• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ১৭)

রূপকথা পৃথিবীর

ঢেউ ভেঙে একা বাড়িতে ফিরছে
গোধূলির শেষ আলো ,
ঘুমোবার আগে কচিপাতা বলে —
সব্বাই থাকো ভালো।
শনিবার হলেও স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে গেল। বাড়িতে পা রাখতেই দেখি, দাদা এসে গেছে । একি , বাবা এখনও ফেরেনি ? কী করে ফিরবে — দিদির উত্তর । শ্মশানের সব কাজ শেষ হবে , তারপরে তো ফেরা ! আমরা তিন ভাইবোন অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম । দিদি চা বানিয়েছে আর আমি জলপাইয়ের তেল দিয়ে মুড়ি মেখেছি। দাদার হাতে একটা কাগজ । বাড়িতে এসে মা’র অভাবের পাশাপাশি , আদরের মাসতুতো ভাইটা চিরজীবনের মতো চলে গেল —- আমার ভীষণ চুপচাপ দাদা যেন আরও পাথরের মত হয়ে গেছে ।
মায়ের অসুখটা আমাদের সয়ে গেছে , কিন্তু ভাই হারানোর দুঃখটা আমরা কিছুতেই ভুলতে পারছি না । বাবা কতক্ষণে ফিরবে কে জানে ? নিশ্চয়ই রাত হবে । আমার খুব কৌতুহল হচ্ছে , দাদার হাতের কাগজে কিছু একটা লেখা রয়েছে। নিশ্চয়ই নতুন কবিতা আর , সেটা যে মাকে ভেবেই লেখা– আমি নিশ্চিত জানি । যেমন জানি বাবা আর মা দাদাকে একটু বেশি ভালোবাসে। বড় ছেলে বলে কথা ! তার ওপরে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব হবে । বাব্বা ! হ‍্যাট কোট পরা ইঞ্জিনিয়ার ! আমাদের বাড়িতে আর কোনো দুঃখ থাকবে না। আমাকে অনেক ফুটবল , জার্সি , বুট আর , খেলার সরঞ্জাম কিনে দেবে ঠিক — আমি জানি । দাদার কাছে হাত পাতলেই , দাদা এ পাড়ার বিনুদাদের বাড়ির পেয়ারা গাছের মতোই কল্পতরু হয়ে যায় । কি আশ্চর্য সে পেয়ারা গাছ ! আমরা সব পেয়ারা পেড়ে নিলেও , সাত দিনের মধ্যে আবার গাছভর্তি পেয়ারা আমাদের ডাকে — আয় , আমাদের নিয়ে যা…. পেড়ে নিয়ে যা ।
দিদি আমার দিকে চায়ের কাপ আর মুড়ির বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল — হ‍্যাঁ রে ঝন্টু , তোর স্কুলের খবর বল ! আমি বলবো কি ? বলতে গিয়েই তো ভ‍্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম আবেগে। আমাদের হেডমাস্টারমশাই দুলাল বাবু আমাকে পাশে বসিয়ে মা’র সম্পর্কে সমস্ত খবরাখবর নিলেন।
আমি ইচ্ছে করেই সমুর মৃত্যুর কথাটা চেপে গেলাম। ওটা আমার নিজের দুঃখ। সকলকে বলার নয় । শুধু পাড়ার বংশী ,কানু ,দেবু, চন্দন জানবে ,আর কেউ নয়। আর জানবে আমার কেটে যাওয়া নীল ঘুড়িটা…ও ভাসতে ভাসতে, মেঘের উপর দিয়ে শেষ বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার প্রথম তারা হয়ে যাবে। ওই তারাটাই সমু। আমার ঘুড়ি ,আমার লাটাই , আমার সমস্ত না পাওয়ার দুঃখ-বেদনা।
হেডস্যার আমাকে ক্লাসে নিয়ে যেতেই একসঙ্গে পঁয়তাল্লিশ জন বন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলো । স্যার আমাকে ক্লাস টিচারের কাছে এগিয়ে দিয়ে বললেন — রথীনবাবু , নিন। আপনার প্রিয় ছাত্রকে ফিরিয়ে এনেছি। এখন কয়েকদিন ও স্কুল করবে। ওর মা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলে ,ও আবার বাড়িতে ফিরে এসে নিয়মিত ক্লাস করতে পারবে । কি , তোমরা তোমাদের বন্ধুকে হেল্প করবে তো ? ও অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে । সবাই একসঙ্গে হ‍্যাঁ বলেই চুপ । কিন্তু দারুণ সাহসী দামাল বন্ধু তরুণ ভট্টাচার্য এক আশ্চর্য সাহস সঞ্চয় করে হেডস্যারকে বললো — স্যার , আপনি কিছু ভাববেন না । হয়তো আজকের মধ্যেই সমস্ত সাবজেক্টগুলো ও খাতায় লিখে নেবে ; তারপরে তিনদিনের মধ্যেই আমাদের কাছাকাছি চলে আসবে । রথীনবাবু হেসে বললেন , হ্যাঁ তোমাদের ঝন্টু মহারাজ খুব ওস্তাদ। আজ তো হাফ ছুটি , তোমরা একটু ফুটবল খেলার মাঠেও ওকে নিয়ে যেও । কলকাতায় খেলার মাঠ নেই । বেচারা কতদিন খেলেনি কে জানে !
