অথ শ্রী উপন্যাস কথায় আরণ্যক বসু (পর্ব – ৫৩)

শালজঙ্গলে বারোমাস ছয়ঋতু

সে যখন আসে চাতক পাখির স্তবে,
আষাঢ় গোধূলি মেঘের মহোৎসবে ;
বর্ষণে ,রাতে ,বজ্রের শিহরণে,
অবাক পাতারা ভিজছে শালের বনে ।

শরীরটা ভালো না থাকায় ,আর গরমে ক্লান্ত হতে হতে ইদানিং খুব একটা টিভিতে চোখ রাখে না অমলেন্দু। জুনের মাঝামাঝি মৌসুমী নিম্নচাপের সুখবরটা সে জানতোই না । ভোরবেলা বাইরে পাগলা বিন্দাসের চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে গেল । না না , চিৎকার
নয় ,গান । অমলেন্দু শুনতে পেল — বাউল বিন্দাস প্রথম বৃষ্টির শব্দ ও পদসঞ্চার নিয়ে যেন সতীনাথ মুখার্জির গলায় গেয়ে উঠেছে বর্ষাসংগীত — গানের ধারা মাঝে , প্রাণের কথা আছে , সুর তবু বুঝি না যে, কোথা তারে বলো পাই । এলো বরষা যে সহসা মনে তাই, রিমঝিমঝিম , রিমঝিমঝিম গান গেয়ে যাই….
ধড়মড়িয়ে উঠে বাইরের দরজাটা খুলতে খুলতে নিজেকে ধিক্কার দিলে অমলেন্দু , এত সুন্দর গানটাকে সে চিৎকার ভেবেছিল ? আর , বর্ষা কেন পাগলা বিন্দাস এর আগে তার ঘুম ভাঙালো না ? আর ,কবিতার নারী উন্মনা , সে কী করছিল ? তারই তো উচিত ছিল ভোররাতে তাকে জাগিয়ে দেওয়া , নাকি মৌসুমী বায়ু তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছয়নি ? সেটাও কি অমলেন্দুকে মেঘদূতের মাধ্যমে চিঠি লিখে জানাতে হবে ? দরজা খুলতেই আধভেজা বিন্দাস গানের রেশটুকু নিয়ে একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়ল । বেশ উত্তেজিতভাবে বলল — তুমি যাও , হাত মুখ ধুয়ে এসো , আমি চা চাপাচ্ছি । ‌গুরু , তুমি এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠলে ? আমি তো গ্রামের বাজার থেকে বেগুনি আর চপ , গরম গরম ভাজিয়ে নিয়ে চলে এলাম । তোমার জন্য মুড়ি আর কাঁচা লঙ্কাও এনেছি। গুছিয়ে জল দিয়ে মেখে দুই ভাই মিলে খাব । সঙ্গে দু কাপ করে গরম চা । প্রথম বর্ষাটাকে উপভোগ করব আমরা । সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দাও বর্ষা এসে গেছে ! অমলেন্দু তোয়ালে আর ব্রাশ হাতে বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে হেসে বলল–তুই গানের সঞ্চারীটুকু কর , আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি। অন্য গানে চলে যাবি না । ঐ গানটাই করবি কিন্তু। হা হা‌ করে হাসতে হাসতে গানের শেষটুকু ধরল বিন্দাস — মনের আকাশে কত খুঁজেছি গো তোমায় , মেঘের স্তরে স্তরে রাতের তারায় তারায় , যদি ভরা এ শ্রাবণে তারই চেনা সুর বাজে, হৃদয়ের মাঝখানে , কোথা তারে বলো পাই , এলো বরষা যে সহসা মনে তাই , রিমঝিমঝিম রিমঝিমঝিম গান গেয়ে যাই…
