• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (অন্তিম পর্ব)

রূপকথা পৃথিবীর

তুই যখনই তেরো-তে পা ,
পা বললো থাম না এবার ;
পিছন ফিরলে দেখতে পাবি ,
সবুজ বনে দাঁড়িয়ে কে আর ?
তুই যখনই দেখবি তাকে ,
সে ডাকবে হাতছানিতে ;
বলবে–বন্ধু , মনে থাকবে ?
একদিন ঠিক আসবো নিতে ।
এখানেই তুই কুড়িয়ে পাবি ,
তোর ভিতরের ছোট্ট আমি ;
আয় , শেষবার খেলার শেষে ,
সাঁতার কাটতে জলেই নামি ।

ভোটের শেষে সারা বাংলা আলো করে যুক্তফ্রন্ট যখন এলো , আমাদের মা তখন হাসপাতালে দ্বিতীয়বারের জন্য ইলেকট্রিক শক ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে । দিদি যখন মার্চ মাসে জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষা — হায়ার সেকেন্ডারিতে বসতে গেলো , তখন রোগজীর্ণ আমাদের মা , মানসিক হাসপাতালের গরাদ ধরে , অবসন্ন গলায় গান গাইবার ব‍্যর্থ চেষ্টা করছিলো হয়তো। দিদির পরীক্ষার রান্না বাবাকেই করে দিতে হলো । বাবার হাতের দইয়ের ফোঁটা নিয়েই দিদিকে একটার পর একটা দুশো নম্বরের হার্ডল রেস টপকাতে হলো। মাকে প্রণাম করে পরীক্ষা দিতে যাওয়া হলো না। দিদি , তুই এত চুপচাপ , এত শক্ত মনের হলি কি করে বলতো ?
হায়ার সেকন্ডারি পরীক্ষা যেমন ঢাক বাজিয়ে , হম্বিতম্বি করে শুরু হয় ; তেমন স্বাভাবিকভাবেই একদিন শেষও হয়ে যায় । মার্চের শেষে যখন বসন্তের আমেজ পেরিয়ে গরম পড়ছে , তখন তোর পরীক্ষা শেষের হাসিমুখের বদলে , গলায় যেন একটা দমচাপা কান্না আটকে আছে , বুঝতে পারলাম। শেষ পর্যন্ত আমার হাত ধরে চোখের জলে ভেসে যাওয়া — ঝন্টু , মা আর কতদিন হাসপাতালে পড়ে থাকবে রে ? আমি ঠোঁট উল্টে বললাম ,আমি কি ডাক্তার , যে বলবো ? দিদি আমাকে বেপাত্তা করে বললো — রেজাল্ট বেরোতে তো সেই তিন মাস দেরি ; আমি বরং টাইপে ভর্তি হয়ে যাই , কেমন ? কোনো সুখবর যেমন হঠাৎ আসে , পোস্টকার্ডের মতো একটু দেরিতে হলেও , তবু আসে ; মা’র হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার সুসংবাদটা বাবার মুখে একদিন ঠিক সেইভাবেই এলো। কিন্তু ভালো খবরটা বাবার বিষণ্ণ মুখের মধ‍্যে কেমন হারিয়ে গেলো। বাবা আমাদের তিন ভাইবোনকে বললো — এবার আমাদের একটা বাড়ি করতে হবে , বুঝলি ? ছোটো হলেও নিজেদের বাড়ি , তোর মা তাহলে হয়তো সেরে উঠবে। দিদি যেন অবিকল মায়ের গলায় কথা বলে উঠলো — অত টাকা পাবে কোথায় বাবা ? আমাদের তো তেমন কোনো সঞ্চয় নেই।