• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ২৯)

রূপকথা পৃথিবীর

মা বাবা যখন থাকবে না ,
সেই দিনগুলো নিয়ে ভাবি ,
কার কাছে যাবো ? কোথায় দাঁড়াবো ?
সব ঘরদোরে চাবি ।
বৃষ্টিতে ভেজা ,জোছনায় ধোয়া ,
যশোরের বাড়িটায় …
পাসপোর্ট করে যেতে হয় নাকি ?
ভাবলে কান্না পায় !
দিদি তুই দেখবি , কোনো মানে নেই , তবু যেন ভয়ংকর সত‍্যি কথাটা বাবা একটা ইংরেজি প্রবচনে বলেছিলো — মিসফরচুন নেভার কামস অ্যালোন । দুর্ভাগ্য যে কখনও একা আসে না , এটা মানতে না পারলেও , আমাদের মতো অনেক হতভাগা পরিবারের ক্ষেত্রে বোধহয় কথাটা ঠিক । তা নয়তো , মামার বাড়ির চার পাঁচ দিনের হৈ হুল্লোড়ের পরে বাড়ি ফিরে , তুই যখন সব কিছু বন্ধ রেখে , পাগলের মতো , সামনের বছরের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার জন‍্য উপুড় হয়ে পড়েছিস ,তখন একটা ভয়ংকর রোগ থেকে সেরে ওঠা মা , আবার থমথমে মুখে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করবে কেন ?
হারমোনিয়াম ছুঁয়েও দেখছেনা । তোকে আমাকে বাবাকে মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলছে — আমাদের বাড়ির চারপাশে কারা ঘুরঘুর করছে ? সারারাত্তির জানলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকছে ,আমাকে খুন করবার জন‍্যে ? আসলে , ছোটো মাসির বিয়েটা মন থেকে মেনে নিতে না পারায় , আমাদের সাত চড়ে রা না কাড়া মা , বাবাকেই সম্পূর্ণ দায়ী করছে । বাবার ষড়যন্ত্রেই নাকি ছোটোমাসির বিয়েটা ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে লেগেছে’র মতো করে সাত তাড়াতাড়ি দিতে হলো । এক সপ্তাহ ধরে বাবা দাদা তুই আমি , মাকে বুঝিয়েও পারলাম না যে , এর চাইতে ভালো বিয়ে ছোটোমাসির হতো না । একে তোর পরীক্ষার কথা ভেবে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে । নাইন টেন ইলেভেনের সব সাবজেক্টের পড়া মুখস্ত রাখা ! তার ওপর তোর ফোর্থ সাবজেক্ট আবার বায়োলজি । খাটুনির শেষ নেই । ঠিক এই সময় , মা আবার সেই অবুঝপনা শুরু করলো । টেস্ট পরীক্ষার পর প্রতিদিন নিয়ম করে শুধু মুখ গুঁজে বারো তেরো ঘন্টা পড়তে হবে বলে , যখন তুই আদা জল খেয়ে লেগেছিস ….
তখনই মা আবার ক্রমশ যেন লাগামছাড়া হয়ে উঠতে লাগলো । তোর তো তবু সামনের বছর মার্চে পরীক্ষা । আমার কী হবে ? আমার তো সামনেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা । গত পরশুদিন যখন মা’র অর্থহীন চিৎকার চেঁচামেচিতে তোর একটা গোটা সন্ধে নষ্ট হয়ে গেলো , আর তুই রাগে দুঃখে ফিজিক্স , কেমিস্ট্রি , ম‍্যাথামেটিক্স , বায়োলজি বইগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগলি , তখন ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া আমি একটা কথা বুঝতে পারলাম — তোর আচরণ আর মার আচরণের মধ‍্যে কোনো পার্থক্য নেই । দাদা শান্ত মনে বইগুলো কুড়িয়ে পড়ার টেবিলে গুছিয়ে রাখলো । তারপর ও যা কোনোদিন করেনা , সেই নরম পরিপাটি মেজাজটা আর ধরে রাখতে পারলো না ।গমগমে গলায় চিৎকার করে…..
