বিল্টুদের বাড়ির পেছনে একটা পুরনো শিবমন্দির আছে । আগে বেশ ঘটা করেই পুজো হত । শরিকি বিবাদে কয়েক বছর পুজো বন্ধ । শিবলিঙ্গ আছে । কেউ কেউ মাঝে মাঝে এসে জল দিত । এখন তাও বন্ধ । জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশ । ভাঁট-আকন্দ গাছে ভরে আছে মন্দিরের চারপাশ । কেউ খুব একটা যায় না । বিল্টুর পড়ার ঘরের জানালা খুললে মন্দির দেখা যায় । পরিষ্কার নয় , অস্পষ্ট । আম আর জামরুল গাছের ওপরে জন্মেছে ধুন্দুল । ঝুলে থাকে । বাতাস দিলে নড়ে । বিল্টুর দেখতে খুব ভালো লাগে ।
ক্লাস ফাইভে পড়া বিল্টু শুনেছে ওই মন্দির খুব জাগ্রত । কত জনের কত অভিজ্ঞতা হয়েছে । মন্দিরের ডান দিকে বেলগাছ । শতাব্দী প্রাচীন । সেই গাছে নাকি বুড়ো বাবা থাকেন । কে এই বুড়ো বাবা ? এই বুড়ো বাবা হচ্ছেন সয়ম্ভু শিব– বাবা মহাদেব । তিনি ভক্তদের বাঞ্ছাকল্পতরু । আগে কত লোক আসত । মেয়েরা মানত করত । বেলগাছের তলায় জল ঢালত । ধূপ-দীপ জ্বেলে দিত । এসব বিল্টু অবিশ্যি দেখেনি । মায়ের মুখে ধুনেছে । ঠাকুরমাও বলেছে বুড়োবাবার মাহাত্ম্য কথা। সব বিল্টুর মনেও নেই ।
মাঝে মাঝে জানালা খুলে ওদিকে তাকালে বুকটা কেমন হা হা করে । কে যেন ডাকে ? কে ডাকে ? নাকি মনের ভুল — বিল্টু বোঝে না । সে শুনেছে শিব মন্দিরের পিছনে একটা বড় পুকুর আছে সরকারদের । সারা বছর জল থাকে । আরো শুনেছে আগে ওই পুকুরে শিবরাত্রি আর নীলপুজোর দিন বুড়ো বাবাকে স্নান করানো হত । পূজারী ঠাকুর গত হলে পর বেশ কয়েক বছর সেসব বন্ধ । ছোটবেলায় এই মন্দিরে কত যে এসেছে বিল্টু– কিছু কিছু মনে আছে । কিন্তু মন্দিরের পিছনে কখনো যায়নি ।
সে শুনেছে পেছনের পুকুরটা জুড়ে বাঁশবাগান । ঘন , বাঁশ নুয়ে থাকে নীচে । মচমচ শব্দ হয় । রাতে প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডাকে । প্রথম দিকে খুব ভয় পেলেও এখন আর ভয় পায় না । অভ্যেস হয়ে গেছে । সেই বাঁশ বাগান পেরিয়ে মাঠ– চাষের জমি — শহরে যাওয়ার পাঁকা রাস্তা ।
বিল্টুর খুব ইচ্ছে মন্দিরের পেছনে যাওয়ার । যাবে যাবে করেও যাওয়া হয় না মায়ের জন্যে । মা এবং ঠাকুরমা সর্বদা ওকে আগলে রাখে । তাছাড়া সে নিজেও কিছুটা ভিতু প্রকৃতির । ভিতু বলেই যাওয়ার গরজটা কম ।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা বিল্টু পড়ছিল । জানালা খোলা । পর্দা বসন্তের মৃদু বাতাসে উড়ছে । চারপাশে বেশ মিঠে একটা গন্ধ ।
পড়তে পড়তে বিল্টুর কানে এলো শুকনো পাতার খচমচ শব্দ । সে ভাবল কুকুর -বেড়াল । কিন্তু না অনেক সময় ধরেই চলছে ।বিল্টু মনে হয় ভয় পেল । ভাবল চোর । না না , চোর কেন হবে , ভূত হতে পারে ! এই ভেবে যেই চেয়ার থেকে উঠতে যাবে , অমনি ভাঙা ভাঙা একটি বৃদ্ধ কন্ঠ ভেসে এলো : ভয় পেও না । আমি তোমার বন্ধু ।
— বন্ধু ? কেমন বন্ধু ? কোথায় আছো ? ঘরে এসো । একসঙ্গে অনেকগুলি প্রশ্ন করল বিল্টু ।
অদৃশ্য কন্ঠটি বললে , আছি । সব জায়গায় আছি । সময় হলে দেখতে পাবে । একটা কথা বলি শোন , তোমার জানালার কাছে যে মন্দির , সেই মন্দিরের পাশে যে বেলগাছ , তাতে অনেক বেল হয়েছে । আমার খুব বেল খেতে ইচ্ছে করছে । কাল একটা সময় করে ওই গাছ থেকে বেল কুড়িয়ে শিবমন্দিরে রেখে আসবি । বলে সে থামল ।
বিল্টু বললে , আমার যে খুব ভয় করে যেতে ।