বাবা ম্লান হেসে বললো–সরকারি কর্মচারীর আবার সঞ্চয় ! লোন তো নিতেই হবে। লোন নিয়েই বাড়ি করবো। সবাই তো তাই করে। দাদা অনিবার্যভাবে একটা ফুট কাটলো — হ‍্যাঁ ,আমাদের তো পান্তা আনতেই নুন ফুরিয়ে যায়। এই প্রথম দাদার কথা শুনে আমরা কেউ হেসে উঠলাম না। বাবা দাদার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে যেন স্বপ্নের মধ্যে থেকে বললো– বিলু , তুই আমার সঙ্গে থাক ।অফিসের লোন আমার রিটায়ারমেন্টের আগে ঠিক শোধ করে দেবো। কিন্তু , শুধু ট্রেনিং নেওয়ার জন‍্য কল্যাণী থেকে দক্ষিণেশ্বর যাতায়াত করা দাদা কেমন মিইয়ে যাওয়া গলায় শুধু বললো– সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে , আমি নাইন-টেন- ইলেভেনের একটা ব‍্যাচকে পড়াবো , তাতে তোমার সংসারের বাজার খরচটা উঠে যাবে। দিদি আবার মায়ের গলায় বলে উঠলো– আর কোন কথা নয় বাবা , ও জমি তুমি বায়না করে দাও। মা বাড়ি ফিরলে খবরটা শুনে দারুন খুশি হবে , আর সেটা হাজার রকমের ওষুধ খাওয়ার চেয়ে অনেক ভালো হবে।
সপ্তাহে চারদিন , শংকরদার টাইপ শেখার স্কুলে গিয়ে একঘেয়ে বাক্স বাজানো শুরু করে– সেমিকোলন , এ , এস , ডি , এফ , জি , আর – ওয়ান লেজি ফক্স জাম্পড ওভার দ‍্য ……খটাখট লড়ঝড়ে টাইপরাইটারের অক্ষর আবছা হয়ে যাওয়া বোতাম বাজিয়ে বাজিয়ে , ক্লান্ত হয়ে যাওয়া , শ্রীরামপুরী তাঁতের শাড়ি পরা আমার দিদি হঠাৎ কত বড় হয়ে গেলো ! আর , ক্লাস এইটে উঠে যাওয়ার পর , জীবনের কোনো অর্থই খুঁজে না পাওয়া ভ্যাবাগঙ্গারাম এই ঝন্টু মহারাজ , যেন চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেললাম। কেননা , পড়াশুনো করে আমিও কি দাদার মতো বেকার ইঞ্জিনিয়ার হবো ?
জানতাম , মায়ের গলায় আগের মতো গানের সেই সুর আর ফিরে আসবে না ; তবু মা বাড়ি ফিরে এসে , হারমোনিয়ামটাকেই আঁকড়ে ধরলো। প্রথম গ্রীষ্মের আমেজ মেখে , আবার পথের পাঁচালী পড়তে শুরু করলো । কিন্তু দিদি , এখন বাবাকে আমরা কেমন দেখছি বলতো ? কথায় কথায় সবাইকে নিয়ে হৈ হৈ করে ওঠা , পেলে ,চার্লটন ,ববি মুর , আর ইউসোবিওর খেলা নিয়ে বিচার বিশ্লেষন করা বাবা , অথবা মাঠে নেমে হাতেকলমে ফুটবলের ইনসুইং ,আউটসুইং বুঝিয়ে দেওয়া আমাদের বাবা , কেমন যেন থমথমে নিষ্প্রাণ গলায় মাকে ডাকছে — ওগো শুনছো…
দিদি , এটা ভাবা যায় ?