এই পর্যন্ত শুনে দাদা বললো — এই হচ্ছে আমাদের স্কুল । আমি জানতাম , হেডস্যার ওকে আদর করে ক্লাসে নিয়ে যাবে । আরে , আমি তো আছি । সোমবার আমার ছুটি ,কলেজের জন্মদিন । বললো , তোকে দুদিনের মধ‍্যেই আমি অনেকটা পড়িয়ে দেবো । আমি দিদি আর দাদাকে পেয়ে মনের দুঃখের দরজাটা খুলেই দিলাম । বললাম — দিদি, জানিস তো , খেলার মাঠে গিয়ে ক্লাসের অরুণ এমন একটা কথা আমাকে বললো …শুনে আমার ভীষণ কষ্ট হলো। বললো — কলকাতায় গিয়ে তোর দাঁতগুলো আরও ফাঁক ফাঁক হয়ে গেছে। আচ্ছা , আমি তো ইচ্ছে করে আমার দাঁত ফাঁক করিনি ! দাদা , দিদি তোরা বাবাকে একটু বোঝাবি ? শিয়ালদায় যে ডেন্টাল হসপিটাল আছে , সেখানে কি আমার দাঁতগুলো ঠিক করে দেওয়া যাবে ? দাদা বললো— বোকা ছেলে,
এর জন্য কেউ দুঃখ পায় ? তোকে পড়াশোনায় , খেলাধুলোয় হারাতে পারছেনা দেখে.. দিদি দাদাকে থামিয়ে দিয়ে বললো — দাদা , কেন ওকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছিস বলতো ? ওর যন্ত্রণাটা ওকেই ফেস করতে দে। ঝন্টু ,মা ভালো হয়ে ফিরে এলে আমি বাবাকে রাজি করাবো। আমি ভয়ে ভয়ে বলে উঠলাম — আমাকে অরুণ বলেছে , দাঁতগুলো নাকি সব খুলে ফেলে আবার সেট করতে হবে । ওরে বাবা , আমার তো সর্বনাশ হয়ে যাবে রে দাদা ! দাদা বিজ্ঞের মত শেষ সিদ্ধান্তটা নিলো , বললো — ঝন্টু , দাঁতেরও একটা ইঞ্জিনিয়ারিং আছে । সব ঠেলেঠুলে একসাথে করে দেওয়া যাবে । তুই কিছু চিন্তা করিস না । এতক্ষণে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। আমার হিরো দাদা যখন বলেছে , ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চয়ই । দাদা হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বললো — মনে আছে , এ বাড়িতে মা মাংস রান্না করলে সমু কী চালাকির কান্ড করত বলতো ! দিদি কান্না সামলে বলে উঠলো– হাতে একটা বাটি নিয়ে গিয়ে , রান্নাঘরে ঢুকে মাকে বলতো — ও বড়মাসি ,।একটু ঝোল দেবা? ঝোল নিয়ে এক চক্কর ফিরে এসেই মায়ের কাছে গিয়ে আবার বলতো — বড়মাসি , একটু আলু দেবা ? মা বিনা বাক্যে একটা আলু দিয়ে বলতো , ভীষণ গরম , চামচে দিয়ে কেটে কেটে খাও। সমু আবার ফিরে এসে মায়ের কোলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলতো — বড়মাসি , একটুকরো ছাগলের মাংস দেবা ? মা এবার বলতো — এখনও তো মাংস সেদ্ধ হয়নি বাবা ! সমু অবলীলায় জবাব দিতো — তুমি দাওনা ,আমি ঠিক চিবিয়ে খেয়ে ফেলবো ! মাংসের টুকরোটা পাবার পর বলতো — এক হাতা ভাত দেবা ? এবার আমরা তিন ভাইবোন গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলাম কান্না ভুলে । না ,না — আসলে কান্নাটা চাপা দিলাম হাসি দিয়ে। কারণ , এরকম উপস্থিত বুদ্ধি তো আমাদের মধ্যে কারোর নেই , যা সমুর ছিলো ! সমু দুপুরের ভোজ খাওয়ার অনেক আগেই একহাতা মাংস ভাত টেস্ট করে নিতো । আর আমরা জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতাম। আর ঐ বয়সে সমু কী সুন্দর আমাকে চোখ মারতো ! আসলে ওর চোখ দুটো খুব কথা বলতে তো !
