আরণ্যক বসু (এই নাটকের দুটি চরিত্র- অরুন্ধতী ইয়াসমিন-বয়স।
চব্বিশ, ষাটোর্ধ কবি নিমগ্ন সেন। সময়টা ভয়ঙ্কর কোভিড ১৯ আচ্ছন্ন, লক ডাউনের ভারতবর্ষ। কাজেই দুজনের সমস্ত কথা হয় স্মার্টফোনে। আবহে টিভির | খবরের আওয়াজ অবশ্যই করােনা সংক্রান্ত। কবির। রিংটোনে বেজে উঠলাে-জামাইকা ফেয়ারওয়েলের সুর)
কবি: হ্যালাে, কে বলছেন?
কণ্ঠস্বর ঃ (একটু নাভার্স হয়ে) আ, আমি আপনার একজন ভক্ত, মানে আপনার কবিতার মুগ্ধ পাঠিকা বলতে পারেন।
কবি ঃ আপনি আমার শ্রদ্ধা নেবেন। হ্যা আমি নিমগ্ন সেন বলছি। আমি কবি কিনা জানি না, তবে আমিও আপনার মতাে কবিতা ভালােবাসি। নামটা জানতে পারি কী? হ্যালাে আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?
কণ্ঠস্বরও সব শুনতে পাচ্ছি। এই আশ্চর্য কণ্ঠস্বরটা শুনবাে বলেই তাে ফোন আর মন এক করে বসে আছি। আপনি আরাে কথা বলুন, তারপর আমি কথা বলবাে।
কবিঃ ইন্টারেস্টিং! আমার এই বুড়াে বয়সের গলা শুনতে আপনার ভালাে লাগছে? আপনার নামটা বলুন।
কণ্ঠস্বর ঃ আপনি আমার প্রণাম নেবেন কবি। আমি অরুন্ধতী ইয়াসমিন।উত্তর চব্বিশ পরগণার সীমান্ত শহর টাকির কাছে একটা ছােট্ট গ্রামে থাকি। আপনি টাকিতে এসেছেন কখনাে?
কবিঃ ও হ্যা অনেকবার। ইছামতীর ওপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা। আপনি কৌশিক গাঙ্গুলীর ‘বিসর্জন’ দেখেছেন?
অরুন্ধতীঃ ওই সিনেমাটা আমার কাছে মহাকাব্যের মতাে মনে হয় কবি। ঠিক যেন ঋত্বিক ঘটকের কোনাে ছবি দেখছি! কিন্তু, আমাকে আপনি বলে ডাকছেন কেন? আমি আপনার মেয়ের বয়সী। মাস্টার্স-এর ফাইনাল ইয়ার। ইংরেজি সাহিত্যে।।
কবিঃ তুমি ঋত্বিক ঘটকের ছবির কথা জানাে? দারুণ ব্যাপার তাে। আমার ফোন নম্বর পেলে কোথায়?
অরুন্ধতী ঃ এ কেমন প্রশ্ন হলাে। কবি নিমগ্নর ফোন নম্বর আবার জোগাড় করতে হয় নাকি? সে তাে বাতাসেই ভেসে আসে।
কবিঃ (হা হা করে হেসে উঠে) বাঃ আমার বন্ধু হয়ে গেলে।
অরুন্ধতীঃ ও বন্ধু কিনা বলতে পারবাে না এক্ষুনি, তবে আমি আপনার শেষতম ভক্ত। ফ্যান। আপনার প্রেমের কবিতার ডাইহার্ড ফ্যান।
কবিঃ সার্টেনলি নট। আই অ্যাম নট এ ফিল্মস্টার ম্যাডাম। মাটিতে পা রাখা অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ আমি। বাজারে আদা, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে আমার ভুরু কুঁচকে যায়।
অরুন্ধতী ঃ অসম্ভব। বাজার করা আর পাঁচটা লােকের মতাে আপনি যে আদৌ নন, সেকথা আমি আর আমার বােন দুজনেই খুব ভালােভাবে জানি। আমার বােন স্বাতী ইয়াসমিন। ফিজিক্স অনার্স-এর ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। ফেসবুকে আমরা দুজনেই আপনার কবিতা কাড়াকাড়ি করে পড়ি। আচ্ছা আমি কি আপনাকে অমল কবি বলে ডাকতে পারি?
কবি ঃ (হেসে ফেলে) তা ডাকতেই পারাে, তাহলে তাে তােমাকে সুধা হতে হয়।
অরুন্ধতী ঃ আমি তাে সুধাই। তবে এ ক্ষেত্রে গল্পটা একটু অন্যরকম কবি। আমার অমল কবি পরিণত বয়সের বিখ্যাত মানুষ। আর এই আমি সুধা….
কবি ঃ কী হয়েছে তােমার?
অরুন্ধতী ঃ না না, তেমন কিছু না। লকডাউন উঠে গেলে একদিন আমাদের বাড়িতে আসুন, তাহলেই আপনার সুধার সঙ্গে দেখা হবে। আমাদের চারজনের পরিবার। বাবা অসুস্থতার কারণে সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়েছেন। আমার মা একটা হাইস্কুলের বাংলার দিদিমনি।
কবিঃ তােমার কী হয়েছে বলবে না?
অরুন্ধতীঃ অমল, সুধা, ঋতু হেমন্ত, ভরা শ্রাবণ, জষ্ঠি মাসের রােদ ছায়া দিন, আশ্বিনের নীলাকাশ, আর ফাল্গুন-চৈত্রের বনপলাশ আপনার ভীষণ ভীষণ প্রিয়। দেখেছেন, আপনাকে কতটা স্টাডি করেছি? আচ্ছা অমল কবি, আপনার দুটো প্রিয় চরিত্র হিসেবে অমল, সুধাকেই বেছে নিলেন কেন?
কবিঃ আমি সামান্য মানুষ। রবীন্দ্রনাথের সাগর-গভীরতা উপলব্ধির ক্ষমতা আমার নেই; তবু একটা কথা বলতে পারি, নিজের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখেই বলতে পারি, সুধা আর অমল রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ দুটি চরিত্র সৃজন। যাদের মুখ কোনােদিনও মলিন হয় না।
অরুন্ধতী ঃ মনে হচ্ছে আমার মাথার উপর কেউ পাহাড়ি কোনাে নির্জন ঝরনার জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। এই জন্যই তাে আপনি আমার অমল কবি, প্রিয় কবি।
কবিঃ আচ্ছা তুমি যে এত অন্তরঙ্গভাবে কথা বলছাে, বাড়ির মানুষরা কিছু মনে করছেন না?