বাবা খানিকটা হতভম্বের মতো বলে উঠলো — একজন মেন্টাল পেশেন্টকে তোরা এইভাবে বকাঝকা করছিস কেন ? দাদা দিদি মাথা নিচু করে পরিস্থিতিটা সামলাতে চেষ্টা করছে । মা অঝোর ধারায় কেঁদেই চলেছে , আর বাবার দিকে আঙুল তুলে বলছে — ষড়যন্ত্র , ষড়যন্ত্র , সব তোর বাবার ষড়যন্ত্র । ঘরের টিউবলাইটটা হঠাৎ দপদপ করে জ্বলতে জ্বলতে আয়ু ফুরিয়ে নিভে গেল । আমি ভূতের মতো উঠে , চল্লিশ পাওয়ারের বাল্বটা জ্বেলে দিতেই , যেটা সবার প্রথমে লক্ষ্য করলাম — সাদা আলোতে যা বোঝা যায় না , কম পাওয়ারের হলুদ আলো তাই প্রকট করে দিয়েছে । আমাদের বাবা নামের সেই বটগাছটা হঠাৎ কেমন ভেঙেচুরে দুমড়ে গেছে।
বাবার মুখে আবছা কালো কালো ছোপ ।
সম্মানের সঙ্গে পাশ bকরেও ,দাদার তেমন ভালো চাকরি জোটেনি এখনও । সামনের মাস থেকে কল‍্যাণীর সেন পন্ডিত কোম্পানিতে গ্র‍্যাজুয়েট ট্রেনি হিসেবে জয়েন করবে । ট্রেনিং মানে যে চাকরি নয় , তা বাবা আর দাদার আলোচনা থেকে আমিও বুঝতে পেরে গেছি । মায়ের অসুস্থতার কারণে , মানসিক বিপর্যস্ত দাদা শেষ পর্যন্ত ফার্স্ট ক্লাস পায়নি । তাছাড়া , ও তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেও চায়নি । আমাদের সংসার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে দেখে , বাবা ধীরে ধীরে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে । আচ্ছা দিদি , বাবার যদি কিছু হয়ে যায ,আমাদের কি হবে ?
সেই রাতটা আমরা কেউই কিছু মুখে তুলতে পারলাম না । পরদিন সকালে আবার শান্ত হয়ে যাওয়া মা , তোকে জড়িয়ে ধরে , যখন ডুকরে কেঁদে উঠে বললো — শিখা , আমাকে তোরা চেতলায় আমার বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দে । তা নয়তো ,তুই পরীক্ষায় পাস করতে পারবি না । তখন আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না । সিঁড়ির ঘরে পড়ে থাকা এ বছরের ছোট্টো সরস্বতীর মূর্তিটাকে আকুলভাবে জড়িয়ে ধরে বললাম — আমি জীবনে কিছু হতে চাই না , শুধু পড়াশুনো করতে চাই । শুধু তোমার পায়ের কাছে সারা জীবন বসে থাকতে চাই । আমাকে দিদিকে এভাবে বঞ্চিত কোরো না । মাকে ভালো করে দাও ঠাকুর ।
হঠাৎ দুটো স্যুটকেস সমেত মামার বাড়িতে ঢুকতেই , বাবাকে নতুন করে কিছু বলতে হলো না । মেজো মামা তখন সবে অফিস থেকে ফিরেছে ; যেন কিছুই হয়নি এমন করে বললো — দাদাবাবু আপনি কিছু ভাববেন না । বড়দি মাসখানেক এখানে থাকুক । ঝন্টুর যদি অসুবিধে না হয় , তাহলে ও এখানেই পড়াশুনো করুক । পরীক্ষার সময় না হয় কদিনের জন্য চলে যাবে । ছোটোমামা এসে মাকে জড়িয়ে ধরে , চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললো– বোস বড়দি , তুই আর ঝন্টু আসার ফলে আমাদের খুব উপকার হলো । সামনেই বিধানসভা নির্বাচন । ঝন্টুর এনার্জিটা কাজে লাগবে । আর তুই , মণিদাকে কতগুলো গান তুলে দিবি ।