• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ২৩)

রূপকথা পৃথিবীর

অবাক খুশির সেই আশ্বিন মাসে
শিউলির হাসি ভরে দেয় ভিজে পাতা
শঙ্খচিলের ডানায় মিশেছে ছুটি
দুগ্গার মুখ এঁকেছে শিশুর খাতা !
দিদি,এই দিদি। একবার দেখে যা — কী দারুণ মা দুগ্গার মুখ এঁকেছে পাশের বাড়ির বুড়ি !
পুজোর আগের শেষ রোববারের দুপুরে জমাটি ক‍্যারাম খেলার আড্ডা বসেছে আমাদের বাড়িতে। চন্দন বাচ্চু দেবু খোকন কানু বংশী শ‍্যামল — সবাই মিলে বাবার বড় সাধের আবছা হলুদ প্লাইউডের ওপর , কালো সেগুন কাঠের বর্ডার দিয়ে বাঁধানো বোর্ডকে ঘিরে বসেছে । ক‍্যারামের ম‍্যাচবোর্ডটা আমাদের বাড়ির একটা সম্পদ । পাড়া কেন , এই এলাকার কারোর বাড়িতে এমন ক‍্যারাম বোর্ড নেই । কালো সাদা আর লাল গুটিগুলোকে দীর্ঘদিন তার্পিন তেলের মধ‍্যে ভিজিয়ে , তৈরী হয় এমন শক্তপোক্ত গুটি , যা বাজারের সস্তা গুটির মতো হঠাৎ জাম্প করে না। বাবার মানিব‍্যাগে সবসময় থাকে দুটো কালো রঙের ভারি স্ট্রাইকার আর একটুকরো শিরিষ কাগজ । ক‍্যারাম খেলতে বসে , বাবা সবার প্রথমে ডান হাতের তর্জনী আর মধ‍্যমার নখের ডগাগুলোকে শিরিষ কাগজে ঘষে নেয়।তারপরে , ওপর থেকে একশো পাওয়ারের ল‍্যাম্প জ্বলা বোর্ডের ওপর শুরু যেন হয় শিল্পের ছোঁয়া ! বাবা , মাঠ দাপানো ফুটবলের পাশাপাশি , ইনডোর গেম — ক‍্যারাম, তাস, দাবা আর ব‍্যাডমিন্টন খেলাকেও শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় । বাবার নিজস্ব সংগ্রহে রয়েছে ইংল্যান্ড থেকে আনানো , নাকি উপহার পাওয়া তাস ও দাবার ওপর দুটি দুষ্প্রাপ্য বই । আমার লড়াকু বন্ধুরা মাঝে মধ‍্যেই রবিবারের দুপুরে , হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাবার পার্টনার হয়ে , বিপক্ষকে ক‍্যারামে পরিষ্কার নীল গেম দেওয়ার জন‍্য । শুনেছি বারো বছর বয়সের দাদা নাকি বাবার কাছে ক‍্যারামে নীলগেম খেয়ে , ঠোঁট ফুলিয়ে গাল ভাসিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতো ! আর তাই দেখে , সদ‍্য মুখে বুলি ফোটা আমি মার কোলে বসে দাদাকে ক্ষ‍্যাপাতাম — মেপাজি ই ই ই… আবার নবুর নস ?
আসলে , বাবা দাদাকে আদর করে মেপাজি বলে ডাকতো আর হেরে গেলে দাদার কান্না থামানোর জন‍্য বলতো — মেপাজি , আবার লেবুর রস ?
আমি কিন্তু এখন সবসময় বাবার বিপক্ষে বসি । আর, বাবা সেঞ্চুরি মিস করলে , ফাঁকা মাঠে কালো গুটিগুলো গুরুমারা চ‍্যালার মতো অনায়াসে পকেটে গলিয়ে দিয়ে , বাবার সাবাস কুড়োই । সেদিন একটা গেম খেলে, বন্ধুকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে , যেই বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি , অমনি উল্টোদিকে অমিতদের বাড়ির চার বছরের পুচকে বুড়ির চিৎকার — এই ঝন্টুদা , দেখবি , আমি কি এঁকেছি ? বলেই জানলার শিক গলিয়ে আঁকার খাতাটা তুলে ধরলো আমার সামনে । ওইটুকু মেয়ে কী অপূর্ব এঁকেছে মা দুগ্গার মুখ ! তাতে আবার কালার পেনসিল দিয়ে নিজের মতো করে রঙে রঙে ভরিয়েছে । আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম — দিদি , এই দিদি দেখে যা — কী সুন্দর দুগ্গার মুখ এঁকেছে আমাদের পাকা বুড়ি !
