও যায় না! ওদের কে দেখবে,কার কাছে থাকবে ভাইবা দেখো। নুরল আবার বিয়া করলে,ঘরে অন্য মায়া আসবে,সে কি আর হেলাল,লালু কে আপন ছেলে মনে করবে? করবে না। তার ঘরেও সন্তান হবে তখন ছেলে দুইডার কপাল মন্দ হইয়া যাবে।
সে জন্যই তো শহর বানু কে মানা করতে পারতেছিনা-বললেন হাছেন শেখ। ওদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ ভাবনাডাও জরুরি।
সে দিন ওসমান বেপারী আইছিলো বাড়িতে। উনি যে প্রস্তাব দিলেন তাতে মাথাডা চক্কর মাইরা গেলো। বললো শোনো হাছেন ভাই-তোমার ছোট মায়ারে নুরলের সাথে বিয়ে দিলে এতিম শিশু বচ্চা দুইডা আশ্রয় পাইবো। খালা তো মায়ের মতই,ওদের দুঃখ গুইছা যাইবো -ওসমান কথাগুলি গড়গড় করে বইলা ফেলাইলো। তুমি কি কও ওসমান? এইডা কি কইরা হয়? মায়াডারে শেষ মেষ দুতিয়া বিয়া দিমু?
দিতেই হইবে তাতো কইছি না। আমার বুদ্ধিতে যা মনে হইছে কইলাম। তাছাড়া সেদিন নুরলের ছোট ভাই মাজম আইছিলো ওই কথাডা ইশারা ইঙ্গিতে বুঝাইতে চাইলো। এহন তুমি ভাইবা দেহো, দিলে কি হয়,না দিলে কি হয়।
আমি কিছু ভাবতে পারতেছিনা। কি করমু বুঝে আইসে না। মাথায় খেলে না-হাছেন শেখ বলেন।
আলী মুখ খুললো-ওসমান চাচা যা কইলো,তা হইলে
কি করবা এখন? কি করবার চাও?
কি আর করার আছে! ভাইবা পাইনা।
দুতিয়া বিয়া দিয়া শহর বানু কে জলে ভাসাইমু? মায়াডারও তো সখ আহলাদ আছে। ভালো পাত্র দেইখা বিয়া দিমু,আদর সোহাগে সুখে ঘর করবে। এতসব স্বপ্ন জলে ভাসাইয়া দুঃখের সাগরে ভাসাইমু কিভাবে!
খালেক সরকার খোলাবাড়ি গ্রামের এক জন নামজাদা ব্যক্তি। গ্রাম্য বিচার আচার তারে ছাড়া চলে না। অঢেল বিষয় সম্পত্তির মালিক। সকলে তাঁরে মান্য করে। তিনি হলেন হাছেন শেখের বড় ছেলে আলীর শ্বশুর। এই রূপ সম্মানি ব্যক্তি যদি কোন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে তাহলে কী না করা চলে?
খালেক সরকার যে দিন নুরলের বাবা ফজল মিয়ার সাথে তুলির বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আসে, সেদিন হাছেন শেখ খুব অসুস্থ্য ছিলেন। বিছানায় শুয়া শুয়া আর্তনাদ করছে।
খালেক সরকার সকাল নয়টার ট্রেনে মেলান্দহ বাজার স্টেশনে নামলেন। তার পরে হাটা পথ। গাড়ি ঘোড়ার পথ নেই বললেই চলে। পায়ে হেটে যেতে হয়। মাঝে আবার একটি বিল আছে। বছরে নয় মাসই পানি থাকে । কখনও মাজা পানি কখনও হাটু পানি। হাটু অবধি এই কাঁদা পানি পার হয়ে দুই মাইল দুরত্ব পায়ে হেটেই বিজয় নগর রওনা হলেন।
এই গ্রামটির প্রতিষ্ঠা লগ্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়টি বলা উচিত। গ্রামটির নাম বিজয় নগর হওয়ার পিছনে দুধর্ষ ইতিহাস রয়েছে। আজকের পাঁচ হাজার লোকের বসতি এই বিজয় নগর গ্রামটি এক সময় ছিল আগ্রাসি উত্তাল ব্রহ্মপুত্র নদে জেগে উঠা বিশাল চর। এই চরে কোন জন মানুষ ছিলো না। পুরো চরকে ঘিরে ছিল শুধু নলখাগড়া, ঝাউ,জঙ্গল ও কাঁশ অর্থাৎ কাঁশিয়ার অভয়ারণ্য। মাঝে মাঝে ছিল বণ কার্পাস গাছ।শিয়াল,শকূন ও মাছ খেকো নানা জাতের পাখির বাস ছিল।