আমার একদম ভালো লাগছে না । আসলে আমি নিজেই অনেকটা পাল্টে গেছি । এক বছর আগেও তো আমি পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব পড়েছি , আর এখন শুধু পড়তে ইচ্ছে করছে — সৌরীন সেনের ‘আখের স্বাদ নোনতা ‘ , ম্যাক্সিম গোর্কির ‘ মা ‘। আচ্ছা দিদি , প্রণতিদিদের সঙ্গে সঙ্গে এ পাড়া ছেড়ে মানুদি , সুপর্ণাদি , মিলুদিরাও যে চলে গেলো , পড়ার চাপে আর সংসার সামলে সে খবর কি তুই রাখিস ? সুপর্ণাদির কালো হরিণ চোখের (মা বলতো ) বোন কৃষ্ণা , যাবার আগে ওদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে বলেছিলো– ঝন্টু , তুই বড়ো হয়ে কবিতা লিখিস , কেমন ? আমি বলেছিলাম– ধুর , আমি কবিতার ক-ও জানিনা । ওসব জানে আমার দাদা। ও বললো– একদম ইয়ার্কি মারবি না। আমাকে নিয়ে , মানে , একটা কালো মেয়েকে নিয়ে কবিতা লিখিস তো ! আমি জানি তুই ঠিক পারবি । আমি ভুরু কুঁচকে বললাম — আমি জানলাম না , তুই জানলি কি করে ? কৃষ্ণা আমার গালে খোঁচা দিয়ে বললো– হয়তো আর কোনোদিনও দেখা হবে না , কিন্তু ,আমি বেঁচে থাকবো , তুইও বেঁচে থাকবি একটা নতুন সুন্দর পৃথিবীতে । তোর হাত দিয়ে আমার মতো কালো মেয়ের জন্যে একটা কবিতা বেরোবে –আমি ঠিক জানি । দিদি , জানিস তো , ওর কথা শুনে একই সঙ্গে আমার চোখে জল , আর , সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। দিদি তোকে বলতে দ্বিধা নেই , প্রথমটা বন্ধু হারানোর শোকে , আর দ্বিতীয়টা …. যাঃ ! ও আমি বলতে পারবো না।না , কিছুতেই না।
এরই মধ্যে আরেকটা ঘটনাও ঘটেছে , তোকে আমি বলিনি। মামার বাড়ি থেকে প্রায় কম্যুনিষ্ট হয়ে ফেরার পরে , আবার সেই ফুটবল মাঠের দামাল ছেলে হয়ে গেলাম তো আমি ; মনের মধ্যে কিন্তু — জাগো জাগো জাগো সর্বহারা …..গানটা থেকেই গেলো। একদিন আমরা বড়োদের ডিউজ বল আর ব্যাট নিয়ে মাঠে খেলছিলাম । ছোটো মাঠে প্র‍্যাকটিস যাকে বলে আর কি ! খালি পায়ে প‍্যাড পরে , ব‍্যাট হাতে নিজেকে সেলিম দুরানী মনে হচ্ছিলো ! কিন্তু , দীপকদার ব্যাটের একটা জোরালো শর্টের পর , বলটা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে , মাঠের বাইরে এক দঙ্গল আমার বয়সী মেয়েদের মাঝখান থেকে , একটা মেয়ের মাথার পিছন দিকে আঘাত করলো। ও চমকে উঠে , মাথায় হাত দিয়ে পিছনে তাকাতেই , আমি অবাক হয়ে দেখলাম — তোর বন্ধু সৌমীদির ছোটো বোন মৌসুমী ! ও এত বড়ো হয়ে গেল কবে ? হঠাৎ মৌসুমী মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলো । বুঝতে পারলাম , অত শক্ত ডিউজ বলটা যত আস্তেই লাগুক না কেন , মাথার পিছনে ভালোরকম চোট লেগেছে । ওদের বাড়ির লোকজন এত ভদ্র , আমাদের বকাবকি না করে , সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলো । আমি শুনলাম — মাথায় চোট লেগে যদি বমি হয় , সেটা নাকি সাংঘাতিক। মৌসুমী সুস্থ হয়ে ফিরে এলেও , সেই মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে , মাথার পিছনে হাত দিয়ে , স্টেপ কাট চুল সরিয়ে ওর অপ্রস্তুত হাসি মুখটা , আমার বুকের মধ্যে যেন ছবি হয়ে থেকে গেলো রে দিদি। হাসপাতাল থেকে তিন দিন পর যখন ও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলো , সেদিন পাড়ার কোথাও মাইক্রোফোনে গীতা দত্তের গান বাজছিলো— কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার…..
