ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ৯)

রূপকথা পৃথিবীর

আকাশ এখনো আমাদের গ্রামে আসে ?
ধান মাঠে নামে রাত কোজাগরী চাঁদে ?
শিমূলতলায় মাতাল ফাগুন হাওয়া ,
চলে যেতে গিয়ে আবার লুটিয়ে কাঁদে ?
আচ্ছা ,তোরা আমাকে বুঝিয়ে বল তো , ফুটবল মাঠে হেরে যাওয়াটাও তো একটু এনজয় করতে হয় ! তার ওপরে অঙ্ক পরীক্ষায় এমন ঝাড় খাওয়া ! সেটাও তো খেলার মাঠের বন্ধুদের সাথে , চুপিচুপি আদান প্রদান করতে হয় !
তাই না ? অঙ্কে মাত্র আটাত্তর পেলাম ! এরকম ধ‍্যাড়াবো আমি নিজেই ভাবতে পারিনি । অথচ, ভীষণ ভালোবাসার অঙ্ক স্যার অজয়বাবু আমাকে সস্নেহে বললেন– পরিচয়, ইদানিং খেলাধুলোর দিকে একটু বেশি মন দিচ্ছো,তাই না ? বিপ্লবের ভাই হয়ে অঙ্কে মাত্র আটাত্তর ! ছিঃ ! এটা তোমার থেকে আশা করা যায় না ! বিপ্লব কোনদিনও একশোর কম পায়নি । আমি মাথা নিচু করে কোনমতে জবাব দিলাম — স্যার , হাতের পাঁচটা আঙুল কি একরকম হয় ? উনি কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন শুনে। জবাবটা মোক্ষম এল — তাই বলে একশোর জায়গায় মাত্র আটাত্তর ? আর খাতা ভর্তি সিলি মিসটেক ! আমার তো তোমার খাতা দেখতেই ইচ্ছে করছিল না । ব‍্যস , ওইখানেই থেমে গেলেন উনি । আচ্ছা তোরা বলতো , বাড়িতে কেউ আমাকে কিছু বলল না কেন ? আমি দুঃখ পাবো বলে ? আমি দাদার মত হতে পারিনি বলে ? দূর বাবা ! আমার মাথার মধ‍্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ।
আচ্ছা , মহালয়ার পরে এত তাড়াতাড়ি পুজোটা চলে আসে কেন বলতো ? অন‍্য সময় তো সাত আট দিন কাটতেই চায় না ! আর , পুজো আসা মানেই তো চলে যাওয়া ! পুজো আসছে আসছে করতে করতে, সঙ্গে সঙ্গে বিজয়াদশমী চলে আসে । আমাদের তো আবার পরিবারসুদ্ধ গিয়ে মামার বাড়িতে পুজো কাটানো ! দক্ষিণ কলকাতার এলাহি আয়োজনের মধ্যে পাঁচ পাঁচটা দিন যেন মুহূর্তে কেটে যায় ! আর আমার মন পড়ে থাকে তোদের সঙ্গে , বিশ্বাস কর । আচ্ছা, আমরা ফুটবলে ফাইনালে নিজেদের দোষে যে হেরে গেলাম , তার জন‍্য কমলদার কাছে গিয়ে সবাই মিলে ক্ষমা চাইতে পারলাম না ? পুজো এসে সব ধুয়ে মুছে দিলো ! যেন ফাইনাল খেলাটাই হয়নি ! আর , বিজয়াদশমীর পরে দেখতে দেখতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো এসে গেল। উফ , সেকি বিশাল চাঁদ রে ভাই ! আমাদের খেলার মাঠের ওপরে যেন সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে রাতকে দিন করে দিচ্ছে ভর সন্ধেবেলাতেই । এই পাড়ায় বেশিরভাগ মানুষই পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম ,ঢাকা, বিক্রমপুর, বরিশাল থেকে আসা। মানে ,খাঁটি বাঙাল , সবাই ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার । আমরাই কয়েকটা বাড়ি শুধু মোহনবাগান । সবারই কোজাগরী পূর্ণিমার দিন লক্ষ্মীপুজো। শুধু সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি ভোগ খেয়ে বেড়ানো। ভাবা যায় ! যশোরের মানুষ , আমার বাবা-মাও দেশভাগের শিকার । অথচ ,আমাদের লক্ষ্মীপুজোটা কালীপুজোর দিন । কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে । মা বলে — ওটা মহালক্ষ্মী পুজো । আর বন্ধুরা ক্ষ্যাপায় ওটা অলক্ষ্মীপুজো । সবথেকে লজ্জা লাগে — সন্ধে লাগার আগে , কালীপুজোর দিন যখন সবাই বাজি পটকা নিয়ে রেডি, স্টেডি গো … আমাদের বাড়িতে তখন পুজোর সামনে চুপচাপ বসে থাকতে হচ্ছে । তারপর পুরোহিত মশাই কলার পেটোতে চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি করা অলক্ষ্মীকে পুজো করে , আমার হাতে লাঠির মতো দেখতে একটা আখের টুকরো আর একটা কুলো ধরিয়ে দিচ্ছেন ; দাদার হাতেও সেই কলার পেটো, আরেকটা মাটির প্রদীপ। সারা পাড়া দেখছে–আমি কুলো পেটাতে পেটাতে যাচ্ছি ,আর দাদা ধরো লছমন হয়ে,নির্বিকার মুখে সেই অলক্ষ্মী বিদায় করতে, ধান মাঠের এক প্রান্তে ছোট্টো জলার কাছে চলেছে । আমি লাজে রাঙা কনে বউয়ের মতো দাদার পিছন পিছন ফলো অন করছি । আমরা দুজনেই বিড়বিড় করে বলছি– অলক্ষ্মী বিদায় হও, মা লক্ষ্মী ঘরে এসো…আমার আবার কথা উল্টে বলার বেআক্কেল স্বভাব , তাই যেই বলতে গেছি–মা লক্ষ্মী বিদায় হও, অলক্ষ্মী ঘরে এসো… অমনি আমার রসিক দাদাভাইয়ের ফিচেল হাসি–কী হচ্ছে ঝন্টুবাঁদর , পুজো নিয়েও ঠাট্টা করছিস ? বাবা জানতে পারলে না …..