অরুন্ধতী ঃ (হেসে ফেলে) আপনি সত্যিই ছেলেমানুষ। এই চরম দুর্বিপাকের দিনগুলােতে, আমাদের দু’কামরার ছােট্ট বাড়িটায় আমরা সবাই তাে সবার কথা শুনতে পাচ্ছি। এর মধ্যে গােপনীয়তার তাে কিছু নেই। সেই লকডাউনের শুরুতে আমি কয়েকটা লাইন লিখে আপনাকে শােনাবাে বলে অপেক্ষা করছি। বিশ্বাস করুন, ফোন নম্বরটা পাওয়ার পরেও ভীষণ নার্ভাস ছিলাম। আমার বাবা আমার সমস্ত নার্ভাসনেস কাটিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,- ওনার কবিতা পড়লেই বােঝা যায় উনি ভালাে মানুষ, তুই নির্ভয়ে ফোন কর। আর বােন তাে রাত্রিবেলা প্রতিদিন ঘুমোনোর আগে ফিসফিস করে বলে কালকে সকালেই কিন্তু প্রিয় প্রিয় কবিকে ফোন করবি। দেখছেন তাে দ্বিধা কাটিয়ে, শেষ পর্যন্ত ফোনটা করেই ফেললাম। আপনার সময় নষ্ট করছি এটা যেমন দিনের আলাের মতাে সত্যি, ঠিক তেমনই সত্যি যে আমার ফোন পেয়ে আপনিও খুব খুশি হয়েছেন, তাই না অমল কবি?
কবি ঃ অবশ্যই, ভীষণ খুশি হয়েছি অরুন্ধতী। কারণ আর পাঁচটা ফোনে বা হােয়াটসঅ্যাপে শুধু অমুক কবিতাটা পাঠান, তমুক কবিতাটা পাঠান, এই অনুরােধের বন্যা। এই ফোনটা তাে সত্যিই একেবারে অন্যরকম। কিন্তু অরুন্ধতী…
অরুন্ধতী ঃ প্লিজ অমল কবি আমাকে, শুধু সুধা বলে ডাকুন।
কবিঃ আচ্ছা বেশ, সুধা তােমার গলার স্বরে কোথাও একটা বিষণ্ণতা রয়েছে, কেন? অরুন্ধতী মনে হয় এই হেমন্তে, যাতায়াত একটু স্বাভাবিক হলে, আপনি আমাদের বাড়িতে আসবেন।মানে আসতেই হবে আপনাকে। তখন নিজের চোখেই সব দেখতে পাবেন, বুঝতেও পারবেন। আজকে আমার কয়েকটা লাইন শুনিয়ে ফোনটা রেখে দেবাে, আমাদের এম.এ ফাইনাল ইয়ারের শেষ পরীক্ষাগুলাে হবে কিনা জানি না, কিন্তু লেখাপড়া তাে করে যেতেই হচ্ছে। আচ্ছা সেদিন ঢাকা থেকে একটা লাইভ অনুষ্ঠানে আপনি যে অমল সুধাকে নিয়ে কবিতাটা বললেন কি নাম যেন কবিতাটার?
কবিঃ সেই গল্পটা। আমার নির্বাচিত কিশাের কবিতাতে আছে।।
অরুন্ধতীঃ কি আশ্চর্যভাবে গানটা ধরেছিলেন-ভালােবাসি ভালােবাসি, এই সুরে কাছে দুরে, জলে স্থলে বাজায় বাঁশি, ভালােবাসি। শােনাবেন একটু কয়েকটা লাইন? অবশ্য আমার কাছে ভিডিও রেকর্ডিংটা আছে, ইচ্ছে করলেই শুনতে পাবাে, তবু আপনি যদি একটু শােনান।
কবিঃ এই মূহূর্তে লেখার টেবিলে আমি একটা নাটকের ডিকটেশন দিচ্ছিলাম। একটা বড় ক্যানভাসের নাটক, মহা পৃথিবীর গল্প। এই মুহূর্তে মনে করে বলাটা…
অরুন্ধতী ঃ বকুনি খাবেন কিন্তু আমার কাছে। আপনার মেধা ও স্মৃতিশক্তি নিয়ে ফেসবুকে পর্যন্ত আলােচনা হয়। প্লিজ বলুন না, আমাকে একটু ওষুধ খেতে হবে। কিন্তু তার আগে আমার কবিতার কয়েকটা লাইন আপনাকে শুনতেই হবে। প্লিজ অমল কবি আপনি শুরু করুন।
কবি ঃ সেই গল্পটা তােমাকেই বলে যাব/ অমল বললে মনে পড়ে দুটো চোখ/ ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে কবে/ পাখিরা গাইছে- ভাল হােক, ভাল হােক/ আকাশ যেখানে মাটিতে পেতেছে কান/ চির শ্যামলিমা ভিজে পলাশের ডালে/ কিশাের বাউল যেখানে একাই নাচে/ মল্লারে নামা ধারাবৃষ্টির তালে/ সুধার কি মনে পড়ে অমলকে আজও ?/ শ্যামলী নদীর গতিপথে ছােট নুড়ি/ মনে কি রেখেছেএকদিন বসে থাকা/ কালাে মেয়েটিকে, হাতে তিনগাছা চুড়ি/ সবাই রয়েছে, তবুও কী যেন নেই!/ ঘরের আলাে কি কোথাও একটু ফিকে ?/ ছড়ানাে খাতায় দু’একটা কথা লেখা/ একটি মলিন মুখ জানালার শিকে/ কখনও অমল জাগলে সুধাকে বােলাে,/ উঠোনে হাসছে শাল-শিমুলের চারা/ মাঠ পেরােলেই ভােরের স্রোতস্বিনী/আলাে ফুটলেই গান গেয়ে দেয় সাড়া/সব দুঃখকে, সব ক্লান্তিকে মেনে,/ অমল গাইবে-ভালােবাসি ভালােবাসি,/শিউলির শেষে, আমের মুকুলে হেসে,/ সে-ই তাে বাজাবে নীল দিগন্তে বাঁশি !