ততক্ষণে বুড়িকে নিয়ে ওর দাদা অমিত চলে এসেছে আমাদের বাড়িতে । বাবা চড়া আলোর নিচে ঝকঝকে ক‍্যারাম বোর্ডের ওপর মেলে ধরলো বুড়ির আঁকার খাতা । আর সঙ্গে সঙ্গে যেন সেই শেষ বিকেলে ,বাইরের আলোকে ভরিয়ে দিলো মা দুগ্গার শিউলি শিউলি হাসি ! দিদি আনন্দে বুড়িকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,সত‍্যিই তুই নিজে এঁকেছিস ? ওর দাদা অমিতের মুখে তখন গর্বের হাসি — সকাল থেকে স্নান খাওয়া ভুলে মেয়ে এঁকেই চলেছে , এঁকেই চলেছে । এবার বাবা ওকে আদর করে পাশে বসিয়ে বললো ,ও পাকা বুড়ি , তুই তো অনেক বড়ো শিল্পী হবি রে ! বল তোর কী খেতে ইচ্ছে করছে ? চার বছরের বুড়ি একটুও না ভেবে বাবার মুখের ওপর বলে দিলো — সিঙেড়ি আর মাংসু । মানে , সিঙাড়া আর মাংস । ভাবা যায় ! কী অদ্ভুত কম্বিনেশন !
আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম বুড়িকে আদর করবার জন‍্যে । কতগুলো দামালের আদরে সে বেচারার মুখের ভাব এমন , যেন ভাবছে.. যাঃ বাবা ! মা দুগ্গার মুখ আঁকলে এত আদর পাওয়া যায় ? বাবা বললো — মাংসুটা সামনের রোববার হবে।আর সিঙেড়িটা এখনই হোক। বুড়ি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো…আমি ছুটলাম , পাড়ার মোড়ে টাকলুদার বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে , বেতের ঝুড়ি আলো করা রাশি রাশি সিঙাড়ার দিকে।
সবাই চলে যাবার পরে, সন্ধেবেলায় পড়তে বসে, দিদির মুখে জানলাম, এবার পুজোটা নাকি আশ্বিন পেরিয়ে কার্তিক মাসে ! ফ‍্যানের হাওয়ায় দোলা অক্টোবর মাসের ক‍্যালেন্ডারের পাতাটা বারবার জানিয়ে দিচ্ছে– উনিশে অক্টোবর মহাষষ্ঠী…উনিশে… উনিশে… উনিশে….
এবার পুজোতে মামার বাড়িতে যাওয়া নেই । যদিও মণিমামা এসে , আমাদের তিন ভাইবোনের জন‍্যে নতুন জামাকাপড়, মায়ের জন্যে তাঁতের শাড়ি দিয়ে বারবার করে বলে গিয়েছে , পুজোর সময়ে মামার বাড়িতে যাওয়ার কথা , যেমন প্রত‍্যেকবার যাই । কথাটা ভাবতে গিয়ে আমি ফিক করে হেসে ফেললাম– আচ্ছা দিদি, মা হাসপাতালে ,আর আমরা মামার বাড়িতে যাবো ? তোর মনে আছে , মা’র সেই ছড়াটা ?
গলা নেই গান গায় মনের আনন্দে,
আর , বৌ নেই শ্বশুরবাড়ি যায় পূর্বের সম্বন্ধে !
