হাওড়া আহমেদাবাদ মেল টা হু হু করে এগিয়ে চলেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টা বেশ আমেজের সাথেই টানছিলো শ্যামল, হঠাৎ নারী কন্ঠে “excuse me ” কথাটা কানে আসতেই ফিরে তাকালো ও । দেখলো এক ভদ্রমহিলা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে । শ্যামল একটু বিব্রত বোধ করলো। দেখে মনে হলো অবাঙ্গালী তাই জিজ্ঞাসা করলো – Do you want any help?! ভদ্র মহিলা হিন্দিতে বললেন – পহেচানা? শ্যামল অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকলো, বললো -নেহি! উনি বললেন “কুছ ইয়াদ কিজিয়ে” বলেই বাঁহাতের ইন্ডেক্স ফিংগার টা হাতে নিয়ে বেশ ভালো করে মুচড়ে দিলেন। শ্যামল আশ্চর্য এবং অবাক হয়ে গেলো, ব্যথায় ‘ আহ’ করে উঠলো। ভদ্রমহিলা হেসে ভিতরে চলে গেলেন। সিগারেট টা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, একটান দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। আঙুলটায় একটু ব্যাথা অনুভব করলো আবার।
শ্যামলের বার্থটা নিচে ছিল এবং সাইডে। কামড়ায় প্রায় সবাই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। রাতে ডিনারের পরে শ্যামল’ও বিছানা করেই সিগারেট খেতে গেছিলো তাই সন্তর্পণে বিছানায় এসে সামনের পর্দা টেনে টান টান হয়ে একটা বেড সিট গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। কম্বল টা পায়ের কাছে রাখলো, পরে ঠান্ডা লাগলে গায়ে দিয়ে নেবো।
সবে চোখটা লেগে এসেছিল, হঠাৎ কারো হাত শ্যমলের মুখে স্পর্শ হওয়ায় ঘুম টা ভেঙে গেল। শ্যামল হাতটা ধরে পর্দা সরাতেই দেখে ঐ ভদ্র মহিলা। উনি ওকে ইশারায় চুপ করতে বলে হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে চলে গেলো।
শ্যামল রিডিং লাইটা জ্বালিয়ে নিয়ে চিরকুট টা খুলতেই দেখে বড় বড় করে লেখা – বরোদা কি সুনীতা হুঁ, কুছ ইয়াদ আয়া?
এক নিমেষের মধ্যেই শ্যামল বছর দশেক পিছিয়ে গেলো। ঠিক এই রকমই সফর করছিলো ট্রেনে। হাওড়া- আহমেদাবাদ এক্সপ্রেসে যাত্রা শুরু করেছিল, গন্তব্য স্থল ভুসোয়াল।
ঠিক এই রকমি সাইডে লোয়ার বার্থে রিজার্ভেশন ছিল। পাশেই একটা মারোয়ারি ফ্যমেলি সফর করছিলো, স্বামী – স্ত্রী সাথে দুটি মেয়ে।
শ্যামল নতুন চাকরি তে জয়েন করার পর প্রথম বার মা বাবার সাথে একমাসের ছুটি কাটিয়ে আবার কর্ম স্থলে যোগ দিতে চলেছে। সময় কাটাবে বলে হাওড়া থেকে বেশ কয়েক টা বাংলা, ইংরেজি মিলিয়ে বই কিনে নিয়েছে। বই পড়েই সময় কাটছিল, হঠাৎ বইয়ের ওপর একটা ভাজা ছোলা এসে পড়লো, শ্যামল ওপরের বাংকে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই তাই ভুরু টা কুঁচকে আবার পড়ায় মন দিলো । অল্প সময় পরেই টকাস করে আরো একটা ছোলা এসে পড়লে খোলা বইয়ের ওপর। এবার পাশে তাকাতেই দেখলো এক বোন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে আর এক বোন শ্য্যমলের দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছে। ছোলা দুটো উড়ে আসার উৎস টা শ্যামলের বুঝতে বাকি রইল না। শ্যামল কিছু বলতে যেতেই তর্জনী টা মুখের ওপর রেখে ইশারায় চুপ করতে বললো। শ্যামল মুখ ঘুরিয়ে পড়ায় মন নিবেশ করলো। তখন আরো আধা ঘন্টা কেটেছিল, হটাৎ পায়ে একটা বেশ জোরে চিমটি কাটার অনুভূতি নিয়ে শ্যামল দেখলো পাশের সেই মেয়েটি হেঁটে চলে যাচ্ছে যে নাকি ছোলা ছুঁড়ে মেরেছিলো । একটু দূরে যেতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে শ্যামল কেও বাইরে যাওয়ার ইশারা করলো। শ্যামল ওর কথায় না গিয়ে পড়ায় মন দিলো।
কিছুক্ষণ পরে কম্পারটমেন্টের অ্যটেনডেন্ট শ্যামল কে মৃদু স্বরে বললো – বাহার বুলা রহি হ্যায় । শ্যামল বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো কাঁচের দরজার ওপার থেকে হাতের ইশারায় ডাকছে।
শ্যামল ব্যপার টা কি বোঝার জন্য অগত্যা বাইরে এলে। মেয়েটি হাই বলেই – বললো মেরা নাম সুনীতা। শ্যামল পরিচয় দিয়েই বললো- কুছ কহেনা হ্যায় কা? সুনীতা – হুম্ বহুত কুছ! আপ কাহা যা রহে হো?
