সাপ্তাহিক শিল্পকলায় শিল্পের জন্য শিল্প – লিখেছেন অ্যালবার্ট অশোক (পর্ব – ৪৮)
by
·
Published
· Updated
চিত্তপ্রসাদের সাদাকালো প্রতিবাদ ও জীবন
চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য
১৯৩০ সালে, ব্রিটিশদের উপনিবেশিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে শিল্পী কালি কলমের ড্রয়িং নিয়ে, রাজনৈতিক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, তার নাম চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটির ছেলে। জন্ম ১৯১৫ ও মৃত্যু ১৯৭৮ সালে কলকাতায়।
১৫ বছর বয়েসেই তার ভাবনা কালিকলমের টানে ছবি হয়ে ফুটত। চিত্তপ্রসাদ বর্তমানে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ১৯৩০-এর দশকের চাটগ্রাম বিদ্রোহের নায়ক ও নায়িকাদের প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন এবং ১৯৪০ এর দশকের গোড়ার দিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এর সংস্পর্শে আসেন। চিত্তপ্রসাদের শৈল্পিক বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক পি সি জোশী, যিনি তৎকালীন চট্টগ্রামে এসেছিলেন। এটি ছিল তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
Chittaprosad, People’s Democratic Front, brush, pen and ink on paper, 1952, 34.8 x 50.8 cm.Courtesy of Osianama Research Center, Archive & Library, India
Chittaprosad, “Humanity Dehumanised,” 1943 from Hungry Bengal. Image courtesy of the Chittaprosad Archives, DAG Archives, New Delhi
যোশী চিত্তপ্রসাদকে গ্রামীণ লোক চিত্রকলার ঐতিহ্য এবং ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাকে বোম্বাইতে নিয়ে গিয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে, এবং পার্টি জার্নাল পিপলস ওয়ারে (People’s War, the party journal) শিল্পী হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। সিপিয়াই CPI পার্টি তাঁকে মেদিনীপুর জেলায় পাঠিয়েছিল বাংলার দুর্ভিক্ষের শিকারদের উপর একটা প্রতিবেদনের ছবি আঁকতে (the victims of the Bengal famine,1943)। এটি হাংরি বেঙ্গলের বা দুর্ভিক্ষের দুর্ভিক্ষের প্রথম হাতে আঁকা বিবরণ, এতে লেখা ছিল এবং কালো এবং সাদা বর্ণের স্কেচগুলি, যা পিপলস ওয়ার পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল।চিত্তপ্রসাদের ছবিগুলি দিয়ে বই হিসাবে প্রকাশিত হওয়ার পরে ব্রিটিশরা ক্ষুধার্ত বাংলার কয়েক হাজার বই বাজেয়াপ্ত এবং ধ্বংস করে দেয়। চিত্তপ্রসাদ তেলঙ্গানায় সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামও হাতে এঁকেছিলেন । চিত্তপ্রসাদ প্রথম দিকথেকেই রাজনৈতিক মনোভাবা ছিলেন।
১৯৩০ সাল নাগাদ চিটাগাং গভর্ণমেন্ট কলেজের ছাত্র।সেই সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চিটাগাং কলেজ উল্লেখ যোগ্য ছিল। ব্রিটিশ ও নানা সামাজিক বিষয়ের (the feudal and colonial systems) উপর ঠাট্টার ছবি আঁকতেন। তখন ছবি এঁকে নাম সই করতেননা, ফলে কত ছবি এঁকেছেন তা হিসাব করা যায়নি। লিনোকাঠ, উডকাট ও নানা পেইন্টিং তিনি করেছেন। বাংলার দুর্ভিক্ষের উপর তিনি ১৯৪৩ সালে প্রচুর কাজ করে বিখ্যাত হন। সেই আঁকাগুলি নিয়ে তার প্রথম ‘ক্ষুধার্ত বাংলা’ Hungry Bengal শিরোনামে বই প্রকাশ হয়। ১৯৪৬ থেকে মুম্বাই (বোম্বে) স্থায়ী বাসিন্দা হন। কমিউনিষ্ট পার্টি করতেন। ১৯৪৮-৪৯ কমিউনিস্ট পার্টি ভাগাভাগি হওয়া তার পছন্দ ছিলনা, তাই এরপর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত থাকেননি। যদিও রাজনৈতিক ভাবনায় কাজ করেছেন , ছবি এঁকে। মৃত্যুর আগে তিনি শান্তির স্বপক্ষে কাজ করে গেছেন। বঞ্চনা ও দারিদ্রতা হৃদয়স্পর্শী ছবি এঁকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় হন।
চিত্তপ্রসাদ একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। শান্তি নিকেতন ও কলকাতার দুটি নামী আর্ট কলেজ Kala Bhavana and the Government College of Art & Craft, তাকে ভর্তি নেয়নি। ফিরিয়ে দিয়েছে। এটা লজ্জা জনক ঘটনা। তার স্বাধীনতা আন্দোলননের এক গুরু , কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতা, পূরন চন্দ যোশী, তাকে ছবি আঁকার সাহস যোগাতেন। দিল্লী আর্ট গ্যালারীর উদ্যোগে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ১৫ মার্চ থেকে একটা ‘ফিরে দেখা’ রেট্রোস্পেক্টিভ চলছে। চিত্তপ্রসাদের প্রদর্শনী আগেও ভারতের বাইরে অনেকবার হয়েছে। তার পরবর্তী সময়ের ভাল কাজগুলি থাকছে। স্কেচগুলি অনেক টাকা মূল্য সংগ্রাহকরা সংগ্রহ করবেন।
চিত্তপ্রসাদ চট্টগ্রামে Chittagong বেড়ে ওঠা ও প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত যা শিল্পী সোমনাথ হোরে artist Somnath Hore, র মতে, “বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চরমপন্থী রাজনীতির ব্যর্থতায় দিকভ্রষ্ট হয়ে কমিউনিজমে পরিণত হয়েছিল।”
চিত্তপ্রসাদের জাপান বিরোধী পোস্টারগুলি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এর সাধারণ সম্পাদক পুরান চাঁদ জোশির (১৯০–-১৯৮০)(CPI), Puran Chand Joshi (1907–1980) নজর কেড়েছিল, এভাবেই তিনি পার্টির সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কাজ করতে এসেছিলেন। চিত্তপ্রসাদকে ১৯৪০ এর দশকের গোড়ার দিকে বোম্বাইয়ের পার্টির সদর দফতরে পাঠানো হয়েছিল এবং ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (আইপিটিএ)Indian People’s Theatre Association (IPTA), এর সাংস্কৃতিক শাখার সাথে সক্রিয়ভাবে তিনি জড়িত হয়েছিলেন।
ফ্যাসিবাদী শক্তি, ঔপনিবেশিক শাসন, সামন্তবাদ এবং ও পুঁজিবাদের industrial capitalism বিরুদ্ধে জনগণের কাছে রাজনৈতিক সংগ্রামের জনমত তৈরি করতে কমিউনিস্টরা জোরদার কাজ করছিল তখন। আর আই পি টি এ তখন নানা পূস্তিকা প্রকাশ করছিল সাংস্কৃতিক উত্থানের জন্য। সংস্কৃতির প্রাসঙ্গিকতা এবং গুরুত্ব স্পষ্ট ছিল জোশির কাছে এবং ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে চিত্তপ্রসাদ এবং চিত্রগ্রাহক সুনীল জানাহ photographer Sunil Janah (1918–2012) কে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষগ্রস্থ মেদিনীপুর জেলায় পাঠানোর উদ্যোগ তাঁরই ছিল, দুর্ভিক্ষের নথিভুক্ত করতে. যা বাংলার দুর্ভিক্ষ হিসাবে পরিচিত, এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম ধ্বংসাত্মক ঘটনা হিসাবে বিবেচিত এবং এটা ছিল পুরোপুরি মানুষের সৃষ্টি করা দুর্ভিক্ষ।
Photograph by M. Krása, date unknown. As inscribed on the back, we see Chittaprosad in the middle and M. F. Husain on the right. Photo courtesy of Mrs. Helena Bonušová and the Krása family