আমরা দুজনেই খানিক্ষণ খ‍্যাক খ‍্যাক করে হাসলাম । বাবা খাটের ওপর আধশোয়া অবস্থায় , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি পড়তে পড়তে চমকে উঠে , আমাদের দিকে তাকিয়ে , গম্ভীর হতে গিয়েও ফিক করে হেসে ফেললো– শিখা , জেনো , মনে রাখবি , বুড়ি অমিতদের চার ভাইবোনকে নেমন্তন্ন করে পেট ভরে মাংস খাওয়াতে হবে । দিদি সুযোগ পেয়ে আবদার করে বলে উঠলো — ও বাবা , পুজোটা তো মন খারাপ করেই কাটবে। এবার কালিপুজোর দিন আমাদের বাড়ির লক্ষ্মীপুজো , তারপরে ভাইফোঁটা হবে তো ? বাবা বই নামিয়ে , চশমা খুলে , একটু যেন সিরিয়াস হয়ে বললো — তোদের মাকে কিন্তু কোনোরকম ধকল নিতে দেওয়া যাবেনা । তাহলে এতসব করবে কে ? দিদি বুক ঠুকে মিলিটারি কায়দায় বলে উঠলো — আমরা সবাই হাতে হাতে করবো। মঙ্গলাদিকে ডেকে নেবো । মা শুধু বসে বসে আমাদের ডিরেকশন দেবে । বাকি সব আমি সামলে নেবো । মামারা না এলে ভাইফোঁটা জমে ? বাবা যেন কোন অতল থেকে বলে উঠলো — তুই এত বড় কবে হয়ে গেলি রে শিখা ?
কালিপুজোর ঠিক দিন তিনেক আগে , বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ একটা ঝকঝকে ট‍্যাক্সি আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো । বয়স্ক পাঞ্জাবি ড্রাইভার আর বাবা মিলে , মাকে ধীরে সুস্থে নামালো গাড়ি থেকে । আশেপাশের বারান্দা আর জানলাগুলো থেকে প্রতিবেশীদের উজ্জ্বল হাসিমুখগুলো যেন আগামী ভূতচতুর্দশীর অন্ধকারকে তাড়িয়ে রাশি রাশি মাটির প্রদীপ জ্বেলে দিলো । দিদি চোখের জল মুছতে মুছতে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো । মা যখন বাড়িতে ঢুকে গেছে , আর শিখ ড্রাইভার-জেঠু জল মিষ্টি খেয়ে মাকে আশীর্বাদ করে হাসিমুখে বিদায় নিচ্ছেন , জানো, তখন আমি কী করলাম ?
বাড়ি থেকে এক ছুটে বেরিয়ে গিয়ে, চেনা শিউলি স্থলপদ্ম গাছগুলো টপকে , পাড়ার শেষে ধানমাঠের ধূসর হয়ে যাওয়া কাশফুলগুলোর কাছে গিয়ে বসলাম । একা। একদম একা । মাথার ওপরে বিকেলের ঝকঝকে নীলাকাশ , পায়ের কাছের ডোবাটার কাচ রঙের স্বচ্ছ জলে , পুঁটি খলসেদের নির্ভয় ঘোরাঘুরি , জলের নিচে কাদার ওপর অলস বেলে মাছের চুপ করে শুয়ে শুয়ে হাই তোলা । আমি একটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে নিয়ে দাঁতে কাটতে কাটতে বললাম — তোরা জানিস , মা দুগ্গার ভাসান হয়ে গেলেও ভগবান আজকে আমাদের মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়েছে !
তাই শুনে , জলফড়িং আর কলমিলতাদের কী লুটোপুটি হাসি ! পুঁটি খলসেদের কী অবাক খেলাধুলো ! নীলাকাশ আর কাশবনের কী অবাক চেয়ে থাকা — তোর মা বাড়ি ফিরে এসেছে ? সত‍্যিই ফিরে এসেছে !
কাশবন বললো — আমাকে নিয়ে যাবি তোর বাড়ি ? তোর মা তো এবারে কাশফুলই দেখেনি রে ।
আমি সেই ধূসর কাশের একগুচ্ছ তুলে নিয়ে , খলসে পুঁটিদের সান্ত্বনা দিয়ে বললাম — না রে আজ আর তোদের হাতছিপে ধরতে আসিনি। এই সুখবরটা দিতে এসেছিলাম শুধু । তোরা সবাই ভালো থাকিস ।
কাশের গুচ্ছ হাতে আমি যখন বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম , তখন দিদি সন্ধের শাঁখ বাজাচ্ছে , আর , চেয়ারে বসা কিছুটা অবসন্ন মায়ের কোলে রবিঠাকুরের গীতবিতান।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।