অরুন্ধতী ঃ (ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে) আপনার অমলের কিচ্ছু হয়নি, সুধাকেও যে অনেকদিন বেঁচে থাকতে হবে। একটা ‘ডাকঘর’ করতে হবেনা? অমল-সুধার ডাকঘর। আচ্ছা কবি, আপনি বিশ্বাস করেন এই মানব সভ্যতা থাকবে? আমরা মুছে যাবাে না তাে এই পৃথিবী থেকে?
কবিঃ সুধা তােমার কবিতাটা পড়াে, আমি উন্মুখ হয়ে রয়েছি।
অরুন্ধতী ঃ সব ঠিক হবে?/ ঠিক হবে সব?/ ঠিকঠাক সব হবে?/অলকানন্দা ঝাঁপিয়ে পড়বে দুরন্ত উৎসবে? কবি ঃ বাঃ অসাধারণ! তারপর?
অরুন্ধতী ঃ চোখ খুললেই চেতনার রঙে পান্না সবুজ বনে/ শীত ফিরে গেলে প্রিয় ঋতুরাজ অনুভবে, অকারণে!/সব ঠিক হবে?/ ঠিক হবে সব?/ ঠিকঠাক সব হবে?/(কান্নায় ভেঙে পড়ে ফোনটা কেটে দেয়)।
দৃশ্যান্তর দ্বিতীয় দৃশ্য (কবি নিমগ্নর ফোনে রিং টোন বেজে ওঠে)
কবি ঃ হ্যালাে, কে বলছেন?
অরুন্ধতীঃ কবি আপনি এত নিষ্ঠুর? আমি কবিতা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লামসেদিন, আর আপনি আমার নম্বরটা সেভ করে রাখেননি পর্যন্ত? আপনারা, কলকাতার মানুষরা, নিজেদের কী মনে করেন বলুন তাে? কবি ঃ প্লিজ, প্লিজ, বিশ্বাস করাে….।
অরুন্ধতীঃ কী বিশ্বাস করবাে? আপনি ইনিয়ে বিনিয়ে কারণ দেখাবেন, আর আমাকে সেই লেম-এক্সকিউজ গুলাে মানতে হবে? আমি আপনার মতাে কেউকেটা নই বলে এতটা তাচ্ছিল্য আমার প্রাপ্য?
কবিঃ আমার উত্তরটা না শুনে তুমি এত কথা বলছাে কেন?
অরুন্ধতী ঃ কী উত্তর শুনবাে? আপনার বাড়ির লােক রাত দশটার সময় আপনার হাতে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়েছিলাে, ওষুধ কিনে আনার জন্য, আর আপনি সেই মূহূর্তে ফোন ফেলে রেখে ছুটলেন। বেশ ভালাে কথা, ফিরে এসে ফোনটা দেখে কিছু মনে পড়লাে না? টাচ স্ক্রিনে কোনাে কান্নার বিন্দু? দশ-কুড়ি মিনিটের একটা আদান প্রদান… মূহূর্তের মধ্যে ইরেজার দিয়ে মুছে ফেললেন? আপনি না সম্প্রীতির কবিতা লেখেন।
কবিঃ আঃ, প্লিজ স্টপ। আমি তােমাকে ভুলিনি, আর আমি ওষুধ কিনতেও বেরােইনি। টেবিলে পড়ে থাকা লেখাটা কমপ্লিট করতে না করতেই আমারও একটা ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেলাে, তারপর ডিনার। এর মধ্যে এইসব কথা উঠছে কেন? আর পিতৃতুল্য একজন মানুষেরসঙ্গে এইভাবে কেউ কথা বলে ? তােমাদের জেনারেশনটাই বােধহয় এরকম। মা বাবার সমস্ত স্যাটেনশন পেয়ে চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। আমার ছেলেরও একই ঘটনা। পান থেকে চুণ খসলেই ষাঁড়ের মতাে গাঁ গাঁক করে চিৎকার করে। অল বােগাস। প্লিজ ট্রাই টু বিহেভ ইয়ােরসেল্ফ। আর ফোন কোরােনা। (ফোন কেটে দেয়) স্বগতােক্তি – আমিই বা কেমন মানুষ, মেয়ের বয়সি একটা নিস্পাপ প্রাণকে এভাবে আঘাত দিলাম? ওঃ আমি যে কবে বিহেবিয়ার শিখবাে? মাই গড়, আমাকে তাে স্নানে যেতে হবে, বেরােতে হবে যে! (আবার ফোন বেজে ওঠে, কবি সুর নরম করে) বলাে সুধা? অতটা বকুনি তােমার প্রাপ্য ছিল না, কিন্তু আমাকে একটু বেরােতে হবে। কলেজটি পাড়া সবে খুলেছে, খুব দরকার আছে সেখানে।
অরুন্ধতী ঃ আপনি এখন ফোন ছেড়ে দিয়ে দেখুন তাে! আমার নতুন লাইনগুলাে শুনবেন না কবি, শুধু রাগটাই দেখলেন?
কবিঃ একটুতাে দেখেছি বটেই। সেটাই আমার পক্ষে…
অরুন্ধতীঃ সরি। সরি। সরি। আর কক্ষনাে এমন ভুল হবে না অমল কবি। আমার কবিতার নতুন দুটো স্ট্যানজা শুনে আপনি ফোনটা কেটে দিন। তারপর না হয় রাতের দিকে ….
কবিঃ না না, প্রতিদিন রাতের দিকে ফোন করাে না। ইটস লুকস অড।
অরুন্ধতী ঃ কিন্তু আমি কি করতে পারি? আমারও তাে একগাদা লেখাপড়া, রান্নাঘরে মাকে একটু সাহায্য করা। আমার আলটুসি বােন তখন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে স্বাতী নক্ষত্রের চোখের জলের কাহিনী বর্ণনা করে। আর ওর কবি কবি ভাব, ছন্দের অভাব বন্ধুটি, ফিদা হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তাই শােনে।
কবিঃ (রেগে গিয়ে) অযথা বােনের নামে নিন্দে করছাে কেন?