মুখ ধুতে ধুতে অমলেন্দু অবাক হয়ে ভাবে — বিন্দাসের স্টকে এত গান কোথা থেকে আসে ? মা প্রকৃতি কি ওকে সব উজাড় করে দিয়ে গেছে ! সমস্ত ঋতুর সঙ্গীত, বাংলার চিরদিনের সব গান, এমনকি আধুনিক কালের গানগুলোও তার সব মুখস্ত‌ ! এ কী করে সম্ভব হয় ? অথচ লোকটা তো মাধুকরী করে বেড়ায় লালনের গান গেয়ে গেয়ে…
তোয়ালে দিয়ে জলে ভেজা চশমাটা মুছতে মুছতে অমলেন্দু উঠোনে বেরিয়ে আসে । প্রথম বৃষ্টি মাথায় , কপালে ,চোখের পাতায়, সারা অঙ্গে মেখে নিতে চায় । বোঝা যায় ,‌ সেই ভোরবেলা থেকে বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে ,অথচ তার ঘুম ভাঙেনি ? আশ্চর্য ! ভিজে তোয়ালে দিয়ে আবার চশমাটা মুছতে থাকে অমলেন্দু। এবারে বিন্দাসকে বুকে টেনে নিয়ে ,‌তার মাথাটাও মুছিয়ে দেয়। এলোমেলো একরাশ চুলে ভরা পাগলা বিন্দাসের মাথাটায়‌ যেন কতকালের ভালোবাসা আর বিস্ময় একাকার হয়ে আছে । প্রায় জট পাকানো চুল থেকেও কোন দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসছে না। বিন্দাস এমনই একজন মানুষ, শিকড়ের গন্ধ ছাড়া তার কোন অস্তিত্ব নেই , সম্পদ নেই । সে শুধু তার প্রাণের শিকড়টাই খুঁজে চলেছে সারা জীবন ধরে।গানের মানুষ , অথচ কী গভীর তার কবিতা সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ।
রান্নার দিদিকে ছুটি দিয়ে , সেদিন অমলেন্দুকে সামনে বসিয়ে বিন্দাস রেঁধে ফেললো, যেমন তেমন খিচুড়ি , ডিম ভাজা আর পাপড় ভাজা। তারপর দুই বন্ধুতে জমিয়ে খেতে যাবে , এমন সময় বাইরে গেট খোলার শব্দ । দুপুর তখন প্রায় দুটো । বৃষ্টি কখনো পড়ছে , কখনো থামছে । সারা আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে না মাত্র চব্বিশ ঘন্টা আগেও বীভৎস গরম ছিল । বেড়ে রাখা খাবারটা ফেলে , অমলেন্দু বাইরে বেরিয়ে আসতেই বিস্মিত হলো , গেটের সামনে বাদল মেঘ আর তিথিকে দেখে । এমনকি বিন্দাসও চুপ করে রয়েছে । তিথি প্রথম নীরবতা ভাঙলো — ও দাদা, আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করছ ? অমলেন্দু আবিষ্কার করল , তিথির সিঁথিতে এক চিলতে সিঁদুর । এবার বাদল মেঘ খানিকটা অসহায় ভাবেই বলে ফেললো– দাদা , বর্ষা তো এবারে কিছুতেই আসছিল না , তাই তাকে কনের সাজে সাজিয়ে নিয়ে নিজেই চলে এসেছি , শাল জঙ্গলের ছয় ঋতু আর বারো মাসের কাছে। তোমার এই বাড়িটায় চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেবে আমাদের ? মানে, আমাদের নতুন জীবনটা এখান থেকেই শুরু করব আমরা। তোমার এই ছোট্ট বাড়িটাকে আমাদের এখন অনেক বড় মনে হচ্ছে ! অমলেন্দু কথার খেই হারিয়ে ফেলেছিল । সেটা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে নিজেই ভাবলো, বয়সের সাথে সাথে সে যথেষ্ট আনস্মার্ট হয়ে গেছে, রিফ্লেক্স কমে গেছে। সামনে তার দুজন প্রিয় বন্ধু দাঁড়িয়ে রয়েছে , যারা এই