সলিল চৌধুরী , হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান । এবারে যুক্তফ্রন্টকে জেতাতেই হবে । চেতলা পার্ক আর দেশপ্রিয় পার্কের জনসভায় জ্যোতি বসু আসছেন । ঝন্টু , তোকে দুটো কাজ করতে হবে । এক হচ্ছে , কৌটো ঝাঁকিয়ে পয়সা তুলবি মিটিংয়ের দিনগুলোতে। আর , সামনের রোববার , ব্রিগেডে , মানে লাল ময়দানে যে বিশাল জনসভা হবে , তার জন‍্যে আমাদের বাড়ি থেকে একশোটা খাবারের প্যাকেট যাবে , গ্রাম থেকে আসা কমরেডদের জন্যে । তুই রুটি বেলাটা শিখে নিবি । ভোরবেলা উঠে পড়াশোনা করে নিবি , আর বিকেল বেলাটা আমাদের সাথে পার্টি অফিসে গিয়ে হাতে হাতে কাজ করবি।
এত দুঃখের মধ্যেও আমার হাসি পেলো , জানিস দিদি । আসলে সবাই আমাকে বাবাকে আর মাকে বোঝানোর চেষ্টা যে , তোমরা আমাদের বোঝা নও । আচ্ছা দিদি , এই বয়সে আমি এত বুঝতে শিখে গেলাম কি করে রে ? বাবাকে দেখলাম — এই প্রথম নিঃশব্দে কাঁদছে । কান্না লুকোবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না ।
বড়ো মামার চাকরির পোস্টিং এখন কৃষ্ণনগরে। পি এন্ড টি-র কর্মী আমার বড়ো মামা , সপ্তাহের শেষে কলকাতায় ফিরে এসে , কম্যুনিস্ট পার্টির কাজে লেগে পড়ে । আমার ভেঙ্গে যাওয়া মনটা , ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠলো । মামার বাড়ির সকলের স্থানীয় নেতা , কলকাতা কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র মণি সান্যাল , সকলের ভালোবাসার মণিদা । তিনি যেন সমস্ত চেতলাবাসীর অভিভাবক । সবাই তাই মণি সান্যাল বলতে অজ্ঞান । যদিও , পাঁচ মামাই সিপিএমের সমর্থক , আর মণি সান্যাল সিপিআই নেতা — তবুও মামাদের কাছে তিনিই সত‍্যিকারের নেতা ।
সেদিন বাবা বেশ রাত্তির করে খাওয়া-দাওয়া সেরে , চলে গেলো । ছোটৌ মাসি ছুটে এসেছিল বড়ো দাদাবাবু এসেছে শুনে । বাবাকে আশ্বস্ত করে বললো– আমি বড়দিকে দেখবো। সারা দিনে দু তিনবার আসবো , বিশেষ করে সন্ধের পরে । আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন খুব ভালো । ওরা কেউ কিছু মনে করবে না । ছোটো মেসো এসে দেখা করে গেলো বাবার সঙ্গে। আজকে সারা সন্ধে বাবা গোনাগুণতি দু’তিনটে যে কথা বললো , তার মধ্যে অন্যতম কথা — মাকে বোধহয় আবার মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে । ভাগ্যিস মা সে কথা শুনতে পায়নি !