অরুন্ধতীঃ নিন্দে করছি? কবি আপনি জানেন না, স্বাতী যে সুন্দরীতমা নক্ষত্র? আর ওর বয়ফ্রেন্ড ততােধিক সুন্দর একটি। ছেলে, যার জীবনে কোনাে লক্ষ নেই; শুধু ভালােমানুষ হওয়া ছাড়া। আমি আমার বােনকে পাগলের মতাে ভালােবাসি কবি। ও ধবধবে ফর্সা আর আমার গায়ের রঙ চাপা। ও আমার বাবার রূপটা পেয়েছে, আর আমি হয়েছি আমার মায়ের মতাে। বাবা আমাকে আদর করে বলে কৃষ্ণকলি। জানেন কবি, বছরের প্রথম কালবৈশাখিতে বাবা আমারমাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে, রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলি গেয়ে ওঠেন। মনে হয় যেন একেবারে শান্তিদেব ঘােষ গাইছেন। আর বােন তখন কি বলে জানেন? আল্লা আমায় কেন দিদির মতাে কালাে হরিণ চোখ দিল না? রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ওর বয়ফ্রেন্ড মাঙ্গলিকের নামে যত মান অভিমান সব কিছু আমার কাছে বরাতে ঝরাতে ঘুমিয়ে পড়ে। আর আমি পাগল বােনটাকে সারারাত আমার বুকের মধ্যে আগলে রেখে দিই। আল্লাকে ডেকে বলি- আমার সবটুকু আয়ু ওকে দিয়ে দাও। ইনশাল্লাহ, ওর প্রেমিক যেন খুব ভালাে একজন বর হয়।কবিঃ ওর প্রেমিকের পুরাে নামটা কী?
অরুন্ধতীঃ হায় আল্লা, তার মানে আপনি জানতে চাচ্ছেন। সে হিন্দু না মুসলমান? ধর্মে সে মুসলমান। নাম মাঙ্গলিক ইসলাম। হিন্দু ধর্মের আচার অনুষ্ঠানের নামে নাম রেখেছে। ওর উদার মা বাবা। ছেলেটা অবশ্য নাম জিজ্ঞেস করলে শুধু মাঙ্গলিক নামটুকুই বলে। আসলে আমাদের প্রজন্ম এই জাত পাত ধর্মাধর্মকে হয়তাে একটু একটু করে অতিক্রম করতে শিখছে। আপনি কি রাগ করলেন? আপনি তাে শুনেছি ধর্ম, ঈশ্বর কিছুই মানেন না। আপনি না কবিতায় লিখেছেন আপনার ধর্মের নাম ভালােবাসা।
কবি ঃ আমি সত্যিই অনুতপ্ত। আমার পুরাে নাম জিজ্ঞাসা করা উচিৎ হয়নি।
অরুন্ধতী ঃ আপনি না সত্যিই ছেলেমানুষ। থাক ও কথা। একটা কথা বিশ্বাস করবেন, আমার বাবা যখন কৃষ্ণকলি গানটা ধরেন, আমি তখন আপনার লেখা কবিতা-‘আমি গীতাঞ্জলির পাতা’ হয়ে যাই। রিলেট করতে পারি সেই মেয়েটার সঙ্গে নিজেকে। দু’লাইন বলবেন কবি? কবি ও আমি বুড়াে হয়ে গেছি রে, সব কবিতা মনে থাকে না।
অরুন্ধতী ঃ ছিঃ, আপনি না আমার অমল কবি, অমলরা কখনাে বুড়াে হয়? আচ্ছা, আমিই শােনাচ্ছি— যদি আগামী জন্মে দেখি/ (কোথাও যেন মেঘের ডাকডাকি শােনা যায়) হয়ে ঝড়ের কৃষ্ণকলি/নানা, ও নাম আমার নয়/তবু একটা কথাই বলি/ওগাে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ হবে আমার গানের খাতা?/ হও অপাপবিদ্ধ মরণ/ আমি গীতাঞ্জলির পাতা/ আমি গীতবিতানের পাতা/ আমি গীতাঞ্জলির পাতা। হ্যালাে, অমল কবিচুপ করে গেলেন যে?আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাে, এবার ফোনটা ছেড়ে দিই?
কবিঃ হােক দেরি, কলেজস্ট্রিট পাড়া সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত খােলা থাকে। কিন্তু আমার সুধার গলায় এই কবিতা যে তাকে আমার অনেক কাছে এনে দিলাে। আমি কি বয়স ভুলে তােমার কাছে হারিয়ে যাচ্ছি? …. কিছু বলবে না?
অরুন্ধতী ঃ (খুব নিঃশব্দে গেয়ে ওঠে) – কিছু বলবাে বলে এসেছিলেম/ রইনু চেয়ে, নাবলে….আমার কাছে হারাবেন কবি। আমি এতটাই সােজা রাস্তা যে সেখানে হারানাের কোনাে গল্প নেই। তাছাড়া, আপনার সুধা খুব বেশিদিন এই পৃথিবীতে থাকতে আসেনি কবি।
কবিঃ কাল থেকে তুমি একটা কথা কেমন চেপে যাচ্ছাে। বলছাে আমি তােমার প্রিয় কবি, অথচ আমার কাছে কেন সত্যি কথাটা বলছাে না বলােতাে? আর আমার হৃদয়কে এভাবে দুলিয়ে দিচ্ছাে কেন?
অরুন্ধতীঃ আপনার অনেক প্রেমিকা কবি। নীলতারা, বনদেবী, শ্যামলিমা, বনজোছনা কত নাম বলবাে, সেখানে অজানা, অচেনা সুধার জায়গা কোথায়?
কবি ঃ (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) সব চরিত্র কাল্পনিক সুধা। ওদের একজনকেও আজও চোখে দেখতে পাইনি, শুধু শব্দের প্রতিমা দিয়ে তাদেরমুখের আদল গড়ি-মাঝরাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত। ভােরবেলা তারা কোথায় যেন মিলিয়ে যায়! পড়ে থাকে তিনটাকার কলম আর দশটাকার প্যাডের ওপর কয়েকটা কবিতার লাইন।
অরুন্ধতী: ও সে কী অমল কবি! আপনি তাহলে…
কবিঃ সংসারে এক সন্ন্যাসী। স্টেজ, সেলফি আর সম্বর্ধনার মায়াজাল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে, একরাশ শ্রাবণ মেঘের মতাে নিঃসঙ্গতা।
অরুন্ধতীঃ কি আশ্চর্য সুন্দর করে কথাগুলাে বলেন আপনি! আপনার কথাগুলাে পরপর বসিয়ে দিলেই তাে আস্ত একটা কবিতা হয়ে যায়। আপনাকে কেউ বলেনি এই কথা?