সে সময়টি ছিল ব্রিটিশ শাসন আমল। এই দুর্গম চরে, প্রথমে এসেছিল পাঁচ জন ফেরারি আসামি। মূলত তারা আত্ন গোপণে এসেছিলেন। দুর্গম চরে তারা নিরাপদ আস্তানা গড়ে তোলেন। তাদের আদিবাস ছিল সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর ও বেলকুচি থানা । পরে আরও পাবনার শাহজাদপুর, টাঙ্গালের ভূয়াপুর থানা থেকে অনেক মানুষ এসে বসত গড়েন এখানে। তারা ধীরে ধীরে জঙ্গল পরিস্কার করে আবাদি জমি তৈরি করে নেয়। জেগে উঠা পলিমাটির উর্বর ভূমি হওয়ায় ফসল হতো ভাল। এ ভাবেই যখন পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও টাইঙ্গাল থেকে মানুষ এসে পুরো চর পরিস্কার করে দখলে নেয় এবং চাষাবাদ শুরু করে।
এমন সময় এই চরের আশে পাশের গ্রাম গুলির মানুষের নজর পড়ে এই চরে। তারা আগ্রাসি মনোভাব নিয়ে এদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। একাধারে দুই দুইটি তুমুল সংঘর্ষ সংঘঠিত হয়। দুটি সংঘর্ষেই প্রতিপক্ষ হেরে যায়। পরবর্তীতে তারা আর এদিকে নজর দেয়নি। সংঘর্ষের মাধ্যমে বিজয় অর্জনের জন্যই গ্রামটির নাম বিজয় নগর রাখা হয়।
বিজয় নগর এই ভূখন্ডটি যে মৌজার অন্তর্ভুক্ত ছিল সেটি ছিল শেরপুর মহকুমায় কামারের চর মৌজা। ১৯৪০ সালে সিএস রেকর্ড ভুক্তের পর পিটিশনের মাধ্যমে জামালপুর মহকুমার মেলান্দহ থানায় যুক্ত হয়। এখন সেই চর সমৃদ্ধির দোরগোড়ায় এসেছে।
দুপুর বার টার সময় খালেক সরকার ও ফজল মিয়া বিজয় নগর হাছেন শেখের দাওয়ায় হাজির হইলেন। তাকে দেখে আলীর স্ত্রী নুরজাহান অস্থির হইয়া পড়িল। বললো-বাবা আসতে পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো? মা কেমন আছে? রাজু, কণা ওরা কেমন আছে? বাড়ি থাইকা কখন বাড় হইছো ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন বানে অস্থির করিয়া তুলিল।
তুই এত অস্থির হোস না তো! আসতে কোন অসুবিধা হয়নি। তোরা কেমন আছিস?
-ভালো আছি। তবে শ্বশুড় আব্বাজানের শরীর খারাপ।
-কোথায় বিয়াই এখন?
-তার ঘরেই আছে।
-জামাই বাবাজি কে দেখছি না যে।
-ও একটু মহিষ নিয়ে নদীতে গেছে। মহিষ ঝাপাইতে মানে গোসল করাইতে।
-ও,আচ্ছা। সাথে মেহমান আছে।
বসতে দাও।
-কাঁদা, ধূলা,বালুর পথে আইছেন আগে হাত মুখ ধোন- গোসল করলে,গোসল সারেন -নূরজাহান বললো। কলপাড় দেখিয়ে দিলো।
-গোসল করবো না। হাত-মুখ -পা ধুয়ে নেই।
অতঃপর মেহমান কে বাহির ঘরে বসতে দিয়ে বাবাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ডুকলো-নুরজাহান।
-বিয়াই কোথায়? কথা আছে।
শ্বশুড় আব্বা অসুস্থ্য। তার ঘরেই শুয়ে আছে।
কি হয়েছে?
