সাপ্তাহিক শিল্পকলায় শিল্পের জন্য শিল্প – লিখেছেন অ্যালবার্ট অশোক (পর্ব – ৪৭)
by
·
Published
· Updated
মহিলা শিল্পী
জর্জিয়া ও-কিফি Georgia O’Keeffe ১৮৮৭ সালে জন্মান শিকাগো শহরে পড়াশুনা করেছেন আর্টের স্টুডেন্ট ও ফটোগ্রাফি নিয়ে। Alfred Stieglitz ছিলেন একজন আর্ট ডিলার পরে জর্জিয়ার সাথে বিয়ে হয়, তিনি ১৯১৬ সালে জর্জিয়ার একটি গ্যালারী শো করান। জর্জিয়াকে বলা হয় আমেরিকার মডার্ণ আর্টের মা। তিনি বিমূর্ত ছবি আকতেন। ছবিগুলি মুলত বড় বড় ফুল, নিউ ইয়র্কের উঁচু বাড়ি, আর নিউ মেক্সিকোর দৃশ্যচিত্র। তার ছবিতে নারীর যোনীর আদল পাওয়া যায়। তিনি ছবিগুলিকে সেইভাবেই রুপ দিতেন। ১৯৮৬ সালে ৯৮ বছর বয়সে মারা যান।
নগ্ন হয়ে প্রকাশ্যে দাড়াবার মানসিকতা না থাকলে, ক্ষমতা না থাকলে সম্ভবত তারকা হওয়া যায়না। ও-কিফি জীবনের প্রথমভাগে সৃষ্টির হাত ছানি পেয়েছিলেন।
সেটসুকো ওনো Setsuko Ono । জন্ম টোকিওতে। বড় হয়েছেন জাপানে ও আমেরিকায়। বিদেশনীতি দক্ষ একজন মহিলা, শিল্পী হয়ে উঠলেন। শিল্প সংস্কৃতি তার ঘরের ব্যাপার। তার বাবা ভাল পিয়ানো শিল্পী কাকা পেইন্টার। আরেকজন ভাস্কর। তাছাড়া তার দিদি ইয়োকো ওনো Yoko Ono, বিখ্যাত পারফর্ম্যান্স শিল্পী। ১৯৬৪ সালে নিউ ইয়র্কে ‘কাটপিস’ Cut Piece (1964)খেলা দেখিয়ে আমেরিকার ইতিহাসে সুনাম অর্জন করেন। তিনি আবার বিখ্যাত বিটল জন লেননের স্ত্রী। জন লেনন তাকে বলেছিলেন তুমি শিল্পী হও। আমেরিকাতে হাইস্কুল শেষ করে জাপানে ফিরে যান সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করেন।
সেটসুকোর বাবা একজন ব্যাঙ্কার। অগাধ টাকার মালিক। কিন্তু তিনি পিয়ানো ভালবাসতেন ও চাইতেন সেতসুকো পিয়ানো বাদক হোক। ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন শিপে মাস্টার ডিগ্রী করেন, পরে পলিটিক্যাল সাইয়েন্সে ডক্টরেট করেন a B.A. in English Literature from the University of Sacred Heart in Tokyo and M.A. and PhD from the Graduate Institute of International and Development Studies of the University of Geneva.। পেশা হিসাবে নানা উচ্চ পজিশিশনে থেকে আফ্রিকা ইউরোপ ঘুরেছেন। বড় উচ্চ পেশার স্বামী। যিনি আন্তর্জাতিক রিলেশন ও ওয়ার্লড ব্যাঙ্কের বিশেষ পজিশনে। ২০০৩ এ ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক থেকে অবসর নিয়ে শিল্প চর্চায় আসেন।
অষ্টম হাভানা বিয়েনালে ৬টি ভাস্কর্য নিয়ে তার যাত্রা।
