• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ২১)

রূপকথা পৃথিবীর

ওমা,মনে পড়ে , তোমাকে যে বলেছিলাম,
ছন্দে আঁকবো ছোট্টবেলার গল্প ;
কিছুটা তোমার আঁচলেই দেবো বেঁধে ,
কচিকাঁচাদের জন‍্যে লিখবো অল্প !
এ বছরটা একটাও ফুটবল ম‍্যাচ বা টুর্নামেন্ট খেলা হল না। কমলদাও ছুটির পরে স্কুল গেটের বাইরে , সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে , ধমকে চমকে আমাকে বাধ‍্য করলো না টুর্নামেন্টের মাঠে নিয়ে যাবার জন‍্য। শুধু কানু বংশীদের নিয়ে চলে যাবার সময় আমার কাঁধে হাত রেখে বলে যেত — মা ভালো হয়ে উঠলেই আবার কিন্তু ফুটবলে ঝাঁপাতে হবে । এবারে শীতেও টুর্নামেন্ট আছে ।পরিচয়, তুই ছাড়া ডানপিটের ডান দিকটা কিন্তু কানা , মনে রাখিস।
আমি একদিনও ভরা বর্ষায় বল ভাসা জলের মাঠে , মা ফুটবলেশ্বরীর দিব‍্যি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়িনি। শুধু , বর্ষাকালে বাবা একদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙিয়ে কানে কানে বলেছিল — আজকে মোহনবাগান মাঠে মোহনবাগান আর এরিয়ান্সের ফিরতি লীগের হাড্ডাহাড্ডি ম‍্যাচ। জিতলেই তোর মোহনবাগান চ‍্যাম্পিয়নশিপের কাছাকাছি চলে যাবে। আমার কলিগ , এরিয়ান্সের কর্মকর্তা কাশীবাবু দুটো ডে স্লিপ দিয়েছে । আমি বুঝলাম , আমার আর দাদার মতোই মোহনবাগান পাগল বাবা আসলে এরিয়ান্সের খেলা দেখবার জন‍্যেই মাঠে যেতে চাচ্ছে । পাঁচবছর এরিয়ান্সের লেফট আউটে , দাপিয়ে ফুটবল খেলা আমার বাবা , আজ পড়ন্ত বিকেলে মোহনবাগানের জয় আর পরাজিত এরিয়ান্সের বীরের মতো লড়াই দেখতে যাচ্ছে । আর আমি ভাবছি ,স্বপ্ন দেখছি না তো ! এই কাশীকাকুই বাবাকে এরিয়ান্স ক্লাবে নিয়ে যায় । সেটা সেই ১৯৪৫ সালের গল্প । স্কুলে ডুব মেরে বাবার সঙ্গে রাইটার্সে গিয়ে বসে থাকলাম। ন’টার ৩৪ নং এক্সপ্রেস বাসে বাবার জনপ্রিয়তা দেখে হিংসে হল । তারপর রাইটার্সের চার নং ব্লকের তিনতলায় ইংরেজ আমলের লিফটে উঠে , অফিসে ঢুকে ,বাবার সহকর্মীদের সে কী বিপুল উচ্ছ্বাস আমাকে ঘিরে ! বাবার কলিগ পিসি কাকুদের একটাই কথা — দাদার মতো ইঞ্জিনিয়ার আর বাবার মতো খেলোয়াড় দুটোই একসাথে হতে হবে। আমার দুটো গালই তাঁদের গাল টেপা আদরে গণতান্ত্রিক হয়ে গেছে।আর হেড অফিসের বড়বাবু আমার বাবার সেক্রেটারিয়েট টেবিলে কত রকম খাবার ! বাবার মুখে শুনেছিলাম, রাইটার্সের করিডোরে ,বাংলার সব প্রান্তের সেরা মিষ্টিগুলো পাওয়া যায় । আমি খুব মনযোগ দিয়ে , কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া , সরভাজা , জনাইয়ের মনোহরা আর শক্তিগড়ের ল‍্যাংচার রহস্য ভেদ করতে শুরু করলাম।ফাইলের গভীরে ডুবে যাওয়া আমার বাবাকে দেখে একটা কথা মনে হচ্ছিল — আমার মায়ের অসুখে বিপর্যস্ত আমাদের বাবাকে তাঁর সহকর্মীরা কতটা ভালোবাসে,শ্রদ্ধা করে ! রীণা পিসি ,অবন্তিকা পিসি আমার কাছে এসে , এইসময় কিভাবে পড়াশোনা করছি , তার খুঁটিনাটি জানতে চাইলেন। অবন্তিকা পিসি বললেন — তোমার দিদি শৃঙ্খলাকে দেখতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করে । কতটা মনের জোর ওইটুকু একটা মেয়ের থাকতে পারে ! আমার মেয়ে তো চা খেয়ে কাপটা পর্যন্ত….
