আবার যেন কাব্যে কথায় উথলে ওঠে বুক
আবার যেন বাংলাভাষা চলকে ওঠে গানে
আবার যেন চিঠির পাতায় মনের কথা ভাসে
আবার যেন ঝিকিয়ে ওঠে
সহজ কথার মানে।
স্নেহের ঝন্টু,
তোর শরীর ভালোই আছে বাবার কাছে জানলাম।শুধু মন যে একটুও ভালো নেই,তা তোর সুন্দর চিঠি পড়েই বুঝতে পারলাম।মা তো তবু মামাদের ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু, বাবার বড়ো অযত্ন হচ্ছে রে। ভাগ্যিস মা আমাকে টুকটাক কিছু রান্নাবান্না, ঘরের কাজ শিখিয়েছিল। ভাগ্যিস কাজের দিদি মঙ্গলাদি বিকেলের রুটি তরকারিটা করে দিচ্ছে। আর ,দাদা তো শনিবার এসে আর কোনো কথাই বলতে চায় না। শুধু সিঁড়ির ঘরে পড়তে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। শুনলাম এর মধ্যে দাদা নাকি , একদিন দুপুর বেলা শিবপুর বি ই কলেজ থেকে রাইটার্সে বাবার কাছে এসে , কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।ওর নাকি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভালো লাগছে না ।প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স নিয়ে পড়তে চায় । ঝন্টু , তুই ভাব একবার — একে তো বাবা মায়ের চিন্তাতে পাগল হয়ে যাচ্ছে , তার উপরে দাদার হঠাৎ এই মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গী হতে হচ্ছে সেই বাবাকেই। এমনিতেই আমাদের দাদা তো একটু ছেলেমানুষ গোছের ; তোর আমার মতো বুঝদার নয় । তার ওপরে মার অসুখ ওকে সাংঘাতিক বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। বাবার অফিসের কাকুরা সবাই মিলে দাদাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করিয়ে আবার হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। বাবার বন্ধু দিলীপ কাকু শিবপুরেই থাকেন। শুনলাম ট্যাক্সি করে দাদাকে হোস্টেলে দিয়ে এসেছেন। সবাই যদি এরকম বুঝদার হতো , তাহলে দুনিয়াটাই হয়তো পাল্টে যেতো। কিন্তু তা হয়না রে ঝন্টু।
পাড়ায় আমাদের মায়ের কাছে যারা কত কত গান তুলে নিয়ে যেতো,তাদের মুখে ত্যাড়া ব্যাঁকা কথা শুনলে পাগল পাগল লাগে। বাবাকে তো সেদিন খাবার সময় বলেই ফেললাম — বাবা চলো , ডানকুনির দিকে জমি খুব সস্তা। তোমারও ডানকুনি লোকালে শিয়ালদা যেতে সুবিধে হবে। শুনে বাবা কেমন ম্লান হাসলো।বললো — এখানে তো তবু আমাদের সবাই চেনে। যে যাই বলুক , বিপদের দিনে ঠিক দৌড়ে আসবে। আর ওখানে….
বাবাকে নিয়ে বড্ডো মুশকিলে পড়েছি রে ঝন্টু। আগের মতো, মায়ের হাতের তিন চার পদ রান্না খেয়ে , টিফিন গুছিয়ে নিয়ে ,ওগো শুনছো… বলে অফিস যাওয়া তো বন্ধ হয়ে গেছে। আমার আধপাকা হাতের রান্না তার পছন্দ হবে কেন ?
বাবার মুখে কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই। মেয়েকে দিয়ে রান্না করাতে হচ্ছে বলে সবসময় লজ্জায় কুঁকড়ে রয়েছে যেন। আরে বাবা , আমি কি আর এখন মেয়ে আছি ?
পাকা গিন্নি হয়ে গেছি।ভাগ্যিস ডিমের ডালনা , আলুর দম ,ডাল , আলুভাজা ,আরেকটা পাঁচমেশালি তরকারি আমি রাঁধতে শিখে গিয়েছিলাম ; তাই দিয়ে মোটামুটি চলে যাচ্ছে । ওই যাকে বলে থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় । আর , আমি কত কিছু বুঝতে শিখে গেছি রে ঝন্টু । আগে এগুলো লক্ষ্যই করতাম না, যে , মঙ্গলাদি আমাদের এই অবস্থার সুযোগটা পুরোপুরি নিচ্ছে। নারকেল তেলের শিশি উজাড় করে মাথায় মেখে নিচ্ছে । প্রায়ই এক কাঁসি চাল সবার সামনে দিয়েই আঁচলে বেঁধে নিচ্ছে। যেন এটা তার প্রাপ্য । ওদিকে প্রতি সপ্তাহেই বাবা বাজার থেকে নানারকম তরিতরকারি মঙ্গলাদির জন্য নিয়ে আসছে । কিন্তু তাতে মঙ্গলাদি সন্তুষ্ট নয়। বাবা বলেছে — একদম চুপ করে থাকবি । কিচ্ছু বলতে যাবি না । জানবি এটাই আমাদের ভবিতব্য। বিপদের সময় সব সময় কম কথা বলবি । তোর তো আবার দিনে লাখ কথা বলা স্বভাব । এত বিপদের মধ্যেও বাবার কিন্তু রসিকতাবোধ ফুরোয়নি ।
হঠাৎ আজ অফিস থেকে এসে তাড়াতাড়ি বলে উঠল — শিখা তোর মায়ের একটা ব্যাগ গুছিয়ে দে তো , মোটামুটি সব কিছু দিয়ে। পেস্ট ,সাবান ,ব্রাশ মনে করে দিস । মনে হচ্ছে সোম অথবা মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি করতে পারবো। আমি বললাম — মা ভালো হবে তো বাবা ? বাবা বলল — খুব বড়ো হাসপাতাল । সেই জন্যই তো কষ্ট করে একটা সিট জোগাড় করেছি । এবার দেখি কি হয়। আসলে রোগটা তো বংশগত । আমি না বুঝেই বললাম, তাহলে কি আমি ,ঝন্টু , দাদা সবাই মার মতো…….
