• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ১৬)

রূপকথা পৃথিবীর

তুমি আকাশ হয়ে ডাকো,
থাকো ছোট্টবেলার নামে,
তুমি জন্মভূমির স্মৃতি,
যেন তাল তমালের গ্রামে।
তুমি প্রথম গানের কলি,
যখন ভাঙ্গা মন থমথমে,
মাগো তোমার সুরের ধারা,
আমায় ফিরিয়েছে সরগমে।
আচ্ছা, তোমাদেরকে আমি মা’র ছোট্টবেলার খেলার সাথী দুগ্গা আর পরীর কথা বলেছি ? হতদরিদ্র দুই বোনের আজও বিয়ে হয়নি , সেলাই ফোঁড়াই আর এটা ওটা সেটা করে দিন গুজরান করে ।তবু দুই বোনের মুখের হাসি কখনো অমলিন হয়না। শোকের প্রথম ধাক্কাটা সামলে সবাই যখন চলে গেল, তখন শুধু সেই দূগ্গা আর পরীমাসি মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকল। আমাদের ভাই ,মানে দিদিমা বন্ধ দরজা খুলে তখনও বড় জামাইয়ের প্রতি কর্তব্য করছে–ও নীলমণির মা, শচীনকে একটু জল খাবার দাও, চা দাও । বাবা থমথমে গলায় বলে উঠলো –না মা, আজ আর কোন কিছু দরকার নেই । মা হঠাৎ বাবার দুটো হাত জড়িয়ে বলল–ওগো শুনছো, আমার শিখা এ খবর শুনেই তো সারারাত কান্নাকাটি করবে; তুমি বরং ঝন্টুকে আজ সঙ্গে নিয়ে ফিরে যাও । ও দিদিকে ঠিক সামলাতে পারবে । আমি চুপ করে বসে থাকলাম। জানি , এখানে আমার কোন ভূমিকা নেই। তবু আমার প্রাণ যেন বারবার ছুটে যেতে চাচ্ছে আমাদের সবুজে সবুজ গ্রাম দক্ষিণেশ্বরের দিকে ।
কী আশ্চর্য ! এত বড় ঘটনা ঘটে গেল ,অথচ দিদি এখনো কিচ্ছু জানেনা ? মঙ্গলাদি চলে যাবার পর দিদি ঘরবার করবে , আর বাবার সেই মচমচ করা জুতোর আওয়াজ শোনার অপেক্ষায় পাড়ার কুকুরগুলোর চিৎকার থামাবে। দিদি এমনিতেই খুব সাহসী । খবর তো একটা পাঠাতেই হবে ।আর তা নয় তো , বাবাকে ফিরে যেতেই হবে । নীলমণির মা রান্নাঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বাবাকে বুঝিয়ে বলল–ও বড় দাদাবাবু ,আমার তো তিনকূলে কেউ নেই গো ! আমার ঘরের দরজা তালা বন্ধ থাকলেও কিচ্ছু হবে না । আমি আজ সারারাত মলিনাকে পাহারা দেবো, আর ভাইগুলো ফেরা পর্যন্ত দরজা খুলে রাখবো। আপনার কোন চিন্তা নেই।ঝন্টুটা অনেকদিন এখানে পড়ে থেকে থেকে… দাঁড়ান আমি শিগগির ওর ব‍্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছি । মা বোধহয় খানিক্ষণের জন্য হলেও সুস্থ হয়ে উঠেছিল ; কোন অসংলগ্ন কথা না বলে শান্তভাবে বাবাকে বললো– ওগো শুনছো..ঝন্টু তিন-চারদিন বাড়িতে থাকুক, সমুটা তো শিখার প্রাণ ছিল । তবুও ছোটভাইটাকে পেলে… যাও , তুমি আর দেরি কোরো না ..কিসে ফিরবে ? বাসে না ট্রেনে ?
রাত সাড়ে আটটা। আমি বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি রাসবিহারীর মোড়ে। চেতলা কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে , পাঁচ সাত মিনিটের রাস্তাটুকু বাবা আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছিল, একটাও কথা বলছিল না। বাবাকে এমন থম মেরে যেতে আমি কোনদিন দেখিনি। রাসবিহারীর মোড়ে যেন উৎসব চলছে। কত আলো, কত বিজ্ঞাপন ! মানুষ দেখেশুনে রাস্তা পার হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশ পাহারা দিচ্ছে । কোথাও কোনো ছন্দপতন নেই। কিন্তু এখান থেকে মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার দূরে বারাসাতে , নবপল্লীর কাঁঠালতলায়, কোনো বাড়িতে হয়তো আজ হাঁড়ি চড়েনি। সারা পাড়া মাতিয়ে রাখতো যে সবসময় , সে এখন হাসপাতালের মর্গে। ভগবান, এত নিষ্ঠুর কেন তুমি?
বালিগঞ্জের দিক থেকে টু-বি দোতলা বাসটা হেলতে দুলতে মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়ালো। এই বাসটায় আমরা সোজা চলে যাব শ‍্যামবাজার, তারপর তিন নম্বর বাসে করে দক্ষিণেশ্বর । অন্যদিন হলে আমি বাবার হাত ছাড়িয়ে দোতলায় উঠে যেতাম। আজকে আমিই বাবাকে ছাড়লাম না । উঠে এলাম দোতলায়। প্রায় ফাঁকা একটা বাস পথের ধারের ডালপালায় ঠোক্কর খেতে খেতে ডিগ-ডিগ করে এগিয়ে চললো রবীন্দ্রসদনের দিকে।
অনেক রাতে দক্ষিণেশ্বরে নামতেই ,সমস্ত গ্রামটা যেন আমাদের জিজ্ঞাসা করল– সমু আর নেই ? কেন?কেন? কেন?