আমি জানি এটা উত্তম সুচিত্রার হারানো সুর সিনেমার গান । সবার প্রিয় গান । আমরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওদের বাড়ির সামনে । মৌসুমীর কাকা , মানে আমাদের মানস কাকু উৎসাহ দিয়ে বললো — তোরা একদম মন খারাপ করবি না । শো মাস্ট গো অন । খেলা কিন্তু চলবে । আমার মনে হলো , বাবার ভেঙে যাওয়া মুখটার পাশে ,বাবার চেয়ে অন্তত দশ বছরের ছোটো মানসকাকুর মুখটা যেন সূর্যের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বুকের মধ্যে বাজতে থাকলো তাঁর কন্ঠস্বর– শো মাস্ট গো অন। খেলা বন্ধ রাখলে চলবে না। তোমরা কেউ মন খারাপ করে থেকো না।
তোকে চুপিচুপি একটা কথা বলি দিদি , আমি কিন্তু ষোলো বছরে পা দিলে, মৌসুমীকে একটা হাতচিঠি দেবো চন্দনের বোন মহানন্দাকে দিয়ে। এই ঘটনার উল্লেখ থাকবে সেখানে ।
আমাদের তো অনেক কিছুই দেখা হলো না, তাই না ? তুই আমি এই বয়সে এখনো সাগর দেখিনি, পাহাড় দেখিনি। মা’ও দেখেনি। তুই তো তবু মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গেছিস স্কুল থেকে । আমার তো তাও হলো না। আর , অসুস্থ মাকে সুস্থ না করে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না । ঈশ , বাবা যদি রেলে চাকরি করতো , কী ভালোই হতো — তাই না রে দিদি ? নলিনী কাকুরা প্রতিবছর কত জায়গা বেড়াতে যায় ! শুনলাম, টালিগঞ্জ গিয়ে প্রণতিদির বিয়ে হবে ? তুই আমাকে বলেছিলি — প্রণতিদির নাকি খুব ঘটা করে বিয়ে হবে । প্রণতিদি হায়ার সেকেন্ডারির পরে আর পড়াশুনো করবে না – ঠিক করে ফেলেছে। পাত্রপক্ষ একটা বিয়েবাড়িতে ওকে দেখে…
আচ্ছা দিদি , তুই তো প্রেম করে বিয়ে করবি না ঠিক করেছিস ; কিন্তু , তোর বিয়ের সম্বন্ধ যদি ঠিক হয় , তাহলে এই পাড়ায় আমাদের ফ‍্যামিলি সম্পর্কে খোঁজ করতে এলেই তো…..
না না , প্লিজ আমায় বলতে দে। আমি যথেষ্ট বড়ো হয়ে গেছি ,আর বড়ো হওয়ার অনেকগুলো লক্ষণও আমি টের পাচ্ছি । তোরা পাচ্ছিস কিনা জানি না , কিন্তু আমি এইটুকু বেশ বুঝতে পারছি — পাত্রপক্ষ থেকে এখনও পাড়াতে এসে বিয়ের পাত্রী সম্পর্কে হাজার রকমের খোঁজখবর নেয়। যেমন , আমার বাবা হয়তো তোর হবু বরের অফিসে গিয়ে , বরের মাইনেপত্তর নিয়ে খোঁজ নেবে। এ পাড়ায় পাত্রপক্ষের কেউ এসে যদি আমাদের বাড়ি সম্পর্কে অন‍্য কাউকে জিজ্ঞাসা করে , সঙ্গে