মহালয়ার গভীর রাত। পাড়ার কুকুরগুলো তখনও মাংসের হাড় চিবোনোয় মশগুল। মাঝে মাঝে ঘ্যাঁক — ঘ্যাঁক আর ঘেউ ঘেউ আওয়াজ। শিয়াল ডেকে উঠল ঝিলের পাড়ে । মা একবার বলল ,ঘুমিয়ে পড় । মার পাশ থেকে দিদিও বললো, মন খারাপ করিস না ,ঘুমিয়ে পড়।কাল সকালে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।আমি অন্ধকারে মাথা নেড়ে যাচ্ছি ঠিক আমার দাদার মতন । দাদাকে বাবা যতবার বলে , ঘুমিয়েছিস বিলু ? দাদা কোন উত্তর না দিয়েই অন্ধকারে মাথা নাড়ে । শেষে বাবা দাদার মাথায় হাত দিয়েই বুঝতে পারে যে , দাদা তখনও আদৌ ঘুমোয়নি ।আমারও সেই অবস্থা।
বাবার মতো অতটা না হলেও , আমাদের মাও একটু-আধটু নাক ডাকে। সঙ্গীতশিল্পী তো ! তাই বেশ সুরে বাঁধা সেই নাক ডাকা। নাহ্ , এসব বর্ণনা করবার মতো অবস্থায় আমি নেই । মহালয়ার সন্ধেবেলায় পাড়ার আগমনী গানের জলসায় যত ভালো গানই হোক, আমাকে কোন কিছুই টানেনি আজ । আমি, বংশী , কানু আর শ্যামল একটু চাপে ছিলাম। ফাইনালে হেরে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা।ডানপিটের পক্ষ থেকে প্রোটেস্ট জানিয়ে রানার্স আপ কাপটা নেওয়া হয়নি।তবে সার্টিফিকেটগুলো সবাই পেয়েছি , এটাই যা সান্ত্বনার। সকাল বেলা উঠে মহালয়ার চন্ডীপাঠ ,বেলা বাড়লে কচুরি শিঙাড়া জিলিপির ব্রেকফাস্ট খেয়ে নেওয়া। বেলা বারোটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে , তারপর রাজার ছেলের মতো গুটিগুটি ফাইনাল খেলার মাঠের দিকে যাওয়া। বাবা আবার আজকে একজন রিক্সাকাকুকে বলে দিয়েছিল গঙ্গার ধারে জয়ন্তী মাঠ পর্যন্ত আমাদের চার বন্ধুকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু মাঠে ঢুকেই মন খারাপ হয়ে গেল। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে — সদ্য ফুটবল খেলা থেকে অবসর নেওয়া প্রখ্যাত ফুটবলার, আজকের প্রধান অতিথি মাননীয় শ্রী চুনী গোস্বামী অনিবার্যকারণবশত আজ আসতে পারছেন না। আমরা তার স্থানে পেয়েছি আরেক দিকপাল প্রাক্তন ফুটবল খেলোয়াড় শ্রী বলাই দাস চট্টোপাধ্যায়কে,যিনি খালি পায়ে ইংরেজ ফুটবলারদের বুটের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের হয়ে লড়াই করে গেছেন আজীবন, ঠিক গোষ্ঠ পালের মত । তিনি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই …
ঘোষণা শেষ হতেই আবার সেই —
কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে ,মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে… তার উপর কমলদা দেখলাম মাঠময় ছোটাছুটি করছে। একটা কাগজ নিয়ে, ওটা নাকি প্রতিবাদ পত্র ।আমাদের অপোনেন্ট গঙ্গার ওপারের বালির কিশোর সংঘ নাকি বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে বয়স ভাঁড়িয়ে খেলাচ্ছে । তাদেরকে কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই খেলতে অ্যালাও করেছে ।আর সেই জন্যেই কমলদার এত ছোটাছুটি। আমার তখন স্বপ্নভঙ্গের চাপা কান্না। চোখের সামনে চুনী গোস্বামীকে দেখতে পাবো না ? পাশে বসা কানু আমাকে মনে করিয়ে দিলো ,বলাই দাস চট্টোপাধ্যায় বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধাও ছিলেন ; গড়ের মাঠে যিনি বলাই চ্যাটার্জী নামে পরিচিত । স্বাধীনতার আগে ইংরেজ ফুটবলাররা তাকে রীতিমত ভয় পেত ।আর আমার ভয় করছে , দর্শকের মধ্যে আমি বাবাকে দেখে ফেলেছি বলে। একেই নাইন এ সাইড ফুটবল টুর্নামেন্টের ছোট মাঠ , খেলবার সময় দর্শকের ঘাড়ে গিয়ে পড়তে হয় । তার ওপর বাবা সমানে চেঁচাবে।দূর দূর ! এটা কি ফাইনাল খেলা, না, জেলখানা ! ডানপিটের কমলদা আজ কেমন মিইয়ে গেছে। যেন প্রথম থেকেই হার মেনে নিয়েছে। আমাদের এসে বলল , লড়াই ছাড়বি না। আমাকে বিশেষ করে বলল , আজকে মেসোমশাই এসেছেন কিন্তু খেলা দেখতে। ভালো খেলা চাই আর গোল চাই। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল — আচ্ছা কমলদা , বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের কি দাদা বলব , না কাকা বলব ? সঙ্গে সঙ্গে আমাদের একচোট ফিচেল হাসি , আর কমলদার ভুরু কুঁচকে সরে যাওয়া। আজ আর কিছুতেই মাঠের বাইরে গানে মন টানছে না। শুধু মনে হচ্ছে যদি ওই গানটা দিত খুব ভালো হতো । কোন গানটা ? ওই যে হেমন্ত মুখার্জীর– তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ , একি অভিশাপ, নেই প্রতিকার…
তার কারণ , অপোনেন্ট এর গাঁট্টাগোট্টা চেহারাগুলো গোলগোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছিল আর হিহি করে হাসছিল। বাঁশি বাজল । আমরা জড়ো হলাম মাঠের মাঝখানে । তার মধ্যেই বালি কিশোর সংঘের একজন আমাকে শাসিয়ে গেল — এবার পুজোয় বাড়ি থেকে বেরোতে পারবি না ,এমন জোড়া পায়ে ট্যাকেল করবো ! মাকে বলেছিস তো ! চুন -হলুদ গরম করে রাখতে ! আমি চিরদিনের ভ্যাবাগঙ্গারাম , উত্তরটা কিছুতেই মুখে এলো না। বংশী তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে আমাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে ওদের উদ্দেশ্য করে বললো — সন্ধেবেলা গঙ্গার ওপার পর্যন্ত যেতে পারবি তো ? নাকি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দেবো ? ছেলেটা মনে হল এবার একটু থমকে গেলো।
কিন্তু খেলা শুরু হতেই বুঝতে পারলাম , ওদের জমকালো রংয়ের জার্সির নিচে চোরাগোপ্তা ছুরির মতো লুকিয়ে আছে কত আজব রকমের মার । একে খালি পায়ের ফুটবল ; বড়জোর অ্যাঙ্কলেট খানিকটা রক্ষা করছে। কিন্তু ততক্ষণে আমি মার খাওয়ার ভয়েই গুটিয়ে গেলাম । ফাস্ট হাফে ওদের লিড পরিষ্কার দু’গোলে । ওরা দুই আমরা শূন্য ।