শ্যামল – ভুসোয়াল।
সুনীতা – ক্যায়া করতে হো।
শ্যামল – এক কোম্পানি মে ইঞ্জিনিয়ার কা নোকরি করতা হু। আপ?
সুনীতা – ইংলিশ মে গ্র্যাজুয়েশন কর রহি হু। আপ কা নোকরি কিতনা দিন হুয়া হেয়?
শ্যামল – ছে মাহিনা।
সুনীতা – আপকা ঘর মে কোন কোন হ্যায়?
শ্যামল – মেরা প্যারেন্টস্। আপকা?
সুনীতা – মমি – পাপা আউর বহেন। হামলোগ বরোদা রহেতে হেয়। কলকাত্তা গয়ে থে রিলেটিভিটি কে সাদী মে। আপকা কৈ গার্ল ফ্রেন্ড হেয়?
শ্যামল : কিঁউ?
সুনীতা : অ্যয়সেই পুছা।
শ্যামল : নেহি।
সুনীতা : আপ বহুত কিউট হো।
শ্যামল : থ্যাংকু। আপ ভি বহুত সুন্দর হো। চলো শো যাতে হ্যায়। নিদ আ রাহা হেয়।
শ্যামল কামড়ার দিকে পা বাড়াতেই সুনীতা ওর খুব কাছে চলে এলো। শ্যামল কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুনীতা এক হাত দিয়ে শ্যামলের মুখ টা হাতে নিয়ে আলতো করে গালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে বললো – I Love you.
শ্যামল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কামড়ার দিকে পা বাড়ালো। সুনীতা বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেদিলো।
সকালে ঘুম ভাঙলে পর্দা সরাতেই দেখলো সুনীতা সামনের সিটে বসে ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি করে হাসছে।
সারাদিন সুনীতা কখনো ইশারায় , কখনো লুকিয়ে চিমটি কেটে, কখনো কাগজ ছুঁড়ে প্রেম করে গেলো শ্যমলের সাথে। ট্রেনটা লেট চলছে তিন ঘন্টা। ভুসয়াল পৌচ্ছাতে পৌচ্ছাতে রাত এগারোটা, সাড়ে এগারোটা বাজবে। শ্যামলের মনেও যেন সুনীতার জন্য একটা ভালোবাসা বিন্দু বিন্দু জমতে শুরু করেছে। সত্যিই সুনীতা খুব মিস্টি দেখতে, কথা বার্তাও বেশ মার্জিত। তবে খুব সাহসী।
সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো, শ্যামলের মনটা একটু বিষন্ন হতে শুরু করলো। ওর এটা কেন হচ্ছে! কেন সকাল থেকে একটা বই এর দু পাতার বেশী পড়তে পারেনি! না না রকম ভাবনা মাথায় ঘুর পাক খেতে লাগলো। শ্যামল ভাবতে শুরু করলো এটাই কে প্রেমে পড়ার লক্ষন?! বিকেলের আলো না ফুরনো অবধি সুনীতার দিকে যখনই তাকিয়েছে হাসি দেখেছে, অথচ এখন কেন যেন ওর মুখেও উদাসী হাওয়া বয়ে যাওয়ার একটা ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
শ্যামল বই পড়ায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। চেষ্টা করলো সুনীতাকে বোঝাতে যে ওর মন একদম দূর্বল হয়নি ওর জন্য।
দেখতে দেখতে ঘড়িতে আটটা বেজে গেলো। রাতের খাবার এসে গেলো। শ্যামল রাতের খাবার অর্ডার দেয় নি, অফিসার্স ক্যান্টিনে খেয়ে নেবে। সুনীতারা বাড়ি থেকে খাবার এনেছে সকাল থেকে ওগুলোই খেয়ে যাচ্ছে। মারোয়ারিরা এটাই করে সাধারনত।
হঠাৎ সুনীতার মা একটা কাগজের প্লেটে দুটো শুকনো পরোটা, একটা শুকনো সবজী খুব সম্ভবত আলুর আর কিছুটা আচার শ্যমলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো – লে বেটা খালে। শ্যামল একটু অপ্রস্তুতে পরে গেলো । ঠিক না করতে যাবে এমন সময় সুনীতার চোখে চোখ পরতেই, সুনীতা চোখের ইশারায় খেয়ে নিতে বললো। শ্যামল নিঃশব্দে দু হাত পেতে খাওয়ার টা নিয়ে একটা পেপারের ওপরে রেখে হাত ধুয়ে এসে খেয়ে নিলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবে বইয়ে মন দেবে এমন সময় এই প্রথম সুনীতার বাবা জিজ্ঞাসা করলো – বেটে আপ কাঁহা যা রহে হো?