সঙ্গে তোর বিয়ে ভেঙে যাবে । কেননা , আমাদের বাড়িটাকে তো লোকে পাগলের বাড়ি বলে। মন খারাপ করিস না দিদি। আমাদের এইভাবেই বেঁচে থাকতে হবে । একদিন হয়তো এই রোগটা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যাবে । ক্যান্সার থেকে বাঁচবার ওষুধ আবিষ্কার হবে । আমাদের স্কুলের স‍্যাররা বলেন — বিজ্ঞানীদের সাধনা কখনো বিফল হয় না। আমার যেন মনে হয় , নিউটন , আইনস্টাইন , জগদীশ বসু , সত্যেন বসুরা আজও স্বর্গের কোনো পরীক্ষাগারে বসে নতুন নতুন সৃষ্টি করে চলেছেন , আর সেগুলো পুষ্পবৃষ্টির মতো আমাদের মাথায় উপর ঝরে পড়বে। সেদিন আর আমাদের বাড়ির মতো হতভাগ্য পরিবারগুলোকে কেউ পাগলের বাড়ি বলবে না। মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হবে না।
আচ্ছা , তুই আমি শুধুমাত্র না পাওয়াগুলো নিয়েই আলোচনা করছি কেন ? এই যে তুই আমার হাত ধরে সেদিনকে হাতিবাগানে রাধা সিনেমা হলে ‘ জিপসিক‍্যাম্প ভ‍্যানিসেস ইন টু দ‍্য ব্লু ‘ দেখিয়ে আনলি ! মালঞ্চ-তে কষা মাংস আর মোগলাই খাওয়ালি। বাবা দেখালো — ওয়ান মিলিয়ন ইয়ার্স বি সি । তোর মনে আছে ? আমার পাঁচ বছর বয়সে , ইডেনের পাশে পুরনো ইনডোর স্টেডিয়ামে , আমেরিকা থেকে পাঠানো সেই আশ্চর্য সিনেমা শো’টা দেখলাম যে ? কী যেন নাম… ও হো , মনে পড়েছে–‘সারকারামা’…..আমাদের চারদিক ঘিরে গোল করে বারোটা স্ক্রীন ….কখনো জাহাজ যাচ্ছে ,তখন আমরা দুলছি । আবার যখন প্লেনের ককপিটে বসে রয়েছি , মনে হচ্ছে পাইলট আমার নিজের দাদা । কী অদ্ভুত একটা পরিস্থিতি ! আমার সবথেকে ভালো লাগছিলো জাহাজের দুলুনি । আচ্ছা কী করে করছিল রে দিদি এইসব ?
তাছাড়া , আমরা যে দেখেছি , জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি , মার্বেল প‍্যালেস , ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল , আর কী আশ্চর্য আশ্চর্য বিড়লা প্লানেটরিয়াম ! যার ছাদটা মুহূর্তের মধ্যে মহাকাশ হয়ে যাচ্ছে , আর আমরা এক ঘন্টা ধরে ভেসে যাচ্ছি নীহারিকা থেকে নীহারিকায় ! তোর মনে আছে , বাংলায় কমেন্ট্রির শো’র শেষে সেই আশ্চর্য কথাটা — কলকাতার আকাশে এখন ভোর হচ্ছে… কলকাতার কাট আউটগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে ! তার সঙ্গে শিল্পী উৎপলা সেনের গলায়… শুকতারা গো নিও না বিদায় , এখনও ঝরেনি শেফালী….