আমাদের এদেশী কালচার । বাবা-মা নিজেদের বাঙাল বলতে ভালোবাসে না । পাড়ার লোকেও আমাদের বাঙাল বলেনা। বলে — যশোরের লোক আবার বাঙাল কবে হল ? আবার এদেশের লোকেরা বলে — তোরা তো যশোরের বাঙাল । কি যে করি ছাতার মাথা ! মা একদিন আমাকে বুঝিয়ে বলল — আমরা বাঙালও নয় ,ঘটিও নয় ,আমরা হলাম বাটি । মানে বাঙালের বা আর ঘটির টি মিলে বাটি । ব্যাপারটা আমার বেশ পছন্দ হলো ।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো মিটে গেলেই আমরা ছুঁচোবাজি আবিষ্কর্তা হয়ে পড়ি , আর আমাদের ধ‍্যানজ্ঞান কখন যে খেলার মাঠ থেকে সরে গিয়ে ছুঁচোবাজিতে আটকে যায় , তোদের কী করে বোঝাবো রে পাগলা ! বাবা পইপই করে বারণ করে, ছুঁছোবাজি কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিস। কারোর ঘরে ঢুকে গেলে কেলেঙ্কারী। অথচ আমাদের নিসপিস হাতে , ছুঁচোবাজি রকেটের মতো খেলা করে , হুশ করে উপরের দিকে উড়ে যায় । আরে বাবা, বললে হবে ? ছাড়বার কায়দা আছে না ! তুমি যেমন উড়ন তুবড়ি আর বসন তুবড়ি তৈরি করতে পারো , আমরা কি পারি ? আমাদের বুড়ো আঙ্গুলে এত জোর নেই যে , লোহাচুর ঠেসে ঠেসে ঢোকাবো । ওসব তুমি পারো ; আমরা তাই ছুঁছোবাজি নিয়েই খুশি ।
সাত আট দিন ধরে শুধু গাদাগাদা ছুঁচোবাজি তৈরি হচ্ছে , আর সেগুলো জমা হচ্ছে শ্যামলদের ছাদের ঘরে । ওদের ওখানে কেউ চট করে উঁকি মারবে না , তাই । আর এই ছুঁচোবাজি তৈরি করতে গিয়েই শ্যামলের সাথে আমার কিচাইন হয়ে গেল । আচ্ছা , এটা কি এমন খারাপ কথা ! আর , আমিতো শ্যামলকে খুব একটা জ্ঞান দিতে চাইনি। ও আমাকে বেপাত্তা করতেই ,সটান উঠে দাঁড়িয়ে বললাম — আমি তোদের সঙ্গে নেই । এত এত ছুঁচোবাজি গাঁথতে গাঁথতে আমার হাত ক্ষতবিক্ষত। শেষ পর্যন্ত শ্যামল ভাগ্যিস ঝামেলিটা মিটিয়ে নিলো !
আমরা এখন বেশ কয়েকটা খারাপ খারাপ কথা শিখে গেছি ,যদিও সবার সামনে শালাটাও বলতে পারিনা । তবুও খারাপ কথা শেখার একটা নেশা আছে , তাই না। হুঁহুঁ বাবা, এবারে সিক্সে উঠবো , একটাও খারাপ কথা না শিখলে চলে ? স্কুলে যেসব ওপরের ক্লাসের মার্কামারা দাদারা আছে , তাদের গালাগাল তো কোন অক্ষর মানে না !
আমাদের কানদুটো কি তুলো দিয়ে বন্ধ রাখবো ?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *