সবাই রয়েছে ,তবুও কী যেন নেই !
ঘরের আলো কি ,কোথাও একটু ফিকে ?
ছড়ানো খাতায় দু’একটা কথা লেখা,
একটি মলিন মুখ জানালার শিকে!
দিদি, তোকে মায়ের ব্যাপারে বাবা কি কোনো খবর দিয়েছে ? দেখতে দেখতে তো ,আবার একটা পুজো চলে এলো। আর মাত্র মাস খানেক। সেদিন হাসপাতালে বসে যেন শুনলাম, একজন নার্স আরেকজন সহকারীকে বলছেন–স্মৃতিকণাদিকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ডাক্তারবাবুরা বলাবলি করছেন। দিদি,সত্যি ? তুই কিছু শুনেছিস? পুজোর সময় যদি মাকে না ছাড়ে ? তাহলে কী হবে ? আমাদের তো নতুন জামাকাপড় কেনা দূরে থাক , পাড়ার পুজোটাও
ম্লান হয়ে যাবে মা না থাকায় । মা’কে আসতেই হবে। তার আরও একটা কারণ আছে, বাবা কিছু না বলায় ইদানিং তোর শাসনটা বড্ড বেড়ে গেছে। আমি তার কারণ জানি। সামনের বছর তোর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা।তার উপর ,কাজের দিদি , মঙ্গলাদির যেমন খুশি বায়নাক্কা । বাবার থেকে টাকা ধার নিয়ে ফেরৎ না দেওয়া , প্রায় রোজই তরিতরকারি আর দু এক কৌটো চাল , অনায়াসে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়, শুধু বাতাসকে লক্ষ্য করে কথা ছুঁড়ে দিয়ে যাওয়া — আজ আর আমার বাজার করা হবেনা,তাই নিয়ে গেলাম….
আমাদের ভালোমানুষ বাবা একজন অভাবী মানুষকে এভাবে অন্যায় সুযোগ নিতে দেখেও চুপ করে থাকে। আর তুই রাতে বাবা ফিরলেই রাগে ফেটে পড়িস। তোর কত্থক নাচের ক্লাস বন্ধ। তোর মুখ বুজে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা বন্ধ। এভাবে কোনো কিছু চলতে পারেনা।আমি তোর থেকে পাঁচ বছরের ছোটো হলেও সেটা বুঝি। কিন্তু তাই বলে মাঝে মঝে তোর বেপরোয়া রাগ আমার ওপর এসে পড়বে কেন ? আমার সামান্য দুষ্টুমিটাও তুই শাসন করে থামাতে পারিস না ? মা’র কথা ছেড়ে দে , মা তো কারোর গায়ে হাত তোলার কথা কল্পনাতেও আনে না। আর, অমন যে মাই ডিয়ার অথচ রাসভারী আমাদের বাবা , তার কাছেও কোনোদিন চড় চাপড় খেয়েছি বলে আমার মনে পড়েনা ! তাহলে তুই কেন আমাকে এত মারিস ? মা শুধু আমাকে ভয় দেখানোর জন্য রান্নাঘরে যে ছোট্ট বেতের মতো লাঠিটা রেখেছে, সেটা কেন তুই আমার ওপর ব্যবহার করিস বলতো ? একটা ঘটনা মনে করিয়ে দিই ? — জানি ,মনে করালেই তুই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কে়ঁদে উঠবি। তবু তো আমাকে বলতেই হবেই রে দিদি। সেদিন সকাল থেকেই শ্রাবণের ধারা নেমেছে ; তুই বোধহয় সে কথা ভেবেই , বাবা অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পরে , আমাকে স্কুলের টাস্ক শেষ করতে বলে , মায়ের হারমোনিয়াম নিয়ে বসলি, আর বেছে বেছে মায়ের প্রিয় গানটাই ধরলি — বঁধুয়া , নিদ নাহি আঁখি পাতে,
আমিও একাকী ,তুমিও একাকী আজি এ বাদল রাতে,
নিদ নাহি আঁখি পাতে…
ছাতা মাথায় ইস্কুলে বেরোনোর আগে , কেন যে তোকে খোঁচা মারতে গেলাম, জানিনা–দিদি , তুই কি কারোর সাথে ইন্টু-পিন্টু করছিস ? তুই দরজা বন্ধ করতে করতে বললি–কেন বলতো ? আমি কোনো রকমে পালাতে পালাতে বললাম–না মানে, এমনি বললাম। কদিন ধরে দেখছি, তুই গানটা গুণগুণ করছিস। হায়রে ! কী কুক্ষণেই যে বলেছিলাম কথাটা ! ভরদুপুরে ছাতা মাথায় রেইনি-ডে নিয়ে ফিরে, আমি বংশী ,কানু আর চন্দন আমাদের ক্যারাম পেতে বসে পড়লাম। আমার খুব একটা খেলতে ইচ্ছে করছিল না।কেননা, স্কুল লাইব্রেরী থেকে সবে দু ‘একদিন আগে এনেছি খগেন্দ্রনাথ মিত্রের বিখ্যাত বই বাংলার ডাকাত। জামাকাপড় ছেড়ে গুছিয়ে বসে বইটা পড়বো, এই ছিল ইচ্ছে। আর মাঝে মাঝে তোর সঙ্গে পুটুর পুটুর করবো। কিন্তু, নাছোড়বান্দা পাড়ার বন্ধুরা আমাদের বাড়ির ম্যাচবোর্ডে ক্যারাম পেটাবে — এই ইচ্ছেতে হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকে পড়লো। আমার তখন মোটেই ইচ্ছে করছিল না ক্যারাম খেলতে। তাই ছুতোয় নাতায় বংশীর সঙ্গে ঝগড়া বাধালাম। অন্যায়টা আমারই, কাজেই বাকি তিনজন– জীবনেও তোর বাড়িতে আর ক্যারাম খেলতে আসবো না –বলেই, ব্যাগ গুছিয়ে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেলো। আমি প্রায় নিঃশব্দে ক্যারাম, গুটি সব তুলে রেখে ভাবছি — যাক বাবা ,ঝামেলা গেল। এবার আমার মুঠোয় বাংলার ডাকাত! ভেবেছিলাম , তুই পাশের ঘরে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিস; কিন্তু, তুই যে আমার দুষ্টুমিটা সম্পূর্ণ বুঝতে পেরেছিস ,তা আমি জানবো কী করে ? মায়ের ওই ভয় দেখানো লাঠিটা তোর হাতে পড়ে মুহূর্তেই যেন পুলিশের লাঠি হয়ে গেল । হাতে পিঠে ঘাড়ে হাঁটুতে তুই বেধড়ক মেরেই চলেছিস,যতক্ষণ না আমার ডানচোখের উপরের ভুরুতে তোর ওই লাঠির বাড়িটা সপাটে এসে লাগলো।আর তুই সবিস্ময়ে দেখলি, তরকারির ঝুড়ি থেকে যেন একটা ছোট সাইজের আলু হঠাৎ লাফিয়ে এসে আমার কপালে সেঁধিয়ে গেল। আর ভুরুর ওপরটা মুহূর্তের মধ্যে নীল হয়ে গেল ! ব্যস , তোর হাত থেকে লাঠি খসে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে তুই যেন উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে গিয়ে কাঁদতে বসলি। কী আশ্চর্য দেখ দিদি, চোরের ঠ্যাঙানি খেলাম আমি, অথচ উল্টে তোকেই আমি সান্ত্বনা দিচ্ছি–আমার একটুও লাগেনি, কাঁদিস না দিদি… তুই শুধু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছিস — বন্ধুদের সঙ্গে এভাবে কেউ ঝগড়া করে ? আমি তোকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছি– তাই বলে, ছোটো ভাইকে কেউ এভাবে মারে ? ছিঃ !
তোর চাঁপাকলির মতো আঙ্গুল ছোঁয়া জলপটি আমাকে কখন ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে আমি জানি না। বাবার গলার আওয়াজে যখন ঘুম ভাঙলো,তখন রাত ন’টা। জ্বরের তাড়সে , কোনো কথাই বলতে পারছি না। দিদি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে, আর বাবা আমার গায়ের চাদরটা সরিয়ে ওই বীভৎস মুখটা দেখে আর্তনাদ করে বলছে ? কী হল আমার জেনোর ? খেলার মাঠে মারামারি করেছে ? না চোট লেগেছে ? কী দরকার ছিল এই বর্ষার মাঠে খেলতে যাওয়ার ? একে মা হাসপাতালে, তার ওপর হাত পা ভেঙে বসে থাকলে , কে দেখবে ? আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় দিদি তখন ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলেছে। আর আমি জ্বর ব্যথা ভুলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলে উঠেছি — না বাবা না, আমি খেলতে যাইনি। এই দেখো,আমার বালিশের পাশে বাংলার ডাকাত। আজকে তো স্কুলে রেইনি-ডে ছিল। আমি এই বইটা পড়ছিলাম খাটের একেবারে ধারে শুয়ে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম , জানিনা।দড়াম করে মেঝেতে পড়ে গিয়ে , কপাল ফুলে আলুদ্দম হয়ে গেছে। দিদি আমাকে জলপটি দিয়েছে,আর্ণিকা খাইয়ে দিয়েছে। সহজ সরল বাবা আমাকেই উল্টে বললো — কতদিন বলেছি,খাটের ধারে শুবি না। সামনে পুজোর আগে তোর পরীক্ষা । অন্তত এক সপ্তাহ তো ইস্কুলে যেতেই পারবি না ! কী হবে ? তুই কী কোনোদিনও তোর দুষ্টুমি ছাড়বি না ?