— ভয় পাস না । ভয়কে জয় করতে হবে । আমি তো সঙ্গে আছি । বললে সেই অদৃশ্য কণ্ঠ ।আচ্ছা , আমি এখন যাচ্ছি , বলে চলে গেল অদৃশ্য বৃদ্ধ কণ্ঠ ।
এসব শুনে তো বিল্টুর পড়াশুনো সেদিনের মতো ইতি । সে ছক কষতে লাগল কাল কীভাবে বেল কুড়োতে যাওয়া যায় । গিয়ে সে কী দেখবে ? কে এসেছিল ? আর কেন-ই বা এসেছিল ? এই কী বুড়োবাবা ? এই রকম হাজার একটা প্রশ্ন ছোট্ট বিল্টুর মাথায় । একবার ভাবল ঠাকুরমাকে বলবে সব কথা । কিন্তু না বলতে পারল না ।মাকে তো বলাই যাবে না । মা শুনলে নির্ঘাৎ আটকে রাখবে । কোথাও যেতেই দেবে না । যা থাকে কপালে সে কাল দুপুরে সবাই যখন ঘুমুবে , তখন গিয়েই কাজটা করে আসবে । তাতে হয়ত বুড়োবাবা খুশিই হবেন ।এসব ভাবতে ভাবতেই খেয়ে শুয়ে পড়ল সে ।
পরদিন স্কুল ছিল না । উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে বলে ওদের ছুটি । দুপুরে ঠাকুরমা নিজের ঘরে সিরিয়াল দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছেন । মা একটা পত্রিকা বুকের ওপর রেখেই ঘুমুচ্ছে দেখে বিল্টু সাহস করে বাইরে বেরিয়ে এলো ।
চুপি চুপি ধীর পায়ে পৌঁছে গেল পুরনো শিব মন্দিরের খুব কাছে । কাছাকাছি কত যে ধুতুরা , ভাঁটফুলের গাছ । এখনো দু-চার জন আসে হয়ত । ঝোপজঙ্গল থাকলেও তা অতটা ঘন নয় । সহজেই ভেতরে প্রবেশ করা যায় । ওদের বাড়ি থেকে যে পথটা মন্দিরে চলে গেছে সে পথেই সে গেল । বেলগাছটার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল । নিচে কত যে শুকনো পাতা ঝরে আছে । এখানে দাঁড়িয়ে গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল । বিল্টু দেখল নিচে দু-চারটে পাকা বেল পড়ে আছে । সে একটা বেল তুলে মন্দিরের সিঁড়িতে এনে রাখলে । তারপর তাকিয়ে থাকল ভেতরে বিগ্রহের দিকে । কালো রঙের পাথরের শিবলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে । ভেতরে ঝুল আর ধুলো । পচে যাওয়া শুকনো আকন্দের মালা শিবলিঙ্গের মাথায় পড়ানো । বিল্টু যখন বিগ্রহের দিকে তাকানো একটা বৃদ্ধ গলা শোনা গেল : বিল্টুবাবু কী করছ এখানে ? শুনেই বুকটা কেঁপে উঠল । বিল্টু চারদিকে তাকাল । কেউ কোত্থাও নেই । কেবল হাওয়া । খসে পড়ল পাতা ।
বিল্টুর মনে হল আওয়াজটা আসছে মন্দিরের পেছন থেকে । কিন্তু সেখানে যেতে মা নিষেধ করেছিল । ভূত না অপদেবতা কী সব যেন থাকে । তবু আজ যেতে ইচ্ছে করছে । এখন তো দুপুর । খটখটে রোদ । ভয় কী ! ভয়কে তো জয় করতে হবে । এসব ভাবতে ভাবতে বিল্টু মন্দিরের পেছনে এসে পৌঁছুলো ।
পেছনে তেমন কেউ আসে না । একটা নিম গাছ । দীর্ঘদিনের । এই নিমগাছের পেছনেই পুকুর । এখন ফাল্গুনের শেষ– জল খুব কম ।
বিল্টু এক পা দু-পা করে নিম গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল , অমনি ওর যেন কী একটা হল ।মুহূর্তে পৌঁছে গেল অন্য জগতে । কত সুন্দরী মহিলা পুজো দিতে আসছে বুড়ো বাবার মন্দিরে । পুকুরটা চমৎকার সাজানো । আলো জ্বলছে । সিঁড়িতে পুরুষরা সাদা ধুতি পরে স্নান করে পুজো দিতে চলেছে মন্দিরে । শোনা যাচ্ছে ঘন ঘন সমবেত কন্ঠে ” জয় বুড়ো বাবার জয়” । বিল্টু যেন অন্য পোশাকে । জামা-প্যান্ট কোথায় ? সেও তো ধুতি আর উত্তরীয় পরেছে । কপালে সিঁদুরের তিলক ।
বিল্টুর সামনে দীর্ঘ জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসী এসে দাঁড়ালে । বললে , তুমি কে ?