আমি দুঃখ ভুলতে বললাম — এই দাদা ,তোর হাতের কাগজটায় একটা নতুন কবিতা লেখা আছে , তাই না ? দাদা যেন খুব লজ্জা পেয়ে লুকোতে চেষ্টা করছিল , দিদি ছোঁ মেরে কাগজটা কেড়ে নিলো । তারপর মহা উৎসাহে পড়তে গিয়েও…. কেন জানিনা , থমকে গিয়ে চোখের জল মুছে বলে উঠলো—দাদা, তুই মাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিস ? আয় , আজকে আমরা সবাই মিলে কবিতাটা পড়ি….সমু ছন্দা বাবা মা মাসি আর মেসো– সবাইকে মনে করে পড়ি।
দাদা কাঁপাকাঁপা ধরা গলায় পড়তে শুরু করল—-
কবিতার নাম….
” মার কাছে কাছে ফেরা ”
আকাশে অনেক তারা ফুটিয়েছো
হাঁড়িতে ফোটালে ভাত,
লন্ঠন নেভা বৃষ্টির রাতে
বাড়িয়ে দিয়েছে হাত।
ঝুলি উপচিয়ে রূপকথা দিলে ,
বনভোজনের ছুটি ;
দূরে কাশবন আঙিনায় নীল
দোপাটির লুটোপুটি।
আমার দু’চোখে বয়ে যাওয়া নদী ,
ছেড়ে যাওয়া শৈশব ,
বুকে টেনে নিয়ে
কানে কানে দিলে
শব্দের অনুভব !
এখানে কোথাও পাতাঝরা নেই ,
নেই তোমাদের আসা ,
তালগাছে ছোট পাখিরা বোনে না
বাবুই পাখির বাসা ।
তবু হোস্টেলে আলো নিভে গেলে
মৃদু মোম জ্বেলে আমি ,
ডাইরির পাতা ভরে লিখে যাই়
মনের সালতামামি ।
জানি , একদিন আবার ফিরবো
ও মাটি,তোমার টানে ;
মেঘ রোদ মেখে তোমাকে ডাকবো
রবিঠাকুরের গানে ।
কী অপূর্ব কবিতা ! রাত দশটার সময় বই মুখে নিয়ে ভাবছি– আমি কোনদিন দাদার মতন এমন কবিতা লিখতে পারবো ? আমার মনের কথা , প্রাণের কান্না….
দিদি হঠাৎ বলে উঠলো– এই , তোরা কান পেতে শোন , বাবার জুতোর মচ মচ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বাবা আসছে ।
দাঁড়া ,আমি বাইরে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখি।
ঝন্টু , তুই কাটারিটা নিয়ে আয় । বাবা আগুন আর লোহা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকবে তো ! সমুর সব কাজ শেষ করে বাবা আসছে । ফিরে আসছে…ওই শোন , জুতোর আওয়াজটা এবার শুনতে পাচ্ছিস ? নিস্তব্ধ রাত্রি ভেদ করে সত্যিই বাবার জুতোর আওয়াজ পেলাম। কেমন যেন অবসন্ন , কেমন যেন বাবার ডান পা আর বাঁ পা, ক্লান্ত শরীরটাকে বয়ে নিয়ে আসছে । টিপটিপ করে বৃষ্টি নামলো । বাবার জুতোর শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে এলো।কাছে,আরও কাছে–মচ…মচ…মচ…মচ…

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।