শ্যামল একটু হকচকিয়ে গেলো ওর বাবার গুরুগম্ভীর আওয়াজ শুনে ! শ্যামল নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে উত্তর দিলো – ভুসোয়াল যা রহে হেয়। উঁহা নোকরি করতা হুঁ, ছুটি সে লোটরাহা হুঁ।
কথাটা ঐ পর্যন্তই থেকে গেলো। আর আগে কোন কথা এগুলো না।
একটু পরেই শ্যামল টুকটাক নিজের জিনিস পত্র গুছিয়ে নিলো কারণ অন্যান্য সকলে ঘুমোবার ব্যবস্থা শুরু করেছে, প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। আর এক ঘন্টার মধ্যে নামতে হবে।
হঠাৎ একটা কিছু বিছানায় পরলো, খুঁজে দেখে শ্যামল পেল বিস্কুটের টুকরো, সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো সুনীতা আপার বাঙ্কে বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি। শ্যমলের গতকাল রাতের আলতো করে চুমু টা মনে পরে গেলো।
হঠাৎ সুনীতা নিচে নেমে এলো, কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে ডাকলো শ্যামল কে। শ্যামল বাইরে এসে দেখে সুনীতা অপেক্ষা করছে ওর জন্য। বাইরে এটেন্ডেন্ট টা শোয়ার ব্যবস্থা করছে।শ্যামল ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলে ওখানে বসলো, সুনীতা ওর পাশে বসলো। ওর মুখটা থমথমে। এই বুঝি বর্ষার মেঘের মত বৃষ্টি না নামে!
সুনীতা বললো – ভুসোয়াল অউর কিতনে টাইম বাদ আয়ে গা? শ্যামল বলার আগেই অ্যটেন্ডেন্ট বলে উঠলো – এক ঘন্টা বাদ।
সুনীতা শুনেই নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো, ওর দু’ চোখে অবিরাম ধারায় অশ্রু বইতে লাগলো।
শ্যামল কাছে টেনে নিলো।
সুনীতা একসময় বললো – তুম অ্যাড্রেস দো,
শ্যামল একটা কাগজে ঠিকানা টা লিখে দিলো।
ঠিকানা টা পেয়ে সুনীতার মুখে হাসি ফুটলো, শ্যামলের মুখটা কাছে টেনে অনেক গভীর ভাবে চুমু খেলো।
সুনীতা বললো – তুমহারা সমান লেকে আও। হাম থোরে দের বাদ ফির মিলতি হুঁ।
শ্যামল কামড়ার ভেতরে যাওয়ার সময় অ্যটেন্ডেন্টের হাতে 50 টা টাকা দিলো।
দশ মিনিটের মধ্যেই শ্যামল ওর ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে এলো, ট্রেনের দরজা টা খুলে একটা সিগারেট ধরালো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুসোয়াল ঢুকে যাবে ট্রেন টা। তার আগেই সুনীতা এলো, হাতে অ্যলুমিনিয়ামের ফয়েলে করে পরটা আর আচার।
সুনীতা বললো – রুম মে পৌঁছকে ফ্রেশ হোকে খা লেনা। রাত কো ভুখ লাগেগি।
শ্যামল ওর কথায় হাসলো, বললো- খা লুঙ্গা।
ট্রেনটার গতি ধিমে হতে লাগলো, দেখতে দেখতে ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম এ ঢুকে গেলো।
সুনীতার চোখ ছল ছল করে উঠলো।
শ্যামল ওর ডান হাত টা বাড়িয়ে দিলো বিদায় নেওয়ার আগে, সুনীতা রাগে দুঃখে ওর ইন্ডেক্স ফিঙ্গার টা এমন ভাবে মোচড় দিয়ে দিলো যে শ্যামল যন্ত্রনায় ‘আহ ‘ করে উঠলো! তবুও নামার আগে সুনীতা কে কাছে টেনে নিলো।
ট্রেন প্লাটফর্মে থেমে গেলো।
শ্যামল নেমে গেলো। মেন গেট দিয়ে বেরোনোর সময় পিছন ফিরে দেখলো ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে, সুনীতা ওর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে যাচ্ছে… আস্তে আস্তে ট্রেনটা অন্ধকারে মিশে গেলো।