কয়েক দিন ধরেই জ্বর আর পেটের পীড়া।
ঔষধ দেও নাই।
দিয়েছে। গতকালকে ফয়েজ কবিরাজ আইছিলো -ঔষধ দিয়া গেছে। ঐ ঔষধই চলছে।
গ্রামের মানুষ কবিরাজের উপর বিশ্বাসী বেশী। তাই কবিরাজই ভরসা।
আসসালামু আলাইকুম;বিয়াই। শুনলাম আপনার খুব অসুখ করেছে!
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
হ ঠিকই হুনছেন। কয়দিন ধরেই অসুখে ধরেছে। কিছুতেই কুমছে না। কবিরাজ দেখাইলাম। দাওয়াই খাইতেছি; কম -বেশি বুঝতেছিনা।
-তা আপনে কেমন আছেন? বাড়ির সবায় ভালো তো?
-হ ; ভালো আছি।আপনে-চিন্তা কইরেন না। আল্লাহ উপর ভরসা রাইখেন,সব ঠিক হইয়া যাইবে ইনশাল্লাহ। বিয়াই -আমি একটা জরুলি আলাপ নিয়া আইছিলাম আপনের কাছে। তা আপনে অসুখে ভুকছেন -তয় কেমনে কই! সাথে একজন মেহমানও নিয়া আইছি।
বয়স তো আর কম হয় নাই। শরীলটা মধ্যে মধ্যেই খারাপ হয়। আবার ভালোও হয়। অসুখে যা কাবু করছে তার চাইতে চিন্তায় কাবু করছে বেশি।
-আপনার আবার কিসের চিন্তা?
-তুলি মায়াডা বড় হইছে বিয়া দেয়া দরকার। ভালো সমন্ধ পাইতেছিনা। দিতে পারতেছি না। সেই ভাবনায় তাড়া করে সারাক্ষণ। থাক সেই সব কথা।
-আপনার কী আলাপ সেইটা কন -অসুবিধা নাই।
-আপনে যে চিন্তায় অস্থির সেই চিন্তার সমাধান করার জন্যেই আইছি।
-বুঝলাম না বিয়াই। বুঝিয়ে বলেন।
-বলছিলাম যে-তুলি মা মণির একটা ভালো সমন্ধ নিয়া আইছিলাম। ছেলের বাবাকেও সাথে নিয়া আইছি। জমি জিরাত ভালো। সংসারও ভালো। ছেলেরা দুই ভাই এক বোন। বাপের বড় ছেলে। আপনে মত দিলেই আলাপ করা যায়।
-বিয়াই ; আমার মায়া মানে আপনার মায়ার মতই। আপনে কি আর জাইনা শুইনা মন্দ সমন্ধ আনবেন।
যদি ভালো হয় দেখেন। আমিও মায়াডারে বিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইতে চাই। আল্লাহ যেন মায়াডারে সুখের সংসার জুটাইয়া দেয়।
-তাহলে ছেলের বাবাকে নিয়া আইছি। সে মায়া দেখুক যদি পছন্দ করে,আপনারাও ছেলে,ছেলের বাড়ি ঘর দেখেন। দুই পক্ষের পছন্দ হইলে পাঁকা কথা হইবে- কি কন বিয়াই?