যখন ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে কাজ করছিলেন তখন কতগুলি শিক্ষা ও শিল্প প্রোগ্রামে থেকেছিলেন (Corcoran College of Art and Design while working at the World Bank in Washington D.C..) তারপর ফ্রান্সের পয়ারী শহরে কিছু নামী স্টুডিওতে কাজ করেন Les Ateliers des Beaux Arts de la Ville de Paris.। এছাড়া লন্ডনে কিছু প্রদর্শনী করেন। এখানে একজন মহিলা শিল্পীর জীবন ও শিল্পের প্রতি অনুরাগ দেখার মত। তিনি স্টিলের ভাস্কর্য করেন আর পলিটিক্যাল ছবি আঁকেন। গত কয়েক বছরে তিনি আন্তর্জাতিক শিল্পী হিসাবে সম্মানিত।
ডোরিন গারনার Doreen Garner ১৯৮৬ সালে জন্মেছেন পেনসিলভালিয়া ফিলাদেলফিয়াতে। কাজ করেন ব্রুকলীন ও নিউইয়র্কে। তার ভাস্কর্য silicone, foam, glass beads, fiberglass, insulation, steel meat hooks, steel pins, … এই সব উপাদান দিয়ে করেন। মানুষের যন্ত্রণা, শরীরের মধ্যে কাটাচেরা ইত্যাদির বিষয়। জেনি সেভাইল Jenny Saville ব্রিটিশ পেইন্টারের মত অনেকটা। জেনি সেভাইলের আগে জেনির মত ভাবনায়, গ্লাস বক্সে দুমরানো শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অ্যানা মেন্ডিয়েটা দেখিয়েছিলেন। এখানে ডোরীনের কাজ দেখুন।
হেলেন চাদউইক, Helen Chadwick হিসু ফুল (Piss Flowers)
ছবি আঁকা, ভাস্কর্য গড়া, পৃথিবী বিখ্যাত হওয়া। অতীব সহজ। দরকার আপনার একজন গুরু যার কাছে দীক্ষিত হবেন বা একজন পথ প্রদর্শক। তিনিই আপনার উর্বর মস্তিষ্কের জন্য মুকুটের প্রথম সুপারিশ করবেন। আর ব্যস, আপনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। হ্যা বিনা পয়সায় নয়, কড়ি মোহর বা মূদ্রা দিতে হয়, মূদ্রা সহজেই সংগ্রহ করা যায়।
মানুষের মেধাও অনেকের থাকে। সেই মেধা অনেকে ভাবে তার পৈত্রিক সম্পত্তি, লোহার সিন্দুকে রেখে দেয়। কেউ ধরতে গেলে মারাত্মক আক্রমণ করে।আবার কারুর কাছে , তুচ্ছ জিনিস। ‘নে, কত নিবি নে, আমি সমুদ্র, কয় ঘটি জল নিবি নে। আমি ফুরাবোনা।’এই বলে নিজেকে মেলে ধরে। এখানেই আপনার ক্ষমতা পরীক্ষা হয়ে যায়। না হলে, শিল্পীরা হাগা মুতা বমি করেও পৃথিবী বিখ্যাত হয়েছে। এরকম ইতিহাস আমি অনেকবার লিখেছি। পৃথিবীতে কোটি কোটি লোক। তার মধ্যে বিখ্যাত হওয়া, কুর্ণিশ আদায় করা চাট্টি খানি কথা নয়। সবাই সহজেই হাগা মূতা বমি করে, আক্ষরিক অর্থে। এসব করতে কষ্ট করতে হয়না, সবাই পারে। কিন্তু বিখ্যাত তারকা একজনই পারে।
আজকে এক মহিলার (Helen Chadwick, 18 May 1953 – 15 March 1996) গল্প বলব, তিনি মূল ভাবনাটা পেয়েছেন হিসি করতে গিয়ে ও হিসি করে ভাস্কর্য বানান ( Piss Flowers (1991–92))।