আমি ক্ষীরভরা ল‍্যাংচার শেষটুকু গলার মধ‍্যে দিয়ে প্রাণের কাছাকাছি টেনে নিতে নিতে মনে মনে বলবো ভাবছিলাম — আমাকে দিদির আড়ংধোলাই প‍্যাঁদানির কথা। কিন্তু আলু থেকে নীল গুলি হয়ে যাওয়া আমার বন্ধুটা বললো — খবরদার বলিস না !নিজের দিদিকে কেউ ছোটো করে পাগলা ?
খেলা শুরুর আধঘণ্টা আগে মোহনবাগান মাঠে গিয়ে আমি হাঁদাগঙ্গারাম হয়ে তাকিয়ে থাকলাম , সেই আশ্চর্য সুন্দর সবুজ গালিচার দিকে। বাবা বললো — চেয়ে দ‍্যাখ ,ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ফুটবল গ্রাউন্ড এটা ।এখানে ঘাসের নীচে এমন সুন্দর ড্রেনেজ সিস্টেম আছে যে , মাঠে কখনও জল দাঁড়ায় না । বাবা আরও বললো — আমি কলকাতার সব মাঠে খেললেও মোহনবাগান মাঠে খেলার স্মৃতি কোনোদিনও ভুলবো না‌।আমাদের যশোরের মাঠগুলোও সুন্দর। কিন্তু মোহনবাগান মাঠ, টেন্ট ,লন, সবই যেন ভীষণ ভীষণ সুন্দর ! ততক্ষণে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার — মাঠে নামছে মোহনবাগান। মাঠে নামছে ভারতবর্ষের অন‍্যতম সেরা ফুটবল দল মোহনবাগান। তাদের চির পরিচিত সবুজ মেরুণ জার্সি আর ধপধপে সাদা হাফপ‍্যান্টে। তার আগেই নেমে গেছে এরিয়ান্স দল। বাবার মুখে এরিয়ান্সের তরুণদের বল নিয়ে ছুটোছুটি দেখে আশ্চর্য তারিফ আর হাততালি । মোহনবাগান মাঠের সদস‍্য গ‍্যালারির এটাই অলিখিত নিয়ম–বিপক্ষ দল নামলেও তাকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্বর্ধনা দেওয়া। বাবা আর একটা তথ্যও জানালো — মোহনবাগান মাঠের সদস্য গ‍্যালারি থেকে , দলের খেলা দেখে বিরক্ত হয়ে , কেউ যদি কোনো খারাপ কথা বলে , সঙ্গে সঙ্গে তাকে মাঠ থেকে বার করে দেওয়া হয় । বাবার হাতটা শক্ত করে চেপে দাঁড়িয়ে আছি।বাবার রক্ত চলাচলটা আমার নিজের শরীরে নিয়ে নিচ্ছি — আমার বাবা এই মাঠে পাঁচ বছর খেলেছে ? আচ্ছা আমি কোনোদিনও ……..
মস্ত বড় একটা হাঁ করে তাকিয়ে আছি মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের দিকে , আর খবরের কাগজের ছবির সঙ্গে তাদের মুখগুলো একটা একটা মেলাচ্ছি , আর প্রতি মুহূর্তে চমকে চমকে উঠছি ! ওই তো , মোহনবাগানের ক‍্যাপটেন চন্দ্রেশ্বর প্রসাদ। ওই তো গোলকিপার বলাই দে । ওই তো রাইট ব‍্যাকে আমাদের দক্ষিনেশ্বরের গর্ব ভবানী রায় ! ওই তো রাজপুত্রের মতো দেখতে সৈয়দ নাইমুদ্দিন । আর বাবা আঙুল দেখালো দুজন অল্পবয়সী খেলোয়াড়ের দিকে । লম্বা লাজুক হাসির খেলোয়াড় — সুকল‍্যাণ ঘোষ দস্তিদার ,উত্তর বাংলার ছেলে । কলকাতার বিখ্যাত রাজস্থান ক্লাব থেকে এ বছর মোহনবাগানে এসেছে । সে ও তার প্রাণের বন্ধু সুভাষ ভৌমিক গত বছর রাজস্থান ক্লাবে গোলের বন‍্যা বইয়ে দিয়েছিল। সুভাষ ভৌমিক গেছে ইস্টবেঙ্গলে । সুকল‍্যাণের পাশে কর্নাটকের শিল্পী খেলোয়াড় কান্নান ।তারপর বাবা দেখালো মাঠের ব়াঁদিকে যে টকটকে ফর্সা খেলোয়াড়টি, খেলা শুরুর আগে বল নিয়ে ভয়ঙ্কর স্পিডে একা একা স্প্রিন্ট টানছে , তার নামই প্রণব গাঙ্গুলি। হাওড়া ইউনিয়ন থেকে মোহনবাগানে এসেছে। সুকল‍্যাণের ডান পা আর প্রণবের বাঁ পায়ের সট অনায়াসেই পঁয়ত্রিশ , চল্লিশ গজ দূর থেকে বিপক্ষের তেকাঠির ঠিকানা খুঁজে নেয় বুলেটের গতিতে । আর কান্নানের অনায়াস ড্রিবলিং তো যেন তুলি আঁকা ছবি !