বাবা সঙ্গে সঙ্গে হোমিওপ্যাথি গৃহচিকিৎসা আর নিজের হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্সটা বার করলো। বাবার ওই ছোট্ট বাক্সটা আমার খুব প্রিয় । যেন একটা নরম প্রিয় চকলেট রঙ সারা ঘরটায় ছড়িয়ে পড়লো। হাত মুখ ধুয়ে ,বাবা যত্ন করে পাতলা তুলোর ওপরে আর্ণিকা মাদার টিঞ্চার লাগিয়ে কপালে ভুরুর আলুর ওপরে সেট করে দিলো । আর তরকারির ঝুড়ির আলুটা আমার কানে কানে যেন বললো –কাল না হলেও পরশু বিকেলের মধ্যে আমি আবার তরকারির ঝুড়িতে ফিরে যাবো।সাবাস বন্ধু ! যেভাবে উপস্থিত বুদ্ধিতে দিদিকে বাঁচিয়ে দিলি , তার জবাব নেই মাইরি । শোন, পরশু রাতে তরকারির ঝুড়িতে ফিরে যাওয়া, নীল রঙের আলুটা ফেলে না দিয়ে,তোর টল-গুলি, কাচের গুলির বাক্সের মধ্যে যত্নে রেখে দিস । নে নে, ঘুমিয়ে পড় । কাল সকাল বেলায় দেখবি ,ব্যথা কমে গেছে। আমি সেই কথাটা বাবাকে বলতে যেতেই আলতো ধমক– সেকি ? কাল সকালেই ব্যথা কমে যাবে ? একি ম্যাজিক নাকি ? শিখা, ওকে এক কাপ গরম দুধ দে।সঙ্গে দু চামচে মধু মিশিয়ে দিবি। কাল সকালে অফিস যাওয়ার আগে আমি ওকে বণিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
অনেক রাতে, বাবার চাপা নাক ডাকার শব্দকে ছাপিয়ে পাশের ঘর থেকে একটা গুমরে গুমরে ওঠা কান্নার শব্দ…. খাদের পাড় থেকে ,সাতশেয়ালের একসঙ্গে ডেকে ওঠা, উল্টোদিকে বাবার বন্ধু অমর কাকুদের নিমগাছে , একটা ভারিক্কি গোছের হুতুম পেঁচা সবজান্তার মতো হুম হুম শব্দ করে যাচ্ছে। কান্নার শব্দটা দিদির । দুঃখ পেয়ে কাঁদছে।আর আমি …..হাড়কাঁপানো জ্বর আর ব্যথার আক্রমণে , ঠোঁট কামড়ে আপ্রাণ ঘুমের চেষ্টা করছি। একমাত্র মা জানে, যেদিন রাতে আমার জ্বর আসে,সেদিন সারারাত ঘুমহীন আমি , কতবার পাহাড় থেকে পড়ে যাই, কতবার সমুদ্রের অতলে ডুবে যাই, কতবার মাকে বিরক্ত করি — মা একটু কপালে একটু জলপটি দেবে ?
আজও তাই যেন আশ্চর্য এক ঘোরের মধ্যেই বিড়বিড় করে বলে চললাম….ও মা, তুমি দিদিকে ক্ষমা করে দিও। বেশ করেছে ও আমাকে মেরেছে। আমি কিচ্ছু মনে করিনি। তুমি ওর স্বপ্নে এসে, একবার ওকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।
প্লিজ, মা প্লিজ….
আমার দিদি ঘুমোতে পারছেনা যে!