দিদি এত তাড়াহুড়োর মধ্যেও আমার বই খাতা সব গুছিয়ে দিয়েছিলো।এই চোখের জলের মুহূর্তগুলোতে আমার ওকেই মা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে ।
পরদিন দুপুরে , যখন মেজো মামার ঘরে বসে মন প্রাণ এক করে অ্যানুয়াল পরীক্ষার পড়াশুনো করে যাচ্ছি , হঠাৎ চোখে পড়লো — মেজো মামার বইয়ের আলমারিতে যে বইগুলো সাজানো রয়েছে , বা কতগুলো বইয়ে খবরের কাগজ ছিঁড়ে পেজ মার্ক দেওয়া রয়েছে — তা আমি কখনো আমাদের বাড়িতে দেখিনি । একটা একটা করে হাতে নিতেই বুকের ভিতর কেমন দামামা বাজতে থাকলো। জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন , মার্কসীয়- লেনিনীয় তত্ত্ব দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অ-আ-ক-খ , কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রসঙ্গে , ভি আই লেনিন- এর রাষ্ট্র ও বিপ্লব , লিউ শাও চি-এর কমিউনিস্ট পার্টি প্রসঙ্গে , সাচ্চা কমিউনিস্ট কি করে হতে হবে , আর মাও সে তুং-এর জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও তার সঠিক সমাধান । বইটা দেখেই চমকে উঠলাম ! আমাদের ইস্কুলের পাঁচিলে এই মুখটা স্টেনসিল ছবিতে আঁকা থাকতে দেখেছি , যার নিচে লেখা — ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।’ ‘কমরেড মাওয়ের চিন্তাধারা দিকে দিকে ছড়িয়ে দিন।’ আমি অবাক হয়ে ভাবলাম– গান করতে না পারা ,আবৃত্তি না জানা আমাদের মেজো মামা কী দারুণভাবে একজন যোদ্ধা হয়ে উঠছে ! পড়ে থাকলো আমার পরীক্ষার পড়া । একটা একটা করে বই খুলে , পাতার পর পাতা ওল্টাতে লাগলাম । কখন মেজো মামা অফিস থেকে এসে , আমার পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছে , আমি দেখি নি । সঙ্গে দুকাপ চা। শান্তভাবে বললো — বড়দি ভালো আছে তো ? আমি নিঃশব্দে বললাম — হ্যাঁ । মেজো মামা বললো– শোন , আমাদের দেশটা কিন্তু মূলত কৃষিপ্রধান। তাই , উত্তর বাংলার কৃষকরা যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে , সেটা নিয়ে আমরাও পার্টির মধ্যে দ্বন্দ্বে আছি । সর্বহারার বিপ্লবে , শ্রমিকের নেতৃত্ব ? নাকি শ্রমিক-কৃষকের যৌথ নেতৃত্ব ? ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটেছিল । কিন্তু , আমাদের ভারতবর্ষের বেশিরভাগ কৃষিপ্রধান অঞ্চল । স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীও ভারতবর্ষকে চিনতে হলে গ্রামকে চিনতে বলেছেন। কিন্তু কলকাতা শহরের নেতাদের সেগুলো বোঝাবে কে ? উত্তরবাংলা ক্রমশ কৃষক আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠছে । আমাদের তো বুঝতে হবে সেগুলো । তাঁদের দাবি-দাওয়া , অভিমানকে , বঞ্চনাকে গুরুত্ব দিতে হবে তো ! ওখানকার নেতা চারু মজুমদার .……