মুখে হাত চাপা দিয়ে বাবা বলল — চুপ , এইসব নিয়ে কখনো ভাববি না , আর মনের মধ্যে কোন দুঃখ গুমরে গুমরে পুষে রাখিস না । যা বলার সবার সামনে বলবি।আমাদের কাছে না হলেও , বন্ধুদের কাছে বলবি । ওহ , বন্ধু বলতে মনে পড়ে গেল — পাড়ার বন্ধুরা কিন্তু নিয়মিত এসে তোর খোঁজ নিয়ে যায়।আর খালি জিজ্ঞেস করে– ঝন্টু কবে আসবে শিখাদি ? মাসিমা একটু ভালো হয়ে উঠেছেন তো ? তোর স্কুলের হেডমাস্টারমশাই একদিন বাবার সঙ্গে সন্ধেবেলা দেখা করতে এসেছিলেন।কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়েছেন আমাদের বড়দি । প্রতিদিন সাড়ে দশটায় দরজায় তালা দিয়ে যখন আমি স্কুলে যাই , প্রেয়ারের শেষে বড়দি আমায় ডেকে পাঠান তাঁর ঘরে। প্রায় প্রতিদিন মা’র খবর জিজ্ঞাসা করেন। আমাকে বলেছেন , স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে শ্যামা নৃত্যনাট্য হবে, এবারে আমাকে শ্যামা হতে হবে , এবং তার আগে মা যেন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। এখনো তিন মাস বাকি । আসলে বড়দি এতটা ভালোমানুষ যে , আমাকে মায়ের অভাবটা বুঝতে দেননা। বড়দি বাবাকে চিঠি লিখে বলে দিয়েছেন — শৃঙ্খলা যেন কোন কারণে উনুনে আঁচ ধরাতে না যায়,কারণ হঠাৎ কোন বিপদ ঘটে যেতে পারে।বাবা পরদিনই নতুন জনতা স্টোভ আর দশ লিটার কেরোসিন তেল এনে আমাকে সবকিছু শিখিয়ে দিয়েছে। জনতা স্টোভে রান্না করা খুব সহজ , জানিস তো ঝন্টু। সব মিলিয়ে আমি খারাপ নেই রে। শুধু লেখাপড়াটাতে আমি তো দাদার মতো নই , তাই আমাকে প্রচুর খাটতে হচ্ছে। তোর কোনো ভয় নেই । দুশ্চিন্তা করিস না। হেডমাস্টারমশাই বলেছেন — তোকে কতগুলো মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে নতুন ক্লাসে তুলে দেবেন । কিন্তু আমি তো আমার ভাইটাকে জানি । সে পরীক্ষা না দিয়ে নতুন ক্লাসে যেতে চাইবে না। সে এমন একজন ফুটবল খেলোয়াড় , যে মাঠে নেমে যুদ্ধ করতে ভালোবাসে । সে কখনও ফাঁকি দিয়ে বাজিমাত করতে চায় না। তাই না রে ভাই?
শোন , আজ থেকে জানবি আমি তোর দিদিই নই শুধু ; মা’র পাশাপাশি আমিও তোর মা । খুব সাবধানে থাকবি। পারলে মণিমামার কাছে গানের তালিম নিতে একটু বসিস। তুইতো সরগমটা পুরো ভুলে মেরেছিস মনে হয় । জানিস তো ঝন্টু, মায়ের তানপুরাটায় ধুলো জমতে জমতে ……দু দুটো তার কবে যেন ছিঁড়ে গেছে ।
আর পারছি না রে লিখতে। আমাদের বাড়ি থেকে মায়ের সেই মা মা গন্ধটা যেন অনেকটাই মুছে গেছে এখন। এবারে শেষ করি ,কেমন ? মায়ের জন্য ব্যাগ গোছাতে গোছাতে নাক ডুবিয়ে দেখবো , কোন শাড়িতে মায়ের গন্ধটা সবচেয়ে বেশি লেগে আছে !
ভালো থাকিস। আমি সবসময় তোর কথা ভাবি । আমাদের খারাপ হবে না , কারণ আমরা তো কারোর খারাপ করিনি । আমাদের মা তো সবাইকে গান শিখিয়েছে। মিস্টি হেসে সবাইকে আপন করে গেয়ে উঠেছে–সবারে বাস রে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে… আছে তোর যাহা ভালো ফুলের মতো দে সবারে… নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে….
হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে, হারানো গানগুলো মা যেন আবার ফিরে পায়….. ভগবানের কাছে প্রতিদিন এটাই প্রার্থনা কর ঝন্টুসোনা।