দিদি , উদয়শংকরের সেই আশ্চর্য সৃষ্টি ‘শংকরস্কোপ’ ! তুই , আমি , মণিমামা একসাথে মহাজাতি সদনে দেখলাম যে ! এই তো সেদিনের কথা ! যেখানে সিনেমার পর্দা থেকে মুহূর্তে বাস্তবের স্টেজে নামছে নায়ক নায়িকা , আবার মই দিয়ে উঠে সিনেমার পর্দার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। আচ্ছা , এগুলোই বা কম কিসের ? নাইবা গেলাম দার্জিলিং , নাইবা হলো পুরী ? আর , আমাদের বাড়ির বইগুলো ? যেগুলো জড়িয়ে ধরলেই , বুকের মধ্যে আটশো পায়রা একসাথে উড়ে যায় ! দিদি দেখিস , তোর একটা স্বপ্ন আমি একদিন সফল করবোই ।
তুই হয়তো ভুলে গেছিস , কিন্তু তোর এই হাঁদারাম ছোট ভাইটা ভোলেনি , কোনদিনও ভুলবে না । কেননা , তার কাছে তুইতো শুধু দিদিই না , মা-ও তো বটে ! মায়ের কথা কেউ ফেলতে পারে না রে । আমাদের যশোরের বাড়িতে একবার সবাইকে নিয়ে দুর্গাপুজো করবো। অমন করে তাকাচ্ছিস কেন রে ? আমার সব মনে আছে , যা বলেছিস । একদিন সীমান্তের বেড়া পেরিয়ে , ফেলে আসা সব কিছু হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকবে । কোনো মন্ত্রবলে আবার বেঁচে উঠবে দাদু , ঠাকুমা। এই নিয়ে লেখা দাদার একটা সুন্দর কবিতার চারটে লাইন কী আশ্চর্যভাবে তোকে এই ভাবনা ভাবতে বাধ্য করেছে , তাই না ? দাদার সেই কবিতার খাতাটা আমার কাছে আছে । কিন্তু দাদা তো এখন জীবনযুদ্ধে লড়াকু সৈনিক । তার ছোট ভাই যে , তার সব সৃষ্টিকে বুকের মধ্যে গুছিয়ে রেখেছে , তা সে জানেও না হয়তো। লাইনগুলো বলি একবার–
তোমরা শুনছো , তবু একবার চলো
বাড়িটার কাছে ,
সাত পুরুষের সব ভালোবাসা ফুটে আছে
গাছে গাছে ;
তাদের কাছেই দুচোখ ভাসাবো
প্রিয় সুজনের নামে ,
তারা বেঁচে আছে বুকের মধ‍্যে ,
ছায়া নির্জন গ্রামে।
দিদি দেখিস , একদিন মধ্যমগ্রামের নিতুদা ,সুজয়দা ,দুর্জয়দা , সঞ্জয় , শান্তাদি , কণিদি… হালিশহরের মন্টুদা ,
খুকিদি , বুলিদি … ঢাকুরিয়ার মেজদা , দেবীদা , ছবিদা আর খড়্গপুরের খোকনদা, শুকলাল , দেবীদি…
পার্ক সার্কাসের ছোটোকাকু ,কাকীমা , রাজা , টুকটুকি , ছোটকা , আর আমরা তিন ভাই বোন, বাবা মা ,বনগাঁর পিসিমার বাড়ির সবাই হৈ হৈ করতে করতে , মহালয়ার দিন হাজির হবো যশোরের বাড়ির উঠোনে ! আমাদের রাশভারী ঠাকুরদা , আর সবসময় কথায় কথায় হেসে ফেলা ঠাকুমা , বি সরকার মেমোরিয়াল থিয়েটার হল পর্যন্ত এগিয়ে এসে আমাদের বরণ করবে , যে হলে অভিনয় করতে আসতেন শিশির ভাদুড়ীর মতো অভিনেতা।
যশোরের বাড়িতে দুর্গাপুজো হবে। সে কী সাজো সাজো রব ! একদিন সন্ধেবেলা আমরা সব ভাই বোন মিলে যশোরের রেল বাজারের পুরনো স্টুডিওতে গিয়ে, গ্রুপ ছবি তুলবো । যে ছবি আমাদের প্রত্যেক ভাই বোনের কাছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকবে । আর মহানবমীর রাতে , যখন গর্জনতেল মাখা দুর্গা প্রতিমার দুচোখে চিকচিক করবে দুফোঁটা জল…ঢাকের আওয়াজ , ধুনুচি নাচের মধ্যেও বিজয়ার সুরটুকু বেজে উঠবে , তখন যশোর শহর থেকে অনেক দূরে , হ্যাঁ , বাবাদের যে গ্রামের বাড়ি ; মানে , আমাদের দেশের- দেশের বাড়ি — সেই জঙ্গলবাদাল গ্রামে , বোধহয় কপোতাক্ষ নদীর তীরেই হবে ; সেই ঢাকের আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে । আমি নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি , এই ঘটনাগুলো একদিন ফুল হয়ে ফুটবে ! দিদি , তুই আমি দাদা কিছুতেই পাগলা গারদে যাবো না , তুই দেখে নিস। আমাদের জীবনটাকে ভেঙে চুরমার করবে , এমন কোনো শক্তি নেই। বুঝতে পারছিস দিদি ,
আমি যে বড় হয়ে যাচ্ছি !