-ঠিক আছে তাই হবে। তুলিরে দেখার ব্যবস্থা করতেছি। তারে দেখান।
-শনিবার বিকালেই মেয়ে দেখলেন বর পক্ষ। মেয়ে কোরআন পড়তে পারে কিনা,নামাজ পড়তে পারে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। সুরা মুখস্ত আছে কিনা জানতে চাইলেন। আলহামদু সুরা পাঠকরালেন । মাথার চুল খাটো না লম্বা মাথার কাপড় খুলে দেখলেন। পাও খরম পায়া কিনা এবং ছোট বড় আছে কিনা হাটাইয়া হাটাইয়া দেখলেন। মুখের দাঁত গুলি তেরাবাঁকা আছে কিনা তাও দেখলেন। এ যেন এক মহাযজ্ঞ পরীক্ষা। সকল পরীক্ষাই পাশ করলো তুলি।
-ছেলের বাবা মেয়ে দেখার পর খালেক সরকারের সাথে পরামর্শ করতে চাইলেন। সরকার বৈঠক থেকে উঠলেন। আড়ালে তার সাথে ছেলের বাবা পরামর্শ করলেন। পরামর্শ শেষে সরকার জানালেন মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্। তারা তাদের ছেলে ও ছেলের বাড়ি দেখার দাওয়াত জানিয়েছেন। আপনাদের পছন্দ হলেই পাঁকা হবে।
-আপনারা কবে ছেলে দেখতে যাইবেন আজকেই জানাইয়া দেন ।
-আমরা আগামি সোমবার ছেলে দেখতে যাব হাছেন শেখ জানাইলেন। কথা শেষ। প্রথা অনুযায়ি মিষ্টিমুখ করা হয়। সেই সাথে একটু ভালো-মন্দ খানা-পিনাও হলো।
হাছেন শেখ ও তার বড় ভাই ওছিমুদ্দিন এবং জমির বেপারি তিন জন, পাত্র দেখার উদ্দেশে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হলেন। সকাল নয়টার লোকাল ট্রেন ধরে বাহাদুরাবাদ ফেরি ঘাট নামলেন। ফেরিঘাট থেকে আবার নৌকা পথে যমুনা পূর্ব নদী পাড়ি দিতে হবে। খোলাবাড়ির দক্ষিণে সাকুয়ার চর মধ্যপাড়া ফজল মিয়ার বাড়ি। সেখানেই যেতে হবে। এই সাকুয়া চরের পূর্ব ও পশ্চিমে উভয় পাশে বিশাল নদী। পূর্ব পাশ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র ভাগ হয়ে ভাটির দিকে বয়ে চলেছে। পশ্চিম পাশে দিয়ে তিস্তা প্রবাহিত হয়ে বাহাদুরাবাদ মিলিত হয়েছে। দুই নদীর মাঝে বিস্তৃর্ণ জেগে উঠা বিশাল চর। এটি অবশ্য অনেক পুরোনো চর। কয়েক বংশধর ধরে চলে এসেছে। এখনো চরটি টিকে আছে।
বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে দেড় মাইল উত্তরে সাকুয়া -খোলাবাড়ি খেয়াঘাট। নদীটা অনেক প্রসস্ত তাই নৌকার মাঝি তিন জন। নৌকায় পাল উঠানোই থাকে। বাতাস থাকলে পালেই নৌকা চলে। বাতাস না থাকলে দুজনে দাঁড় টানতে হয়।
নৌকায় চড়ে জমির বেপারি বললো- হাছেন ভাই কোথায় নিয়া আইলা তুমি! এ তো দেখতেছি সাত সমুদ্দুর তেরো নদী। এই দুর্গম চরের দেশে মায়া বিয়া দিবা। আমার ভালো ঠেকতেছে না।
ওছিমুদ্দিন বললো-জমির হাছেনের বড় ছেলেরে তো এই খানেই বিয়া করাইছে। খোলাবাড়ি খালেক সরকারের মায়া।
ও!- ওই বুঝি ঘটক!
হ রে -জমির।
তাই তো বলি। এত জায়গা থাকতে এই নিঝুম পাথারে কেনো আইলো -জমির মনের খেদে কথাটা বললো।
পালে বাতাস নাই। মাঝিরা দুই জন দাঁড় টানছে। বড় মাঝি হাল ধরে বসে বসে মনের সুখে খাইরন বিবির গান ধরেছে। খাইরন বিবির শ্বশুড় বাড়ি এই দেওয়ানগঞ্জে মেরুরচরে ছিল। তারপরিনতি সবার জানা।
রোদে যমুনার পানি চিকচিক করছে। ছোট বড় ঢেউ ভেঙে ভেঙে নৌকা তীরে ভিড়লো।
এতক্ষণ তো আরামেই ছিলাম। নৌকায় বসে ঝিমিয়ে পড়েছিলাম।
নদী পার হইলাম। এখন তো দেখছি বালুর সাগর পাড়ি দিতে হবে -বিরক্তের সুরে জমির বললো।
বালুর বুকে ভর করে হাটাতে হাটতে শরীরের ঘাম চুইয়ে চুইয়ে ঝরছে। এ যেন শরীরের সাথে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা । জুতা খুলে খালি পায়ে হাটা শুরু করলো। নদীর ঢালু থেকে পাড়ে উঠতেই,দেখা মিললো পুরা চর জুড়ে শুধু কাঁশ আর কাঁশ ফুলে একাকার,থরে থরে সাদা বকের মত ; মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে। অপূর্ব দিগন্ত জুড়ে সাদা আর সাদা।
নদীর কিনারা দিয়ে গ্রামের কয়েক জন লোক তইরা জ্বালে মাছ ধরছে।
হাছেন ভাই এখানে আবাদ হয়না? শুধুই কাইসা জাটির আখ। মানুষ খায় কী? জমির জানতে চায়।
-হয়। তবে ধান তেমন ভালো হয়না। বালু বালু মাটি তো তাই। তাহলে কী কী হয় এখানে!