কিছু ব্যক্তিবর্গের উপর চিত্তপ্রসাদের যোগাযোগ ছিল যেমন,বোম্বাইয়ের (এখনকার মুম্বাই) চেকোস্লোভাকিয়ার ট্রেড কমিশনারের সহকারী (the assistant to the trade commissioner of Czechoslovakia), যার সাহায্যে এবং বন্ধুত্বের মাধ্যমে চিত্তপ্রসাদ ১৯৫০ এর দশকে বোম্বাই শহরতলিতে তাঁর পুতুল নাট্য (puppet theater) প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এটি ১৯৬০ এর দশকের গোড়ার দিকে ন্যাশনাল গ্যালারী প্রাগ শিল্পীর কাছ থেকে কিছু লিনো কাট ছবি সংগ্রহ করে এবং এটি ১৯৭২ সালে পাভেল হাবল Pavel Hobl শিল্পীর সম্পর্কে নির্মিত চলচ্চিত্র তৈরি করেন ফলে ইংরেজি জার্নাল নভো ওরিয়েন্ট / নিউ ওরিয়েন্ট বাই মান্থলি, চেকোস্লোভাক একাডেমি অফ সায়েন্সের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট English journals Nový Orient/New Orient Bimonthly, published by the Oriental Institute of the Czechoslovak Academy of Sciences, দ্বারা প্রকাশিত হয়,এইভাবে প্রতিষ্ঠা পায় an awareness of a transnational network as conceived of spaces, platforms, and institutional and individual support।
চিত্তপ্রসাদের অন্যতম বন্ধু যিনি অনেক সুযোগ সম্ভাবনা খুলে দেওয়ার জন্য এবং শিল্পীর কাজকে চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রদর্শনী করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি ছিলেন ফ্রন্টিয়াটেক সালাবা (František Salaba)। থিয়েটার এবং পুতুলগুলির জন্য তাদের পারস্পরিক আবেগই তাদের সংযুক্ত করে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে সালাবা বোম্বাইয়ের চেকোস্লোভাকিয়ার ট্রেড কমিশনারের সহকারী হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি লিটল ব্যালে ট্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, শান্তি ও গুল বর্ধনের মাধ্যমে রিহার্সালের সময় চিত্তপ্রসাদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন, চিত্তপ্রসাদ ছিলেন শান্তি ও গুলবর্ধনের বন্ধু।
আইপিটি IPTA, এর থিয়েটারে চিত্তপ্রসাদ শিল্পী হিসাবে নানা ডিজাইন ও প্যানেল সাজিয়ে দিতেন আই পি টি এ তখন সারা ভারত থিয়েটার নিয়ে টুর দিত। নানা জায়গায় মঞ্চস্ত করত।। তিনি ১৯৫৫, সালে দিল্লিতে রাজস্থানী গ্রামের পুতুল ঠিয়েটারের একটি দলের সাথেও কাজ করেছিলেন এবং তিনি লিটল ব্যালে ট্রুপের জন্য পোশাক এবং পর্দা নকশা করেছিলেন।
বোম্বাইতে থাকাকালীন সালাবা চেক খেলনা এবং পুতুলের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন, যার মধ্যে থেকে চিত্রপ্রেসাদ বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এর পরে সালাবা তাকে কিছু পুতুল উপহার দিয়েছিলেন এবং “তাঁকে একটি পুরো পুতুল মঞ্চ উপস্থাপন করেন।(“presented him an entire puppet stage.”)” এইভাবেই চিত্রাপ্রসাদ খেলাঘর নামে একটি পুতুল নাট্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার জন্য তিনি মঞ্চ এবং পুতুলগুলি ডিজাইন করেছিলেন, স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন এবং বাচ্চাদের জন্য নাটক পরিবেশন করেছিলেন যা তার আন্ধেরির Andheri বাড়ির কাছেই ছিল। চিত্তপ্রসাদ সালাবাকে তাঁর সেরা বন্ধু Krása কে অনেক চিঠিতে স্বীকার করেছেন বলেছেন সেই ব্যক্তি হিসাবে যিনি “আপনার দেশে আমার কাজকে বিখ্যাত করেছেন।
উত্তর-আধুনিক ভারতে সাধারণ পরিবেশ general atmosphere in postcolonial India এ জাতীয়-আধুনিক শিল্পের স্বাক্ষরের জন্য উদ্বেগের সাথে, তিনি ১৯৪৮ সালে সিপিআই থেকে তাঁর সংশ্রব ত্যাগ করেন।
সূত্র১
তিনি প্রাগের জাতীয় জাদুঘর the National Museum in Prague, নয়াদিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারী অফ মডার্ন আর্ট The National Gallery of Modern Art in New Delhi,, মুম্বাইয়ের ওসিয়ান আর্ট আর্কাইভ Osians Art Archive in Mumbai এবং দুবাইয়ের জেন এবং কিতো ডি বোয়ার কালেকশনেthe Jane and Kito de Boer Collection in Dubai তার কাজের সংগ্রহ আছে।