আমি অনেক কিছু বলতে পারছিনা । মাকে বলা যায়না , বাবাকে বলা যায়না , এমনকি তোকেও বলা যায়না । তাহলে আমি কাকে বলবো ? অথচ , ফুটবল খেলার মাঠে যাওয়ার সময় যখন দেখি — এ পাড়ার সুস্মিতার সঙ্গে গল্প করছে , আমাদের ক্লাসের সেকেন্ড বয় গৌতম , হাতে হয়তো একটা অঙ্কের বই — আমি , শ্যামল , বংশী, কানু খুব ভালো করেই জানি , হাতে বই রাখাটা একটা ছুতো। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা গল্প করে। আমি জানি — সুস্মিতারও ভালো লাগে , গৌতমেরও ভালো লাগে। কিন্তু , আমার ভালো লাগেনা । ফুটবল মাঠটাকে তখন দুর্বিষহ মনে হয় আমার । মনে হয় গৌতমকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে , আমি সুস্মিতার সঙ্গে গল্প করি। মাঠ থেকে ফেরার সময়ও দেখি ওরা গল্প করছে । সুস্মিতার মা কিছু দেখেও দেখে না মনে হয়। কানু , বংশীদের মনে কী হয় জানিনা , কিন্তু আমার বুক হিংসায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় । আচ্ছা দিদি , এই মারাত্মক সময়টা আমি কী করে পার হবো বলতো ? তুই কি লক্ষ করেছিস ,আমার গলা ভেঙে যাচ্ছে ?
পরের দিন স্কুলে গিয়ে কিন্তু আমি গৌতমকে এসব কথা বলতেও পারিনা । কেননা , দাদার তো সময় নেই , গৌতম আমাকে জটিল অঙ্কগুলো বুঝিয়ে দেয় । ওর মতো সুন্দর দেখতে ছেলেকে তো সুস্মিতা ভালোবাসবেই । আর , আমার ……না থাক, ফাঁকা দাঁতের গল্প আর বলবো না । তোর আমার দাদার কিসের দুঃখ বলতো ? আমরা তো বড় হয়ে গেছি । এবার বাবা-মাকে তো আমরাই….
বাবার গলায় আবার সেই মধুর ডাক মাকে লক্ষ করে– ওগো শুনছো… ফিরিয়ে আনবোই ।আমরা তিন ভাইবোন এই অসুখটাকে , মারাত্মক মানসিক রোগটাকে , মাটির নিচে সাত হাত গর্ত খুঁড়ে পুঁতে দেবো। উপরে পাথর চাপা দিয়ে দেবো, যাতে কোনদিনও গাছ হয়ে বাড়তে না পারে ।কোনো পরিবারকে যেন এই মারাত্মক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে না হয়। দিদি চুপ কর । একদম চুপ …..চোখের জল মোছ। এই দিদি , কান পেতে শোন তো….
মা গুণগুণ করে কী যেন গাইছে। আমাদের সংগীতশিল্পী মা আবার গান ধরেছে ? আমাদের জীবনের ভালোর দিকটা , আলোর দিকটাকে সবসময় উপরের দিকে তুলে ধরা মা , আবার গান ধরেছে ! কোনদিনও পাহাড় , সমুদ্র দেখতে না পাওয়া আমাদের মা , স্মৃতিকণা বসু আবার গুণগুণ করে গাইছে —ওরে নীল যমুনার জল… দিদি কান পেতে শোন– মার সামনে যাবো না এখন । সমস্ত মনপ্রাণ এক করে শোন , মা গাইছে– ওরে নীল যমুনার জল , বল রে মোরে বল , কোথায় ঘনশ্যাম , আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম ..