হেলেন চাদউইক, রীতি মত অ্যাকাডেমিক ভাবে ছবি ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশুনা করেছেন।১৯৮৭ সালে বিখ্যাত টার্নার পুরস্কারে মনোনীত ও পুরস্কৃত প্রথম মহিলা শিল্পী। তার হিসু ফুল (Piss Flowers) ১৯৯১ সালে সৃষ্টি হয়। বলেই রাখি, ক্ষেপা না হলে, পাগলা না হলে পৃথিবীর অনেক সৃষ্টিই সম্ভব ছিলনা। একদিন হেলেন ও তার স্বামী ডেভিড খ্রীস্ট মাসের সময় বরফ ঠান্ডা কোন অঞ্চলে ফটোগ্রাফির জন্য গেছিলেন। সেখানে চারিদিকে বরফ। বলা বাহুল্য ইউরোপ শীত কালে অনেক অঞ্চল বরফে ঢেকে যায়। তো তারা হিসু বা প্রস্রাব পেলে বরফের উপর করছিলেন। উষ্ণ শরীরের বর্জ্য পদার্থ বরফের উপর একটা আকৃতি ধারণ করল। ধব ধবে সাদা বরফের মধ্যে ব্যাঙ্গের ছাতার মত একটা আকৃতি। ফটো তুললেন ও সেটি ব্রোঞ্জ কাস্টিং করে cellulose lacquer করে প্রদর্শনীতে আনেন। দুধের মত, ঘৃণ্য একটা বস্তু , সবাই অপবিত্র ও বাজে হিসাবে জানে, তার রুপ ও শিল্প কলায় চলে এল। হেলেন বললেন্, আমি আর্ট স্কুলের শুরু থেকেই এমন কিছু বিষয় করতে চেয়েছিলাম যা দর্শকের সাথে প্রতিক্রিয়া বা ভাবনার অংশ ভাগ করা যেতে পারে। (“Right from early art school, I wanted to use the body to create a sense of inner relationships with the audience.”)
ইউরোপের এক সমালোচক Jonathan Jones এই হিসু ফুলকে মাহাত্ম্য দিয়ে শীতকালের সুন্দর সৃষ্টি বর্ণনা করেন। Helen Chadwick had an eye for the organic. She took closeup photographs of moist, freshly cut meat, superimposed images of her body cells over landscapes, and invented a unique winter methodology to create her Piss Flowers.
ডোরা ক্যারিংটন Dora de Houghton Carrington (29 March 1893 – 11 March 1932) একজন ইংলিশ পেইন্টার। ১৮৯৩ সালে জন্মান। ৩৯ বছর বেঁচেছিলেন। বোহেমিয়ান প্রকৃতির। ববকাট চুল, তখনো পরিচিতি লাভ করেনি। তার ছিল। ফলে তাকে অনন্যা সুন্দরী মনে হত। কত প্রেমিক ছিল তার। যেমন রুপসী তেমন তার অসহ্য সুন্দর ছবি, ও আঙ্গিক। সেই সময় একটা পেইন্টার দের গ্রুপ ছিল বিখ্যাত, ডোরা সেই গ্রুপের লোকেদের সাথে মেলামেশা করতেন, গ্রুপটার নাম ছিল ব্লুমসবেরি গ্রুপ Bloomsbury Group,। ডোরার ছবি দেখে আমার এমন মনে হয়েছিল, এইরকম মেধা ও দক্ষতা যার তার অনেক কাজ করার কথা ছিল। তিনি এক ব্যতিক্রমী শিল্পী।
অনেক লেখক তার প্রেমে পড়েছিলেন তাদের মধ্যে তিনি যাকে বেশী পছন্দ করতেন তার নাম লিটন স্ট্র্যাচি Lytton Strachey। লিটন সেই সময়ের এক উজ্জ্বল নাম। হোমো প্রকৃতির, কিন্তু ডোরা অনেককে ছেড়ে তার জুটি হয়েছিলেন। তার ছবি এঁকেছিলেন। লিটন ১৯৩২ সালে পেটে ক্যান্সার হয়ে মারা যান। ডোরা সেই দুঃখ সহ্য করতে না পেরে বন্ধুদের কাছ থেকে বন্দুক এনে নিজেই নিজেকে গুলি করেন। আত্মহত্যা ছিল এমন এক উজ্জ্বল প্রতিভার শেষ অধ্যায়।