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম– আচ্ছা মেজো মামা , চীনের চেয়ারম্যান কী করে আমাদের চেয়ারম্যান হয় ? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। মেজো মামা একটুও রেগে না গিয়ে বললো — গন্ডগোলটা তো ওখানেই । চীনদেশের ক্ষেত্রে যেটা সত্যি , সেটা আমাদের মাটিতে কতটা ফল দেবে , সেটা তো ভাবতে হবে ! আসলে কমরেড মাও -এর চিন্তাধারাটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে । তাই বলে চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান ? না , কখনোই নয় । আমিও মানি না সে কথা , যেমন মানি না , ভোট দিয়ে বামপন্থীরা এলেই দেশে স্বর্গরাজ্য নেমে আসবে । তবুও যুক্তফ্রন্টকে আনতেই হবে এইজন্যে যে , কেরালায় আর বাংলায় চিন্তাধারাটা অনেকটা এক রকম। যুক্তফ্রন্ট এলে কৃষকদের হাতে লাখ লাখ বিঘা জমি , যা বড়লোকদের আওতায় অনাবাদী হয়ে পড়ে রয়েছে ,তার সুষম বন্টন করতে হবে । তার ফলে ভূমিহীন কৃষকরা দুবেলা-দুমুঠো খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে । সেইজন্যেই আমাদের লোকসভা , বিধানসভায় যেতে হবে । আর , সেই কারণেই আমরা ভোটে জেতার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি । তুই এত চিন্তা করিস না । তোর যা মেধা , অ্যানুয়াল পরীক্ষায় এমনিতেই পাস করে যাবি । তুই বরং মায়ের অসুখটাকে , মানে তোর এই দুঃসময়টাকে সত‍্যিকারের কাজে লাগিয়ে , মেরুদণ্ডটাকে শক্ত করে তোল । একজন সত‍্যিকারের সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে হবে তোকে। বুঝিস , না বুঝিস , এই বইগুলো পাতার পর পাতা পড়ে যা । মায়ের অসুখটাকে আমল না দিয়ে , সন্ধের মিটিংয়ে মিটিংয়ে ঘুরে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় কর । হঠাৎ মেজো মামা আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো– জানিস , কেন আমরা বড়দিকে বারবার আমাদের বাড়িতে রেখে দিচ্ছি ? তার কারণ , আমাদের বংশ থেকেই এই রোগটা , এই ভয়ংকর দুর্বিপাকটা তোদের রক্তের মধ্যেও চারিয়ে গেছে। তুই আমি কেউই এই বিপদের বাইরে নই রে । আমরা শুধু দাদাবাবুর কথা ভাবি। এমন মানুষকে যদি আমরা না পেতাম , তাহলে আমাদের এত গুণী বড়দি , যার গান শুনে আমরা ছোটোবেলা থেকে বড়ো হলাম , তাকে অকালেই হারিয়ে ফেলতাম হয়তো। একমাত্র বড়োদাদাবাবু বুক দিয়ে আগলে রেখেছে তোদের এবং আমাদেরকেও । সেই কৃতজ্ঞতাবোধে আমরা সবাই মিলে তোদের পাশে আছি । আমি চোখের জল সামলাতে পারছিলাম না , কোনরকমে ধরা ধরা গলায় বললাম — মেজো মামা , কবে আমি মিটিংয়ে কৌটো ঝাঁকিয়ে পয়সা তুলবো ? আর লাল ময়দানে মিটিংয়ের জন্যে , গ্রাম থেকে আসা অভুক্ত কমরেডদের জন্যে , কবে আমি রুটি বেলবো ? কমরেড কথাটা আমার মুখ থেকে এই প্রথম বেরোলো । আশ্চর্য ! দিদি তুই বিশ্বাস কর , আমার একটুও অবাক লাগলো না ! মনে হলো , মেজো মামার রোগা হাতটা , রামমোহন , বিদ্যাসাগরের মতো হয়ে ,আমার হাতটাকে জড়িয়ে ধরেছে, আমি বুঝতে পারলাম — আমার নিজের হাতে গড়া রুটি কখনোই পরোটার মতো হবে না । একেবারে পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল করতে পারবো । আর , কমরেডরা সেই রুটি তরকারি খেয়ে , একমুঠো বোঁদে খেয়ে , লাল পতাকা উড়িয়ে, লাল ময়দান কাঁপিয়ে বলে উঠবে — ইনকিলাব জিন্দাবাদ !

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।