ওরে নীল যমুনার জল….

( এখানেই আমার কথাটি ফুরোলো )
না না , কে বললো এই উপন্যাস শেষ হলো ? নদী আর জীবনের স্রোত কখনও থেমে যায় ?
আরও দু একটা কথা বলা বাকি আছে। এই উপন্যাসের কোনো চরিত্রই কাল্পনিক নয়। বিশ্বাস করুন , সবটাই সত্যি । সূর্যের আলোর মতো ,আর রাতের জোছনার মতো সত্যি। কোজাগরীর চাঁদের মতো সত্যি , অমাবস্যার ঘুটঘুটে আঁধারের মতো সত্যি। বৃষ্টির মতো সত্যি ,পাকা আমের গন্ধের মতো সত‍্যি।
এই উপন্যাস লিখতে আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন ও অকুন্ঠ সহযোগিতা করেছেন আরণ‍্যকের কবিতা বন্ধু গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয়া শিক্ষিকা অনিন্দিতা শাসমল । প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমার ডিকটেশন শুনে তিনি নিঁখুতভাবে বুনে তুলেছেন এই উপন‍্যাসের প্রতিটি লাইন। তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। উৎসাহ দিয়েছেন আমার মাতৃসমা সাহিত‍্যিকা মালবিকা চট্টোপাধ্যায়। যেমন আমার প্রিয় জামাইবাবু ও অভিভাবক জয়দার কথা না বললেই নয় । আমার বন্ধু , সংগীতশিল্পী সঞ্চারীর কথাও বলতেই হবে। তাঁরা এবং আরও অনেকে আমার কাছে বারবার জানতে চেয়েছেন — উপন্যাসের বারোতম ,চোদ্দোতম , পনেরোতম , আঠারোতম,বাইশতম পর্বগুলো আমাকে পাঠিয়ে ছিলে ? আরেকবার পাঠিয়ে দাও তো ! প্রতিটি পর্বে অসাধারণ মন্তব্য লিখে আমাকে সমৃদ্ধ করেছেন প্রিয় বন্ধু সৈয়দ হাসনে আরা, ঈশানী রায়চৌধুরী ,কণিষ্ক শাসমল ,সাংবাদিক কাজল গুপ্ত এবং আরও অনেক প্রিয় বন্ধু …..
এইসব দিনরাত্রি ও নিঃশব্দ ভালোবাসাগুলোকে সম্বল করেই আমি জীবনের পরিণত বয়সে এসে , এই উপন্যাসে লিখতে পারলাম । আমি আমার চিরদিনের দিদিকে এই উপন‍্যাসের শুরু মধ্য শেষ — সবটুকু উপহার দিলাম।
আমার দিদির শরীর এখন ভালো নয় । জামাইবাবু প্রতিটি পর্ব তাঁকে পড়ে শোনান। মা বাবা দাদা সেই কবে চলে গেছে। মামার বাড়িও ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
তবু , আমার এমন সম্পর্কগুলো আজও বুকের মধ্যে শেকড়বাকড় সমেত রয়েছে বলেই , উপন্যাসটা শেষ করতে পারলাম। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি ইংরিজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা ও টেক-টাচ-টক-এর শনিবারের সম্পাদিকা শ্রীতন্বী চক্রবর্তীর প্রতি।
তাঁকে শেষহীন ভালোবাসা জানাচ্ছি। তাঁর উৎসাহ এবং সম্মতি ছাড়া এই উপন্যাস প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। আর আপনারা , অগণিত পাঠক-পাঠিকা , চেয়ে দেখুন….
আমি আপনাদের সামনে নতজানু হয়ে বসে আছি।
আরণ্যক বসু জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এইভাবেই নতজানু হয়ে থাকবে তার প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে , কবিতা বন্ধুদের কাছে ।
সবাই সপরিবারে খুউব ভালো থাকবেন‌।

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।