মুহূর্তে স্বামী-স্ত্রী,তাদেরকে সে ঘরে ঢোকাতে পর্যন্ত পারছে না ? নাকি তার সংস্কারে বাধছে ? এবার পিছল উঠোন বেয়ে বিন্দাস ছুটলো ওদের দুজনকে ঘরে নিয়ে আসতে। বিন্দাস যে এতো ভালো উলু দেয় , অমলেন্দু কী ছাই জানত ? এবার অমলেন্দু নিজেকে যেন ফিরে পেল । তার ছোট্ট ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা সন্দেশ আর জল বার করে ওদের সামনে রাখলো। তারপরে হেসে বলল — আমি বরকর্তা না কনে কর্তা তা জানি না ,‌ কিন্তু এই মুহূর্তে তোমাদের দুজনের দৃষ্টিপাত ও বৃষ্টিপাতের অভিভাবক হয়ে , তোমাদের সামনে আমাদের অনভ্যস্ত হাতের খিচুড়ি মেলে ধরলাম। এসো আমরা দুজনের খাবার চার জনে মিলে ভাগ করে খাই । তিথি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল , বাদল মেঘ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল– আমাদের বিয়ে করার গল্পটা পরে শোনাবো। আপাতত প্রচন্ড খিদে লেগেছে , তোমার দেয়া অন্নতেই সে খিদে মেটাই । খেতে খেতে জানা গেল , দুজনের বাড়ির আপত্তিকেই হাসিমুখে এড়িয়ে গিয়ে, কোন বাদানুবাদ না করে , সামান্য কিছু জামা কাপড় আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ওরা অমলেন্দুর আশ্রয়ে মাথা গোঁজার জন্য আপাতত চলে এসেছে। অমলেন্দু একগাল হেসে বললো– যাক , তাহলে কবিতার আশ্রয় এক মুঠো আঁচল বিছিয়ে দিতে পেরেছে , তাই না ? বিন্দাসের বিস্ময় তখনও যাচ্ছে না । সে শুধু গরম ডিম ভাজার এক টুকরো কামড়াতে কামড়াতে নরম চোখে বলে উঠলো — আহা, এমন সুন্দর যুগলবন্দি খুব কম দেখা যায় গো। দরাজ গলায় গেয়ে উঠলো– মিলন হবে কতদিনে,আমার মনের মানুষের সনে….
গানের শেষ পর্বে এসে কাশতে লাগলো। অমলেন্দু ওর দিকে জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো । তিথির চুলে এখনো গুঁড়ো গুঁড়ো প্রথম বর্ষণ লেগে রয়েছে। সিঁথির সিঁদুর একটি মেয়েকে এক মুহূর্তেই কতখানি নারীত্ব এনে দিতে পারে, তা উপলব্ধি করলো অমলেন্দু । সত্যি , ওদের দুজনকে খুব সুন্দর লাগছে। বাদল মেঘের মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্ততা ও নম্রতা আছে। রাগী কবিতা লিখলেও ওর সৌজন্যবোধ প্রশ্নাতীত। অমলেন্দুর মনে হলো– তার ছোট ভাই যেন হঠাৎ বিয়ে করে বউ নিয়ে বাড়ি চলে এসেছে , আর সেই মিষ্টি বউটা দাদার নিশ্চিত আশ্রয়ে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আজকের ভোরের প্রথম বর্ষণ সুন্দর, কিন্তু তার চেয়েও সুন্দর প্রথম বর্ষণ মেখে এই প্রেমিক যুগলের বর্ষা ভেজা ছবিটুকু । খাবার শেষে বিন্দাস ছাতা মাথায় বেরিয়ে গেলো , আশেপাশের দু একজন মাসিমা পিসিমাকে ডেকে আনতে। বরণ করতে হবে তো! অমলেন্দু মনে মনে গল্পটা গুছিয়ে নিলো। দূর সম্পর্কের ভাই বিয়ে করে চলে