কবিঃ হয়তাে বলেছে বা বলে। কিন্তু তাদের কথার মধ্যে বড় বেশি প্রশ্রয়, প্রগলভতা, অগভীর মজা-দিঘির স্তব্ধ জল বলে মনে হয়। আমি ঠিক মেলাতে পারি না। তুমি আমাকে আশ্চর্য করে দিয়েছাে সুধা।
অরুন্ধতী : জানেন কবি, আমার বাবা কিন্তু একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। প্রতিদিন নিয়ম করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রমজান মাসে রােজা রাখেন। ঈদের দিন প্রতিবেশী হিন্দু ভাইদের ডেকে এনে আপ্যায়ন করেন, মানে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী। আর আমি তখন আপনার ওই কবিতাটা পড়ি না থাক, এবার আপনি বলবেন। আমি কবিতাটার নামও বলব না। বলুন, বলুন। এক থেকে পাঁচ গােনার মধ্যে ধরবেন। আপনার সময় শুরু- এক… দুই… তিন…কবিঃ আমার বাংলা দুঃখ পেলে, তােমার বাংলা অঝাের কঁদে/ তােমারঈদে রক্ত ঝরলে, লাগে আমার টুকরাে চাঁদে / আমার ঘরের অপু ডাকলে, যাচ্ছি বলে ওঠে মুমতাজ/এপারে যখন দোলের আবির, ওপারে সলমাজরির সাজ/ তুমি ঠোঁটে পানি ছোঁয়াও, আমার মুখে জলের ধারা/ তােমার আমার শ্রাবণে পুঁতি, মরুবিজয়ের সবুজ চারা…
অরুন্ধতীঃ ওয়াও। শােভানাল্লাহ। মাইক্রোফোন অন করে দিয়েছি। বাবা, মা দাঁড়িয়ে গেছেন।
কবিঃ সারা জষ্ঠি- বৈশাখ তাে কাজী নজরুল, রবি ঠাকুরে/ আবার সবার উঠোন মাতে আগমনীতে, লালনসুরে/ এই আকাশে মেঘ জমলে, ওই আকাশে বাজে মাদল/ কালিদাসের আষাঢ় আনে, দুই বাংলায় বর্ষা বাদল…
অরুন্ধতী ঃ (বেশ উঁচু গলায়) এবার আমি বলবাে….
কবি ঃ (হেসে ফেলে) বলাে, বলাে
অরুন্ধতী ঃ আমি যখন মাঝ- দিঘিতে, চিৎসাঁতারের পাগল খেলায়/ তুমিও তখন দামাল কিশাের, ধলেশ্বরীর ছােট্ট ভেলায়/ বন্ধু তুমি ডেকেছাে আমায়, কঁটাতারের বেড়ার কাছে?/আলিঙ্গনের ফুল ফুটেছে, জারুল, শিমূল, পলাশ গাছে/ বন্ধু তােমার জন্যে কাঁদি, এক ভাষাতেই কবিতা আঁকি/ মায়ের ডাকে মিলবাে সবাই, তারই প্রতিক্ষাতে থাকি।
কবিঃ বন্ধু, তুমি ডেকেছাে আমায়? কাঁটাতারের বেড়ার কাছে?/বন্ধু, তুমি ডেকেছাে আমায়? কাঁটাতারের বেড়ার কাছে?…
অরুন্ধতী ঃ (গেয়ে ওঠে) একই আকাশ একই বাতাস, এক। হৃদয়ের একই তাে শ্বাস,/ দোয়েল কোয়েল পাখির ঠোটে, একই মূর্চ্ছনা,/ ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা, মেঘনা যমুনা/ গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা….
কবিঃ আমার বােধহয় আজকে সারাদিন কেটে যাবে তােমার কথা শুনে শুনে। যাক তুমি কালকের কবিতাটা কিছুটা এগােতে পেরেছাে?
অরুন্ধতী ঃ (নিজেকে সামলে নিয়ে) সরি। সরি অমল কবি, আসলে আপনি তাে আমাদের বাড়ির একজন হয়ে গেছেন। আপনাকে আমাদের বাড়ির সবাই খুউব ভালােবাসে।
কবি ঃ প্লিজ, শােনাও তােমার কবিতা। আমাকে বেরােতে হবে। অরুন্ধতী ও ভুল থাকলে একটু কারেকশান করে দেবেন। আপনার মতাে ছন্দ বিশারদ আমি নই। (পড়তে শুরু করে) আকাশ আবার দিগন্ত ছুঁয়েমাটির গন্ধ নেবে?/ সুধা অমলকে নীলাকাশ দেবে হঠাৎ কিছু না ভেবেই!/ কেউ থাকবে তাে রবি ঠাকুরকে প্রণাম পাঠিয়ে দিতে? পঁচিশে-বাইশে ফের দেখা হবে নিভৃতের নিভৃতে?
কবি ঃ আঃ, কি অপূর্ব অনুভূতি। তারপর…
অরুন্ধতী ঃ এক কাপ চায়ে তুফান উঠবে? ঢেউ কি পায়ের পাতায়?/ রাধাচূড়া দেবে খুনসুটি হাসি, ছােট্ট বেলার ছাতায়?/ দুটো হাত ছোঁবে আঙুলে আঙুলে, ভিক্টোরিয়ার ঘাসে/ কলেজের পথে চোখাচোখি হবে, গড়িয়াহাটার বাসে?/সব ঠিক হবে?/ ঠিক হবে সব?/ ঠিকঠাক সব হবে?