আমি কেমন ঘোরের মধ‍্যে ডুবে যাচ্ছি — যখন দেখলাম , সদ‍্য খেলা ছেড়ে দেওয়া , বাঙালির স্বপ্নের নায়ক চুনী গোস্বামী নিঁখুত স‍্যুটেড বুটেড হয়ে , মাঠের সাইডলাইনের ধারে সবুজ বেঞ্চিতে এসে বসলেন।সারা মাঠের আকাশ ফাটানো চিৎকারে তাঁকে উঠে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে হল অনেকক্ষণ ধরে। বাবা ফিসফিস করে বললো — চুনী গোস্বামী , পি কে ব‍্যানার্জী , শৈলেন মান্নারা ইংল্যান্ড , জার্মানি বা ব্রাজিলে জন্মালে বিশ্বকাপের নায়ক হয়ে যেতে পারতো ! আমাদের দুর্ভাগ্য কী জানিস ঝন্টু — এতবড় দেশটায় , ফুটবলকে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরবার মতো তেমন কোনো পরিকাঠামোই নেই। আমি একটু বুঝলাম। অনেকটাই বুঝলাম না । চোখের সামনে তখন সেই আশ্চর্য সবুজ মাঠে , সাদা রঙের রাশিয়ান বল , দু দলের কুশলী খেলোয়াড়দের পায়ে পায়ে যেন মহাকাব্য রচনা করছে। খেলার শেষে মোহনবাগান অনায়াসে জিতলো — সেটা খুব বড় কথা নয় । বড় কথা নয় যে — সুকল‍্যাণ , কান্নান ,প্রণব গাঙ্গুলি তিনজনেই গোল দিলো । আর অসাধারণ ভারতীয় গোলকিপার বলাই দে উড়ন্ত পাখির মতো মোহনবাগানের গোল পোস্ট রক্ষা করলো ; আসল কথাটা হল একটা দারুণ ফুটবল ম‍্যাচ দেখলাম। প্রায় সন্ধে নেমে আসা মোহনবাগান গ‍্যালারিতে বাবার সঙ্গে বাদামভাজা খেতে খেতে এটাই বুঝলাম যে , বাঙালির রক্তে রক্তে মিশে আছে ফুটবল খেলা। সেই স্বপ্নের ফুটবল ছড়ানো রয়েছে , চট্টগ্রামের সাগর থেকে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় পর্যন্ত। ফুটবল না জুটলেও , খেলা পাগল ভগবান সেই কবে , গাছ থেকে বাতাবি লেবু পেড়ে , তাকেই ফুটবল বানিয়ে, ধুতি মালকোঁচা মেরে বাঙালিকে বলে লাথি মারতে শিখিয়েছিল । সেই খালি পায়ে লাথির কায়দাকানুনই একশো গুণ বেড়ে গিয়ে ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডের আধুনিক ফুটবল ক্লাব ইস্ট ইয়র্ককে ২-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে , আই এফ এ শীল্ড জিতিয়েছিল। বাবা একদিন বলেছিল–বাঙালিরা সারাদিন ইংরেজদের থেকে তাদের আধুনিক ভাষাটা দারুণভাবে শিখে , রাত্রিবেলা অত্যাচারী ইংরেজদের তাড়ানোর জন‍্য বোমা বাঁধতো স্বদেশী আমলে। এখানেই আমাদের প্রাণশক্তির উৎস !
দূরে লাল নীল সবুজ বিজ্ঞাপনের আলো জ্বলা ধর্মতলার মর্মতল থেকে উঠে আসা ঝিরঝির বৃষ্টির সন্ধ্যা যেন বলে উঠলো — ও পরিচয় , তোর মা এখন অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে। তুই যখন মন দিয়ে খেলা দেখছিলি, তখন তোর মা মানসিক হাসপাতালের রিক্রিয়েশন রুমে বসে কোন গানটা শোনাচ্ছিলো জানিস—
এ জীবনে মোর যত কিছু ব‍্যথা,যত কিছু পরাজয়,
তোমারে স্মরিয়া লাগে যে গো,
লাগে যে গো মধুময়….
আমি জানি আমার গান পাগল মা, এই নরম বৃষ্টির বিকেলে প্রিয় গানটা তাঁর “ওগো শুনছো”কে উদ্দেশ্য করেই শুনিয়েছিলো।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।