এসেছে, আপাতত তার বাড়িতেই থাকবে, এরকম একটা কিছু। গ্রামীণ কৌতুহল , ছবি তোলা , বধূবরণ, মিষ্টিমুখ, চা পর্ব সবকিছুই মিটে গেল সন্ধের মধ্যে । এই কবিতা যুগলকে বাংলা ভাষাজননী যেন প্রথম বর্ষণের দুটি কবিতা‌র মতো করে পাঠিয়ে দিয়েছে , অমলেন্দুর কাছে উপহার হিসেবে। পিছনের দিকের একটা ঘর বিন্দাস সাজিয়ে দিলো। নতুন দম্পতির জন্য। উন্মনা বারে বারে ফোন করে খবর নিচ্ছে , আর প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছে বিন্দাসদাকে । একবার তার কবিমনকে ঠাট্টা করে বললো– কবিমন এবার কিন্তু তুমি ভাসুর হয়ে গেলে । না না, সত্যিকারের দাদা হয়ে গেলে , অভিভাবক হয়ে গেলে । তোমাকে কিন্তু এখন অনেক দিন সুস্থ থাকতে হবে কবিমন । তারপর সারা সন্ধ্যা , অনেক রাত পর্যন্ত কনফারেন্স কলে কবিতা জন্মের সবাইকে নিয়ে সে কি তুমুল আড্ডা ! প্রত্যেকে নিজের বাড়িতে বসে চা খাচ্ছে , অথচ মনে হচ্ছে এখানেই রয়েছে । বাইরে সন্ধ্যা ও রাতের সঙ্গম মুহূর্তটিতে বৃষ্টি আরো ঘন হয়ে আসে । বাদল মেঘ যে কিছুটা প্ল্যান প্রোগ্রাম করে এখানে এসেছে , সেটা বোঝাতে পারলেও , অমলেন্দুকে বাদল মেঘ নতুন করে প্রস্তাব দিলো– দাদা , তোমার ঘাড়ে বসে কিন্তু আমরা খাবো না। এখানে দুটো কাজ আমরা শুরু করব ।‌ এক হচ্ছে , আমাদের কবিতা ভুবনের প্রস্তুতি ,আর দুই — অন্ন সংস্থানের জন্য কিছু অর্থ রোজগার । আমরা দুজনেই তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত , এখানে স্কুল লেভেলে ইংরেজি, বিজ্ঞান ,অঙ্ক ও অন্যান্য বিষয়গুলো আমরা দুজনেই ভাগাভাগি করে পড়াতে পারবো । কাজেই , তোমার অনুমতি নিয়ে বাইরের বারান্দায় একটা কোচিং সেন্টার আমরা খুলে ফেলতে পারি । আর তুমি তোমার প্রথম অবসর জীবনে সেখানেই বাচিক শিল্পের অনুশীলন কেন্দ্র খুলবে। এর ফলে জনসংযোগ বাড়বে। আমাদের পত্রিকায় কবিতাকে ঘিরে কাজকর্মের সুবিধা হবে। সাধারণ মানুষের আনাগোনা থাকলে অকারণ কৌতুহলটাও কমে যাবে । আমরা নিশ্চিন্তে সবাই মিলে কাজ করতে পারবো। লেখাপড়া শিখে চুপ করে বসে থাকার তো মানে হয় না ।‌ আমরা হয়তো অন্য কোথাও সংসার পাততে পারতাম — তিথি মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো– কিন্তু আমার মনে হয়েছে , দাদার আশ্রয়ে থেকে কবিতা জন্মের শুরুটা এভাবেই হোক না। আমাদের সংসারটা দাদার সংসারে জড়িয়ে দিই আমরা। দাদার একলা থাকার জীবনের একঘেয়েমি কাটবে। সবাই মিলে আমরা একটা কমিউন তৈরি করতে পারি । যেটা আমাদের স্বপ্ন ছিল , সেটাই আমরা বাস্তবে করবার দুঃসাহস দেখালাম। কতদূর সফল হবো জানি না , কিন্তু তোমাদের সবার সামনেই প্রস্তাবটা আমরা রাখলাম। অমলেন্দু লক্ষ্য করছিল ,কনফারেন্স কলে উন্মনা খুব একটা কথা বলছে না। । ব্যপারটা ও সহজ ভাবে নিতে পারছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্ত অরুণিমা , প্রলয় ,শুভ , অর্ধেন্দু সবাই উচ্ছ্বসিত। অরুণিমার কন্ঠস্বর সবার ওপরে কলকল করে উঠলো — দাদা , দিন না একটু আশ্রয়। আপনার তো একা থাকার জীবন। আমাদের তিথি বোন সব কিছু গুছিয়ে দেবে দেখবেন । বাড়ি ফিরে ঠান্ডা রুটি আর বাসি বেগুনভাজা চিবোতে হবে না । কনফারেন্স কল কেঁপে উঠলো সমবেত চিয়ার্স ধ্বনিতে । অপ্রতিভ অমলেন্দু কোনোরকমে জবাব দিলো — আচ্ছা , আমি কি ওদের থাকাতে কোনো বাধার সৃষ্টি করছি ? আমি আর বিন্দাস তো ওদের গ্রহণ করেছি। আমার প্রতিবেশী বৌদি , মাসিমারা তো ওদের দুজনকেই বরণ করে ঘরে তুলেছে । তবে , যে কথাটা আমি মুখ ফুটে বলতে পারছি না ‌, সেটা হলো, আমার বাড়িটা যেহেতু বড় নয় , সেখানে আমার নিজের ঘরটা ছাড়া মাঝারি সাইজের একটা ঘর আর একটা লম্বা করিডোর আছে । সেইটুকুকে আপন করে নিশ্চয়ই ওরা দাদার সংসারে গুছিয়ে থাকতে পারবে । যেহেতু এটা কবিতার আশ্রয়ের অন্তর্ভুক্ত , তাই , ওরা যেন এখানে নিজেদের ভাড়াটে না ভাবে , এটুকুই আমার অনুরোধ। আমি আশ্রয় দিয়ে যে খুব উদারতা দেখালাম , এমন নয়। আসলে নিজের এলাকা থেকে অনেক দূরে , এখনকার দিনে চট করে কেউ দুটি ছেলেমেয়েকে ঘরভাড়া দেবে না । হয়তো অনেক খোঁজ খবরের ব্যাপার সেখানে থেকে যাবে । তাহলে ওরা থাকবে কোথায় ?‌ আর ওরা যেহেতু আমার কাছেই এসেছে , তাই আমার দায়িত্ব বোধটা সেইভাবেই সাড়া দিতে বললো । অমলেন্দুর কথাগুলোর পরে অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা নেমে এলো । অরুণিমা মুগ্ধ কণ্ঠে বললো — দাদা , শুধু ওদের নয় , আমাদের সকলের অনেক সৌভাগ্য যে, আপনার মতো একজন মানুষকে ঘিরে আমরা কবিতাজন্মের স্বপ্ন দেখছি । আমার গলা আবেগে কাঁপছে , এর বেশি কিছু বলতে পারবো না । প্রলয় অবস্থা সামাল দিয়ে বললো — দাদার বাড়ির পিছনের অনেকটা জমি আগাছায় ভরে আছে । সেখানেই না হয় আমরা সবাই মিলে দু একটা ঘর খাড়া করে তুলবো । সেই স্বপ্নে দেখা ঘরদুয়ারেই না হয় স্বজন-সুজন , তিথি-অতিথি , তেঁতুল পাতায় দশজন হয়ে থাকবে । আমরা যেন মনে রাখি , এই আশ্রম সকলের । একা অমলেন্দু মন্ডলের ভাবনা বা দুর্ভাবনার নয়। অনেকক্ষণ বাদে উন্মনার কন্ঠস্বর সবাই শুনতে পেল — খুব ভালো প্রস্তাব। আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি । মাথার ওপর যখন স্যার আছেন , আমাদের দুর্ভাবনাগুলোকে আপাতত ছুটি দিয়ে তিথি আর বাদল মেঘের জন্য শুভকামনা করছি । তবে একটা কথা , স্যারকে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতেই হবে। সেদিক দিয়ে তিথিরা এসে পড়ায় ভালোই হয়েছে। সরি , আমার একটা কল আসছে । মনে হচ্ছে জরুরি কল। আমি কি এই মিটিং ছেড়ে যেতে পারি ?