কবি ঃ তারপর…
অরুন্ধতি ঃ (ফিস ফিস করে গেয়ে ওঠে) তার আর পর নেই, নেই কোন ঠিকানা/ যা কিছু দিয়েছি থেমে যাক, থেমে যাকনা…..। না আর বাড়াতে পারিনি কবি, কিন্তু এই কবিতা আমি শেষ করবােই, আপনি দেখে নেবেন, অমল কবি।
কবিঃ তােমাকে যতই জানছি, বুঝছি, ততােই বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। ইয়েস, আমি জানি এই কবিতা তুমিই শেষ করবে।
অরুন্ধতিঃ রাতে কখন ফোন করবাে আমল কবি? কখন ফ্রি থাকবেন? (আবহে বেজে ওঠে – আমি তার লাগি পথ চেয়ে থাকি পথেই যে জন ভাসায় ….)।
দৃশ্যান্তর
তৃতীয় দৃশ্য।
(বাইরে দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ আসছে)
কবিঃ (আপন মনে) সাতদিন কেটে গেলাে, মেয়েটা একটাও ফোন করলাে না। দেখতে দেখতে পুজো এসে পড়লাে। যাঃ আমি কি ক্রমশ নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ছি ওর উপর? নাকি ও কবিতাটা প্রাণপণে শেষ করতে চেষ্টা করছে। আচ্ছা এই বয়সে আমি এতবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছি কেন? আমার তাে ঘর সংসার আছে। দুদিন বাদে ছেলের বিয়ে দিতে হবে। নেহাত তিনতলায় আমি একাই থাকি। আচ্ছা, আমি যদি আমাদের দোতলায় সবার সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতাম তাহলে কি এতক্ষণ ফোন করার অবসর পেতাম? মিছিমিছি অরুন্ধতীর কথা ভেবে আমার লেখার সময়টা নষ্ট করছি। না, আমি একটা যাচ্ছেতাই….. (হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে) হ্যালাে, আজকে কিন্তু ভুল করিনি। কি হয়েছিলাে অরুন্ধতী। সাতদিন অমল কবিকে ভুলে ছিলে কী করে?
অরুন্ধতীঃ সব বলবাে, আগে সম্বােধনটা ঠিক করুন।
কবিঃ সরি, অরুন্ধতী নয় সুধা। কী হয়েছিলাে তােমার?
অরুন্ধতী ঃ আচ্ছা আপনার মনে হয়নি মেয়েটাকে ফোন করি, খবর নিই একটা।
কবি ঃ আমার বয়সে সেটা সম্ভব নয় সুধা। এখনও তােমাদের বাড়িতে আমি যাই নি। একটা দ্বিধা আছে। যদি অন্য কেউ ফোন তুলে বলেন- কেন, কী দরকার?
অরুন্ধতী ঃ হ্যা, বাড়ি ভর্তি আত্মীয় কুটুম রয়েছে তাে, তাই ওনার লজ্জা হলাে। আমাদের তাে কুটোখড়ের সংসার। সব মিলিয়ে চারজন। সাতদিন ধরে কী পাগলের মতাে আপনার কথা ভেবেছি আপনি জানেন? এ ক’দিনে আপনার কোনাে লাইভ অনুষ্ঠানও ছিল না, যে প্রিয় মানুষটার কবিতা শুনে একবার প্রাণ জুড়ােবাে।
কবিঃ তাহলে তুমিই ফোন করলে না কেন?
অরুন্ধতী ঃ (ম্লান হেসে) আপনার সুধার যখন রক্ত নিতে হয়, তখন তার জ্বর আসে, সে সারাদিন-সারারাত, সারারাত সারাদিন অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে যায়। চাঁদ , সূর্য, তারাহীন এক অন্য মহাকাশ। কালাে, সব কিছু কালাে। শুধু ব্ল্যাক হােল থেকে কেউ যেন হাতছানি দেয়, আয় চলে আয়।
কবিঃ তােমার অসুখটা কী ব্লাড রিলেটেড?
অরুন্ধতীঃ থ্যালাসেমিয়া। আমার বােনও একই রােগে আক্রান্ত। আমার মা বাবা দুজনেই এই রােগের ক্যারিয়ার। তবু, বােন যে কোন কারনেই হােক আমার থেকে শক্তিশালী। আমার থেকে চার বছরের ছােট তাে। কেন যে আমার মা বাবা বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করালােনা? চুপ করে আছেন। কেন অমল কবি। ঠিক এই কারনেই মা বাবা আমাদের দুই বােনকে তেমন কোন চাপ দেন না। আমাদের জীবনে অনেক কিছু নেই, তাই স্বাধীনতা টুকুই আছে। কবি কিছু বলুন আপনি। (হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে) হ্যালাে, আমি কিন্তু কবিতাটা শেষ করেছি। আপনি শুনবেন না?
কবি ঃ (কেমন ঘােরের মধ্যে) একটা পরিবার কত শান্ত, সুভদ্র হয় তা তােমাদের দেখে শিখলাম। এতবড় একটা রােগের সাথে লড়াই করেও তুমি কবিতার মধ্যে….আশ্চর্য।
অরুন্ধতীঃ কবিতার জন্য আমি হাজার মাইল হাঁটতে পারি অমল কবি। আপনি কবে আসবেন সেটা বলুন তাে? আপনাকে এই নীলদিগন্তের কত কিছু দেখানাের যে বাকি! আপনি এলে আমাদের বাড়িতে সূর্যোদয় হবে কবি।
কবি ঃ তােমার কথাগুলাে আমার মাথায় ঢুকছে না। আমি শুধু ভাবছি, তােমাদের বাঁচিয়ে তুলবাে কীভাবে? আচ্ছা রক্তের যােগান কীভাবে আসছে?
অরুন্ধতী ও ওই যেভাবে আষাঢ় শ্রাবণের কাছে যায়। হয়ে যায় কবি। এখনও পৃথিবীতে ভালাে মানুষের সংখ্যাই বেশি। মহকুমা হাসপাতালের ডাক্তারাও বড় ভালাে মানুষ। এ কী আপনি কি আপসেট হয়ে গেলেন? আরে না না, আমরা বাঁচবাে, অন্তত চল্লিশ বছর পর্যন্ত বাঁচবাে। তত দিনে মা বাবা হয়তাে থাকবেন না। আপনাকে কিন্তু বাঁচতে হবে একশাে বছর। আমাদের দুই বােনকে চিরবিদায় জানাতে হবে না? মাথার উপরে একজন আকাশের মতাে বড় মাপের কবি আছেন একথা ভাবলেই …. আচ্ছা, কোজাগরী পূর্ণিমার পর থেকে কালীপুজোর সময় পর্যন্ত আপনার কেমন লাগে?
