• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুব্রত বসু (পর্ব – ৩)

আমার নাটক, নাটকের আমি

(৩)

“তুমি দেখছ সেরকম কোন অভিনয়?”

“সে সৌভাগ্য আর হল কই, প্রথম স্টেজ এ্যাপিয়ারেন্স  খারাপ হওয়ার যন্ত্রণা প্রায় তিন বছর ভোগ করেছি। আর তো নাটক করার সুযোগ পাচ্ছি না। বললেই তো আর নাটক করা যায় না। প্রথম নাটক করার পর নানান ঝামেলায় সেই দল ভেঙ্গে গেল, রবীনবাবুও উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। একটা দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম।  তবে এই সময় আমার একটা লাভ হয়ে ছিল। কিছু ভাল নাটক দেখার পাশাপাশি ভালো অভিনেতা অভিনেত্রীদের অসাধারণ অভিনয় দেখার  সৌভাগ্য হয়েছিল।প্রথমেই বলতে হয় রক্তকরবীর কথা, একজন অভিনেতা পুরো নাটকে একবার মাত্র মঞ্চে এলেন তাও আধো অন্ধকারের মধ্যে, শুধুমাত্র অন্তরাল থেকে  কন্ঠস্বরে সমস্ত দর্শককূলকে সম্মোহিত করে রাখলেন কয়েক ঘন্টা। তিনি শম্ভু মিত্র, পাশাপাশি তৃপ্তি মিত্রের নন্দিনী, যেন এক কিশোরী বালিকা বইএর পাতা থেকে উঠে এসে যথাযথ সঙ্গতে গোটা মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ালেন। আমার জীবনের প্রথম প্রেম নির্ধারিত হয়ে গেল। অসাধারণ তাকেই বলতে পারি যা কালজয়ী। এরপর শম্ভু মিত্র অভিনীত রাজা ওয়াদিপাউস, নতুন করে কিছু বলার নেই, হ্যাঁ সেইসময় হত, যা শুধু স্মৃতিতেই থেকে গেল, যার সংরক্ষণ হল না।এর কিছুদিন পর দেখেছিলাম উৎপল দত্তের টিনের তরোয়াল, ব্যারিকেড, দুঃস্বপ্নের নগরী, নন্দিনী তোমায় বলে বোঝানো যাবে না উৎপল দত্ত, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সমীর মজুমদার এবং অন্যান্যদের অভিনয়ের কথা,টিম ওয়ার্ক টাইমিং কোন পর্যায়ে যেতে পারে, দর্শক যতক্ষণ হাসবে ততক্ষণ ওনারা ডায়লগ বলবেন না পাছে শুনতে অসুবিধে হয়, হাসি থামলে আবার ডায়লগ বলবেন।
“এটা কিকরে সম্ভব হত?”
“সাধারণ লোকজন যারা নাটকটি সম্বন্ধে কিছু জানে না তাদের দর্শক আসনে বসিয়ে  রিহ্যার্সাল দেওয়া হত। প্রতিবারেই নতুন নতুন লোকের সামনে। তবে এটা সম্ভব হয়। বলতে খুব সহজ, কিন্তু কাজে পরিণত করা যে কতখানি দুরুহ আন্দাজ করতে পারবে না নন্দিনী।প্রতিটি নাটক নিয়ে আলাদা করে বলা সম্ভব নয়।স্টেজের ব্যবহার কাকে বলে উৎপল দত্তের নাটক দেখে বোঝা যায়। দুঃস্বপ্নের নগরী নাটকে একটি ব্যস্ত  রাস্তার দৃশ্য, নানান লোকজন সেখানে তার মধ্যে একজন খুন হয়ে গেল। প্রতিটি অভিনেতা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত, কেউ কাউকে আড়াল করছে না। পারফেক্সসানের চুড়ান্ত পর্যায়। কার কথা ছেড়ে কার কথা বলব নন্দিনী, নান্দীকারের ভালোমানুষের পালায় কেয়া চক্রর্বতীর অবিস্মরণীয় অভিনয়। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা।
“আচ্ছা উনিই তো সুটিং করতে গিয়ে লঞ্চ থেকে পড়ে মারা গেলেন”।
হ্যাঁ। বাংলা জগৎ হারিয়েছিল এক অসাধারন অভিনেত্রীকে। এই সব নাটকের কথা বলে শেষ করতে পারব না নন্দিনী।  তবে এইটুকু বলতে পারি তখনই নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছিল, সেটা নিজে অনুভব করছিলাম।এর মধ্যে সেই রবীনকাকু আত্মহত্যা করলেন,তখন আর  নাটকের কথা আর কেউ বলে না।   তিনটে বছর নিজেকে খারাপ হওয়া থেকে অনেকবারই বাঁচালাম। কিন্তু যা চাইছিলাম তা পেতে আরো কিছুটা সময় চলে গেল। সুযোগ এল রতন ঘোষের সমুদ্র সন্ধা্নে নাটকে অভিনয়ের।
“এবারেও কি পাড়ায় মাচা বেঁধে?”