কাউন আর চিনা বেশী হয়। পাট,তিল ও আখ চাষ হয়। আখ আবার এখানেই মাড়াই করে গুড় বানায়। নদীর কিনার দিয়া গুজি তিল হয়।
তাহলে এখানের মানুষ ভাত খায় না! কাউন চিনা এই খায়া মানুষ বাঁচে?
ভাত খাইবো না ক্যা? চাইল কিনা খায়। কাউন চিনা বেইচা চাইল কিনে।
ও! বুঝলাম। যারা চাইল কিনতে পায়না তারা সেইটাই খায়।
হ। ঠিক কইছো।
ঝনঝনা শুকনা বালু গায়ে মাথায় লাইগা একেবারে সাদা হয়া গেলাম দেখি -হাছেন ভাই।
চিন্তা করিসনা জমির। আগে পৌন্ছাই। গিয়া কলের পানিতে গোসল করলেই হবে।
দুপুর বেলা ফজল মিয়ার বাড়ি পৌছলো। হাত মুখ পা কলপাড়ে ভালো করে ধুয়ে নিলো। তারপর খানকা ঘরে বসতে দিলো। গ্রামের বাড়ি চেয়ার টেবিলের বালাই নেই। চৌকির উপর নকশি কাঁথা বিছিয়ে দিয়েছে। এটাই গ্রামের প্রচলিত রীতি।
দুপুরের খাবার পর সামনে পাত্র হাজির করলো।দেখতে শুনতে ভালোই। সুদর্শন বটে। স্বাস্থ্যও ভালো। অনেক গুনকীর্তন শোনালো পাত্রের চাচা। বাড়িতে দুটি টিনের চালা ঘর। বেশ বড়। জমি জমা অনেক। পালে গরু মহিষ মিলে চৌদ্দটি। নুরল এই গরু মহিষ দেখা শোনা করে।
পাত্র তাদের পছন্দ হলো। দিন ক্ষণ শীঘ্রই জানানো হবে বলে জানালো ওছিমুদ্দিন।
এবার বাড়ি ফেরার পালা
আকাশ ভরা শরতের সাদা মেঘের ভিড়ে গ্রামীণ ঐতিহ্যে আড়ম্ভরে তুলির শাদী মোবারক সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। উল্লেখ্য যে গামীণ রক্ষণশীল ধারা অনুসারে বিয়ের ব্যাপারে পাত্র পাত্রীর মতামতের কোন গুরুত্ব দেয়া হতো না। পছন্দ অপছন্দ মূল্যহীন। আপত্তির সুর তোলা তো দুরের কথা,ভাবতেও পারতো না। তৎকালীন অভিভাবকগণের ভাস্য ছিলো -গরুর কাছে জিজ্ঞাসা করে কী লাঙল জোয়াল কিনবো নাকী? আসলে পাত্র পাত্রীকে তাই ভাবা হতো। নির্বাক বোবাই ধরা হতো। তাদের যেন বাক স্বাধীনতা থাকতে নেই। বর পক্ষ নতুন বউ নিয়ে রওনা হলেন। ছৈ ওয়ালা গরুর গাড়ি কাপড়ের পর্দা লাগিয়ে বর কনে উঠালেন। গাড়িয়াল হেটহেট ঠাই ঠাই করে গাড়ি ছেড়ে দিলো।
চলবে