মিটিং এর শেষে বিন্দাস‌, আমলেন্দু , তিথি , বাদল মেঘ মিলে একটা অগোছালো ঘরকে মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তুললো। অমলেন্দু অবাক হয়ে ভাবছিল — নারীর হাতের যাদুছোঁয়ায় সংসার কী আশ্চর্য ভাবে রূপ বদলে ফেলে ! তার একা থাকার সংসারেও যে চাদর, বালিশ ,ওয়াড় বেডকভার একাধিক রয়েছে , তার খবর কি সে নিজেও জানতো ? ছোটো ঘরের নড়বড়ে খাটটাও বিন্দাস তার ক্ষমতা দিয়ে ঠিক করে দিলো। দুপুরে আড়াই জনের খাবার চারজন ভাগ করে খেয়েছিলো , এবেলা কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিন্দাসকে সরিয়ে তিথি একাই ভাত ডাল ভাজা আর ভিমের ঝোল রান্না করে ফেললো । মেঝেতে পাত পেড়ে চারজন বসে খুব তৃপ্তি করে খাওয়ার পর , বিন্দাস সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে বাড়ি চলে গেলো।
সেদিন অনেক রাতে, পাশের ঘর থেকে নবদম্পতির ফিসফিস থেমে গেলে , নতুন করে বৃষ্টি নামলো । অমলেন্দুর ঘুম আসছিল না । কোন্ জরুরী ফোনের কারণে তার কবিতার নারী মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে গেল ? নাকি , তার কোনো অব্যক্ত অধিকারবোধ এখানে কাজ করছিল ? সে কি তার কবিমনের সংসারে নতুন দুজনের এইভাবে চলে আসাকে মেনে নিতে পারেনি? বৃষ্টির ছাঁট ঘরের মধ্যে আসছিল। তাই জানলা বন্ধ করতে যেতেই , সাইলেন্ট মোডে রাখা ফোনটা গুমরে গুমরে উঠলো । উন্মনার ফোন । স্নিগ্ধ কন্ঠস্বরে কোথাও একটা দারুণ উদ্বেগ ।‌ কবিমন , ওরা ঘুমিয়েছে তো ?
হ্যাঁ । কিন্তু কী হয়েছে তোমার ? মিটিং ছেড়ে চলে গেলে কেন ? কোনো খারাপ খবর নয় তো ?
হ্যাঁ কবিমন , খারাপ খবর তো বটেই । আজ সন্ধেবেলায় আমার স্বামী প্রাণতোষের একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমাকে কাল সকালেই ও বাড়িতে যেতে হবে ।তোয়াকে মায়ের কাছে রেখে যাবো। তোমাকে সময় সুযোগ মতো ফোন করে সব জানাবো।
তারপর অনেকক্ষণ ধরে ফোনের ও প্রান্ত , এ প্রান্ত চুপ। বাইরে শুধু একটানা বৃষ্টির শব্দ।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

1 Response

  1. Ivy Banerjee says:

    অপূর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।