সাধারণত বাবা আর আমি থাকলে , এই পথটুকু হেঁটেই ফিরি। আজ কিন্তু একটা ক্লান্ত রিক্সার উপরে বাবার ফুটবল খেলোয়াড় শরীরটা যেন এলিয়ে পড়লো। আমি আমার ব্যাগ সামলে বাবার পাশে গুটিসুটি মেরে বসলাম। এত দুঃখের মধ্যেও আমার হাসি পেল একটা কথা ভেবে। মা আর বাবার চেহারাটা বেশ গোলগাল। কাজেই একটা রিকশায় বসলেই ….
বাবা ব্যাপারটা ম্যানেজ করার জন্য বলে উঠতো– বুঝলে, আজকাল রিকশাগুলো বড্ডো ছোট ছোট মাপের হয়ে গেছে , তাইনা ? মা তো অনন্ত রসিকতার ভান্ডার। সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিত — হ্যাঁ , তাতো বটেই, আমাদের দেখলেই ভয়েই ছোট হয়ে যায় , এমনি সময় অনেক বড় থাকে। বাবা বোল্ড আউট হয়ে গিয়ে , আলতো খুকখুকে কাশির ভনিতা করে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নেয় ।
পাড়ার মোড়ে রিক্সা ছেড়ে দিয়ে আমরা যখন বাড়ির সামনে এলাম , টিউবলাইটের চকচকে আলোয় বাইরের ঘরের খাটে একটা গাঢ় নীল ফ্রক পরে আমার দিদি ঘুমিয়ে আছে। টুকরো বাগানে মায়ের হাতে লাগানো নীল অপরাজিতা ফুল যেন…. জানলার পর্দা সরানো । আমি নিশ্চিত জানি ও বাবার পায়ের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে ।
বাবা কেমন কান্না কান্না গলায় বলল– শিখা,শিখা মা , দরজাটা খোল । আমার দিদি এই বয়সেই এতটা বুদ্ধিমতি যে, নিমেষের মধ্যে ধরে ফেলল , কিছু একটা অঘটন ঘটেছে । কিন্তু সেটা যে ফুলের মতো সমুকে ঘিরে , সেটা ভাবার মত ক্ষমতা ওকে ভগবান দেয়নি। সে রাতে আমরা তিনজনের কেউ একগাল ভাতও মুখ দিয়ে নামাতে পারলাম না। দিদি কিন্তু অনেক চেষ্টা করেছিল আমাকে খাইয়ে দিতে। খানিক চুপ করে বাবা বললো — হ‍্যাঁ রে শিখা , মঙ্গলা আজ রুটি করে যায়নি ? মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপতে চাপতে দিদি বললো– মঙ্গলাদি আজকে আসেনি বাবা। মুখ ধুয়ে এসে , একটা চিঠি লিখতে বসলো বাবা ; মাসি মেসো আর ছন্দাকে উদ্দেশ্য করে। অনেক রাত পর্যন্ত বাবা মন খুলে লিখল তাঁর কান্নার গল্প । পরের দিন সকালবেলা চা খেতে খেতে বলল , তোরা সাবধানে থাকিস, আমি বারাসাত চললাম । সমুর শেষ কাজটায় আমি অন্তত ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। শিখা, দেখ তো ঝুড়িতে শাকসবজি কিছু আছে কিনা ! আজ তো আবার বিলু আসবে হোস্টেল থেকে । বাবাকে কোন কথা বলতে না দিয়ে দিদি বললো– সে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো। তুমি আমাদের চিঠিটা পড়ে শোনাবে না ? কী মর্মস্পর্শী ,কী আশ্চর্য মন খারাপের সেই ভাষা ! তিন পাতার চিঠিতে আমাদের বাবা ছোট্ট সমুর জন্য যেন একটা রূপকথা লিখেছে। আমার মনের মধ্যে দোলা দিচ্ছিল ওই জায়গাটা– শোন খুকু,আমাদের সমু সংসারে থাকতে আসেনি। ও তো সবসময় নাচের তালেই থাকতো, সবসময় সমস্ত মানুষকে আনন্দে ভরিয়ে রাখতো। ঈশ্বর বোধহয় তাঁর বাগানের জন্য ওকে বেছে নিয়েছেন। তুই দেখিস, ও সেখানে পারিজাত হয়ে ফুটে থাকবে । আয়, আমরা আকাশের একটা তারাকে খুঁজে নিয়ে, তার নাম দিই সমুর নামে ।
বেলা এখন পৌনে এগারোটা । দিদি আমাকে জোর করে স্কুলে পাঠালো। আমি জানি, এভাবে ক্লাসে ঢোকা যাবে না । আমাদের স্কুল নিয়মকানুনের দিক থেকে খুব কড়া। তাই ইচ্ছে করেই প্রেয়ারের পরে স্কুল গেট দিয়ে ভিতরে পা রাখলাম । গেটের সামনে উমাশঙ্করদা আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো। দুপাশে দুটো ঝাউ গাছ একটু নুয়ে পড়ে বললো– ও মা, এত দিন কোথায় ছিলে গো? ছোট্ট একমুঠো ধুলো ঘূর্ণি তুলে বললো — এসো এসো ঝন্টু মহারাজ,ওয়েলকাম…ওয়েলকাম।এতদিন কোথায় ছিলে?
আমি হেডমাস্টারমশায়ের ঘরে ঢোকার ভারী পর্দার এপাশে দাঁড়িয়ে আছি। উমাশঙ্করদা আমার পিঠে হাত রেখে বলছে –যাও, যাও না, ঢুকে যাও। হেডস্যার এখন একাই আছেন ।
আমার গলা দিয়ে কিছুতেই বেরোচ্ছে না — মে আই কাম ইন স্যার ?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।