কবি ঃ (অন্যমনস্কভাবে) বিষগ্ন, গম্ভীর। হেমন্ত যেমন হয় আর কি, কেন বলতাে?
অরুন্ধতী ঃ আপনার মতাে আমাদের দুই বােনেরও প্রিয়ঋতু হেমন্ত। আপনাকে দু একটা অদ্ভুত জিনিষ দেখাতে নিয়ে যাবাে….
কবি ঃ কি বলো তো?
অরুন্ধতীঃ বাবার থেকে ডিরেকশন জেনে আপনাকে নিয়ে যাব টাকি শহর ছাড়িয়ে, ইছামতি নদীর ধারে এক গ্রামে। সেখানে ইঁটখোলার মধ্যে একটা ছােট্ট ওয়াচ টাওয়ার আছে। উৎসাহী পর্যটকরা কেউ কেউ যান সেখানে। সন্ধের আগে সে এক অপূর্ব দৃশ্য। বাঁ দিকে তাকালে দূর থেকে টাকি শহরের আলাে, এমন কি ওপারের বাংলাদেশের আলােগুলােও দেখা যায়। আর ডান দিকে তাকালে, অনেকটা দূরে-ইছামতি গিয়ে মিশে গেছে কালিন্দী নদীতে। সে নাকি অপূর্ব দৃশ্য। চারিদিকে অপার জলরাশি।
কবিঃ তাই নাকি? আমি শুনিনি তাে। অরুন্ধতী ঃ বাঃ বেশ মজা হবে। এমন অপার্থিব গােধূলি -সন্ধ্যার মিলন দৃশ্য, যা অমল সুধা কেউই আগে দেখেনি। দুজনেই একসাথে দেখবে!
কবিঃ সুধা, রবীন্দ্রনাথ কি তােমাকে ভেবেই ডাকঘর লিখেছেন? তা নাহলে এমন অনুভূতি তুমি পেলে কোথা থেকে? আমি কিন্তু ভীষণ ভেঙেচুরে যাচ্ছি ক্রমশ।।
অরুন্ধতী ঃ (যেন শুনতে না পেয়ে অন্য কোন জগৎ থেকে বলে ওঠে) রাতটা একটু কষ্ট করে আমাদের বাড়িতে থেকে যাবেন। আমার মা নারকেল কোরা দিয়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর হাঁসের ডিমের কারি রান্না করতে পারেন, আর খাওয়াবাে ইছামতি নদীর মাছ, বড় বড় টাটকা পিরশে।।
কবিঃ দুর, এসব খাবার গল্প আমার ভালাে লাগছে না। পরের দিন কী করবে?
অরুন্ধতীঃ আগের দিন অনেক রাত পর্যন্ত আপনার কবিতা শুনবাে, তারপর আপনাকে দু’তিন ঘন্টার বেশি ঘুমােতে দেবােনা। ডেকে তুলবাে সেই কাকভােরে। আমার আলটুসি বােনটাকে যদি তুলতে নাও পারি, তাহলে অমলের হাত ধরে সুধাই বেরিয়ে পড়বে বন-শিউলিতলা আর একটা ভাঙা বারান্দাওয়ালা দু’কামরার ধ্বংসস্তুপ…
কবিঃ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কী বলতে চাইছাে?
অরুন্ধতীঃ নদীর উল্টোদিকে, আমাদের গ্রামের শেষপ্রান্তে ভাদুড়িদের পুরােনাে জমিদার বাড়ি। সাতমহলা চকমিলানাে অতবড় বাড়িটা এখন পুরােপুরি খণ্ডহর। লােহার গেটের সামনের অংশটুকু সংস্কার করিয়ে, কলকাতা থেকে ওদের আত্মীয়স্বজন আসে মাঝে মাঝে, নদী আর গ্রাম দেখতে, আর ফল ফুলুরি নিয়ে যেতে।।
কবিঃ তাে সেখানে গিয়ে আমরা কি করবাে সুধা? সে তাে সাপখােপে ভরা জংলি জায়গা।
অরুন্ধতী ঃ ইস্। শেষ পর্যন্ত আমার অমলও ঘাের ব্যবসায়ীদের মতাে লাভ ক্ষতির কথা বলছে? আপনার কোনাে ভয় নেই। কুড়ি বিঘার ওই জমিদার বাড়ির পিছনের অংশটা সম্পূর্ণ জঙ্গল আজ কত কত বছর ধরে। কিন্তু ভয় নেই। সেখানকার বনচররা অমল সুধার কোনাে ক্ষতি করবে। আর বনচর বলতে তেমন মারাত্মক কিছু নয়। শেয়াল, ভাম, খটাশ, বেজি এই সব আর কি। কিন্তু সেখানে একটা আশ্চর্য গাছ আছে জানেন। সারাবছর সাদা সাদা ফুল ফোটে। গন্ধটা আশ্বিনের শিউলির মতাে মনকাড়া না হলেও, কেমন যেন শিউলি শিউলিই মনে হয়। বিভূতিভূষণ বােধ হয় এই গাছটার নামই দিয়েছিলেন বন-শিউলি। আমি আর বােন এই গাছটাকে জড়িয়ে ধরলেই গাছটাও আমাদের মাথায় একরাশ সাদা ফুল ঝরিয়ে দিয়ে বলে-আলােকের এই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও।
কবিঃ আর সেই ভাঙা বাড়িটা? সেটা কি জমিদার বাড়ির অংশ?
অরুন্ধতী ঃ কে জানে। তবে বন-শিউলির ধারে কাছেই টানা লম্বা বারান্দাওয়ালা একটা দু’কামরার একতলা বাড়ি, বােধহয় কেয়ারটেকার থাকতাে।।
কবিঃ তার মানে এখন সবই ধূসর পাণ্ডুলিপি? তা বনশিউলি নয় বুঝলাম, ওই ছােট্ট ভাঙা দু’কামরার ইতিহাসটা কী?