“হ্যাঁ, গত বছর বাবুল সান্ন্যাল পরিচালনায়  পাড়ার কম বয়সী মেয়েদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্মীর পরীক্ষা নাটকটি অভিনীত হয়। প্রশংসা শুনেছি, বিশেষ করে কয়েকজনের অভিনয়। যদিও নাটকটি আমার দেখা হয়নি অসুস্থতার কারণে। এই নাটকটির সাফল্য পরের বছর আবার একটি নাটক করার জন্যে সকলে উৎসাহিত করল বাবুলদাকে। এবার মেয়েদের নাটকের পাশাপাশি, ছেলেদের একটি নাটক করার কথা ভাবা হল, প্রথমে সমুদ্র সন্ধানে নাটকটির মূল চরিত্রে অভিনয়ের আমাকে মনোনীত করা হয়। পরে এক স্কুল শিক্ষক যিনিও এই নাটকে একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করছিলেন তাঁর আপত্তিতে মুল চরিত্রটি বাবুল সান্যাল এবং আমাকে একটি পার্শ্ব চরিত্র দেওয়া হয়।
“তোমার কোন অভিমান হয়নি”।
“না, নাটক করতে পারাই আসল উদ্দেশ্য ছিল, সেই ছোট্ট পার্শ্ব চরিত্র নিয়ে ভেবেছিলাম, ফলও পেয়েছিলাম। নাটকটি ছিল সমুদ্রে যারা মাছ ধরতে যায়, তাদের নিয়ে।মহাজন দাদান দিয়ে মাছ ধরতে পাঠাত। এই মাছ ধরতে গিয়ে নানান বিপদের সম্মুখীন হয়।  সেই জন্যেই তাদের একজন গুণীন থাকে, তার মন্ত্রশক্তির ওপর তাদের অপার বিশ্বাস। গুণীনের সহায়তায় বিপদ যেন কাটিয়ে নিরবিঘ্নে ফিরে আসতে পারে সমুদ্র থেকে।পরে সেই মহাজন সুদ সমেত আদায় করত দাদনের টাকা। তারা এক প্রকার শোষিত হত মহাজনের দ্বারা।  আমি সেই গুণীনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম।  আমার অভিনয়ের কথা নাটকের শেষে আলোচিত হল। লালুদার মেয়ে অন্য নাটকটিতে অভিনয় করছিল বলে উনিও এসেছিলেন, এই মাচার নাটক দেখতে। বাবুল সান্যাল তখন নট-রঙ্গ এ অভিনয় করে, লালুদাই বাবুল সান্যালকে বলেছিলেন আমাকে নট-রঙ্গ এ নিয়ে যাবার জন্যে। আর তো ফিরে দেখার কোন প্রশ্ন ছিল না নন্দিনী।
“বারে বারে তুমি লালুদার কথা বলছ, তিনি কি তোমাদের পাড়াতেই থাকতেন”।
“না, আমাদের পাড়া থেকে সামান্য দূরেই থাকতেন, উনি সুশান্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,  চারুচন্দ্র কলেজের ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান। আমাদের অঞ্চলে একটি নাট্যদল ঐকতান অনেক পুরানো, ওই দলের মধ্যমণি বিভু ভট্টাচার্য, ছোট থেকে চলচিত্রে অভিনয় করেছেন, পরেও যথেষ্ঠ নাম করেছিলেন। তবে সেই দলটি ছিল অনেকটাই ভট্টাচার্যি গোষ্ঠী কেন্দ্রিক। সেখানে স্বেচ্ছায় গিয়ে অভিনয়ের কথা কখনো ভাবিনি। তাছাড়া আমাদের অঞ্চলটা তখন  নকশাল অধ্যুষিত হওয়ায় পুলিশের তৎপরতা বেড়েছিল, বিশেষতঃ আমাদের মত বয়সের ছেলেদের রাতে ঘোরাঘুরি মোটেই নিরাপদ ছিল। এরই মধ্যে সুবীর ভট্টাচার্য ( টুলুদা) কেদারনাথ ইস্কুলের শিক্ষক, অনেকদিনের বাসিন্দা, তাদের উঠানে নট-রঙ্গ এর গোড়া পত্তন হয়েছিল। এর পরে পরেই  এলাহাবাদ থেকে নট-রঙ্গ একাঙ্ক নাট্য প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকটি পুরষ্কার নিয়ে এলো। আমাদের পাড়ায় সৃজনবাবু কেদার নাথ স্কুলের অন্য একজন  শিক্ষক ওনার বাড়ীতে নট-রঙ্গ এর কুশীলব’রা ছুটির দিনে জমায়েত হত । এলাহাবাদে নাট্য প্রতিযোগিতায় সারা ভারতে বিভিন্ন ভাষাভাষি  নাট্যদল সেখানে অংশ নেয়, সুতরাং সেখান থেকে পুরষ্কার জিতে আসায় এলাকায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এই সময় আমার একটু ঈর্ষার কারণ ঘটে। পাশের পাড়ার একটি কম বয়সী মেয়ে অমিতা নটরঙ্গ র সঙ্গে এলাহাবাদ গিয়েছিল একটি নারী চরিত্রে অভিনয় করতে। অমিতা যথেষ্ঠ সুন্দরী নাচে গানে পারদর্শিনী। আমাদের দিকে একটু অনুকম্পার দৃষ্টিতেই তাকাত, তার  অবলীলায় নটরঙ্গ ‘এ সকলের সাথে সামিল হওয়ার আমার কাছে ঈর্ষারই কারণ। তাই যখন নটরঙ্গ এ ডাক পেলাম, এতদিনের সুপ্ত বাসনা শুধু  ফলপ্রসূ হওয়া নয়, অনুভব করেছিলাম জীবনের এক সন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছি।
“এ কথা বলছ কেন? একটা নাট্যদলে নাটক করতে সুযোগ পাওয়া কি জীবনের সন্ধিক্ষণ হতে পারে”।
“আপাতদৃষ্টিতে পারে না নন্দিনী, ঠিক সেই মুহুর্তে যে, সে কথা মনে হয়েছিল তাও নয়, ধীরে ধীরে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম লালুদার সংস্পর্শে আসার পর। এর আগের কয়েক বছর যদি লক্ষ্য করি তাহলে আমি কিছুটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলাম সঙ্গদোষে, প্রথমে নট-রঙ্গ,আর নট-রঙ্গ মানেই লালুদা যাঁর চৌম্বুকীয় আকর্ষণ আমার কক্ষপথটাকে পালটে দিল , এর পর প্রেম না কোন  সমারোহে আসেনি অতি ধীরে ধীরে এসেছিল,  আজকে সেটা প্রসঙ্গ নয়, কখনো যদি  মনে হয় বিস্তারিত আলোচনা করব”।
“শুনতে ইচ্ছে করছিল, যাকগে নাটকের কথাই হোক”।
“ হ্যাঁ নন্দিনী আজ সেই কথাই হোক, নটরঙ্গ এ তখন নতুন নাটক শুরু হয়েছে, উমানাথ ভট্টচার্যের “ঠগ”। এই নাটকের মূল বক্তব্য ছিল “You can fool some of the people all of the time, and all of the people some of the time, but you can not fool all of the people all of the time.”  কথাটা আব্রাহাম লিঙ্কনের। নাটকটি মূলতঃ স্যাটায়ার, যেটা আজও দেখতে পাই, বিশেষ রাজনৈতিক দলের কাছে মিডিয়ার বিকিয়ে যাওয়া। নাটকের মূল কেন্দ্রস্থল একটি খবরের কাগজের অফিস। একটি অযোগ্য লোককে বসানো হয়েছে সম্পাদকের পদে। এই চরিত্রটি অভিনয় করতেন লালুদা।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।