অরুন্ধতী ঃ (আবার অন্যমনস্ক হয়ে) কড়ি, বর্গা সব খসে গেছে, শুধু অশরীরীর মতো দেয়ালগুলাে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ওখানে একটা অদ্ভুত গন্ধ আছে, জানেন।
কবিঃ হতে পারে আগেকার দিনের চুণ-সুড়কির গন্ধ।
অরুন্ধতী ঃ ইস অমল কবি, আবার একটা আলগা কথা শুনলাম আপনার মুখে। আপনি শেষ কবে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর পড়েছেন?
কবিঃ সে তাে অনেক বছর আগে। কোলকাতার বিখ্যাত নাটকের দল বহুরূপীর ডাকঘর দেখেছিলাম। সেও তাে কত বছর হয়ে গেল। কিন্তু, তােমার কথার কোন মানে আমি খুঁজে বার করতে পারছি না। কেন এসব বলছাে?
অরুন্ধতীঃ ইস, আপনি ছােট বেলাটাকেই হারিয়ে ফেলেছেন। তাহলে এত সুন্দর সুন্দর ছােটদের কবিতা লেখেন কী করে? নাকি সেটা অভ্যাস হয়ে গেছে বলে পারেন। সবটাই পত্রিকা সম্পাদকের জন্য অর্ডারি লেখা? ছিঃ।
কবিঃ অত তীব্র ভৎর্সনা করছাে কেন? আর এত হেঁয়ালিই বা কেন?
অরুন্ধতী ঃ আপনার হাতের কাছে রবীন্দ্ররচনাবলির নাটকের খণ্ডটা আছে?
কবিঃ হ্যা, তা আছে। তা দিয়ে কী করবাে এখন?
অরুন্ধতী ঃ ওঃ প্লিজ, তাড়াতাড়ি ডাকঘর নাটকটা বার করে, যে কোন পাতার মধ্যে নাকটা ডুবিয়ে দিন তাে।
কবিঃ দিলাম সুধা। ডাকঘরের অন্তরমহলে নাকটা ডুবিয়েই দিলাম। তারপর?
অরুন্ধতীঃ আপনার জনপ্রিয় কলাম পড়ে জেনেছি- জীবনে কোন নেশার দাসত্ব করেননি আপনি। তার মানে ঘ্রাণশক্তি আপনার আজও স্বাভাবিকই আছে, তাই না অমল কবি? বুক ভরে শ্বাস টানুন, টানুন। টানুন।
কবি ঃ হায় রে, কী পাগলের পাল্লায় পড়েছি।
অরুন্ধতীঃ ইয়েস পাগল। আপনার লেখা পড়ে আমি সত্যিই পাগল। অথচ আপনি কী করে এতটা নির্লিপ্ত, স্বাভাবিক আমার জানতে ইচ্ছে করছে।।
কবিঃ আমি তােমার ডাকঘর নাটকের গন্ধে গন্ধগােকুল হয়ে বসে আছি। এরপর কী করতে হবে বলাে?
অরুন্ধতী ঃ আল্লাহ অসীম দয়াময়। এতক্ষণে আপনি ওই ভাঙা বাড়িটার কাছে পৌঁছে গেছেন। বাড়িটার দেয়ালে দেয়ালে ওই ডাকঘর নাটকের গন্ধ আছে। যদি আমরা বন-শিউলি গাছ সমেত ওই ধ্বংসস্তুপটুকু বাবুদের হাতে পায়ে ধরে অল্পটাকায় কিনতে পারি, তাে সেখানেই
কবিঃ (প্রায় চিৎকার করে) এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি। সুধা, ওটাই অমল সুধার ডাকঘর হবে তাই না?
অরুন্ধতীঃ দূর দূরান্ত থেকে মানুষ সুখ দুঃখের বার্তা নিয়ে আসবে। সুধা সেগুলােকে জড়াে করে অমলের কাঁধে তুলে দেবে, আর সুধার অমল রাতের ডাক হরকরা হয়ে, রানার হয়ে, বন, জঙ্গল, পাহাড়, নদী পেরিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে মানুষের বার্তা। অমল কবি, নভেম্বরের গােড়ার দিকে দিন দুয়েকের জন্য চলে আসুন। আসবেন না? ঋতু হেমন্তকে বলবাে- আপনার কাছে নিমন্ত্রণের চিঠি পৌঁছে দিতে। সব ঠিক হলে লুটোপুটি প্রেমে এই ভাব এই আড়ি/ আন্ডিজ আর ইঙ্কার ডাকে উধাও উড়ানে পাড়ি!/প্যাডেল-দাপানাে পাগল পাগল দু’চাকার দুনিয়ায়/ উন্মাদ মনে যা ইচ্ছে তাই যেদিকে দুচোখ যায়!/ সব ঠিক হবে?/ ঠিক হবে সব?/ ঠিকঠাক সব হবে? (আবহে লালনের গান ভেসে। আসে আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথা এক পড়শি বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে….। সুধা বলেই চলে) সব ঠিক হলে বেরিয়ে পড়বাে লালনের গানে গানে/ বাকি জীবনটা আর কিছু না, কিচ্ছুনা আর/ প্রাণের অতলে প্রাণে।/ সব ঠিক হবে ?/ ঠিক হবে সব?/ ঠিকঠাক সব হবে?
কবিঃ সুধা, আমি তাের জন্য বাঁচবাে রে। আমি তাের স্বপ্নের ডাকঘর যদি গড়ে না দিতে পারি, তাহলে আমার সব কাব্যগ্রন্থকে ভাসিয়ে দেবাে ইছামতির জলে। সুধা, তােদের দুটো বােনকে বাঁচাতেই আমি বাঁচবাে রে। আমাকে বাঁচতেই হবে। (লালনের গান বেজেই চলে, বেজেই চলে)
।। সমাপ্ত ।।
বিঃদ্রঃ – এই নাটকের সব চরিত্র ,ঘটনা, স্থান, কাল সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে তার কোনাে মিল নেই। নাটকে ব্যবহার করা কবিতাগুলাে কবি আরণ্যক বসুর। অভিনয়ের আগে নাট্যকারের অনুমতি নেওয়া বাঞ্ছনীয়। ‘TechTouch টক’ পত্রিকার শারদ সংখ্যা ২০২০ জন্য সংরক্ষিত।