— বিল্টু ?
— এখানে এসেছ কেন ?
— এমনি । বুড়ো বাবাকে বেল দিতে এসেছি । কাল একজন বলছিল…
–কী বলছিল ? জানতে চাইল সেই সন্ন্যাসী লোকটা ।
–বললে , বুড়ো বাবা সর্বত্র-ই আছেন । তাঁকে যেন বেল দিয়ে আসি । আচ্ছা , তুমি কে ?
সন্ন্যাসী লোকটা হাসতে হাসতে বললে , ও এই কথা — আমি-ই তো বুড়ো বাবা ।
বিস্মিত হল বিল্টু । তু –তুমি বুড়ো বাবা !!
— কী বিশ্বাস হচ্ছে না ? বলে একটা কী যেন দিলো নিজের ঝোলা থেকে বার করে বিল্টুর হাতে ।
বিল্টু দেখলে কী সব চকরা-বকরা আঁকা একটা মুদ্রা । সে তাকালে সন্নাসী লোকটার দিকে । লোকটার চোখে স্নেহের ভাষা । একটুও ভয় নেই । চারিদিক থেকে ভেসে আসছে ধূপের গন্ধ । মন্ত্রের সমবেত উচ্চারণ ।
সন্ন্যাসী লোকটি বললে , আমি এখানে আছি । বহু কাল থেকে । বহু যুগ থেকে । তুমি মাঝে মাঝে আসবে আমার কাছে ।
অদ্ভুত তো । মুহূর্তে সব মিলিয়ে গেল । কেউ নেই । কিচ্ছু নেই । কোকিল ডাকছে । শেষ বেলার রোদ এসে লেগেছে বিল্টুর মুখে । বিল্টু কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো মন্দিরের পেছন থেকে নিজের ঘরে চলে এলো । সবটাই যেন কিছু মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে গেল । সে দেখলে মা তখনো ঘুমুচ্ছে ।
নিজের ঘরে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ পর হাতের মুঠো খুলে দেখলে একটা প্রায় গোলাকার বস্তু । অনেকটা দু-টাকার কয়েনের মতো , তবে অনেক ভারী । সে বুঝতে পারল না কী এইটে ? চিন্তা করতে বসে গেল । মনে হল ইতিহাস বইতে এই রকম ছবি সে অনেক দেখেছে । বিল্টু মনে মনে ঠিক করলে সন্ধ্যায় ইতিহাস স্যার আসবেন । তাঁকে দেখাতে হবে এই জিনিসটা । স্যার ঠিক বলতে পারবেন যে , এই বস্তুটি কী ?
ইতিহাস স্যারের সঙ্গে খুব ভাব বিল্টুর । তিনি পড়ান কম গল্প করেন বেশি– গল্পের মধ্য দিয়ে ইতিহাসকে তুলে ধরেন ছাত্রছাত্রীদের সামনে । তাই স্কুলেও তাঁর ভক্ত সংখ্যা খুব । তাঁর কাছে নিঃসংকোচে সব বলা যায় । তাছাড়া ইতিহাস স্যার বাবার বিশেষ বন্ধু । বিল্টুকে খুব স্নেহ করেন ।
তিনি সব শুনলেন মন দিয়ে । তারপর বাবা-মা আর ঠাকুরমাকেও সব গুছিয়ে বললেন । মা তো শুনেই রেগে গেলেন । বাবা বললেন , যত বড় হচ্ছো তত-ই অবাধ্য হয়ে উঠছ । ঠাকুরমা কিছু বললেন না । স্নেহের সঙ্গে হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায় । বললেন , আর কখনো যেও না দাদু ।
ইতিহাস স্যার বললেন , বিল্টু না বলে গিয়ে খুব অন্যায় করেছে সত্য কিন্তু ও একটা দারুণ কাজ করেছে তা আপনারা দেখছেন না ।
–কী আবার দারুণ কাজ ? মা জানতে চাইলে ।
স্যার বললেন , দীর্ঘদিন ইতিহাস চর্চা আর গবেষণা করে জেনেছি এই অঞ্চলটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ । গুপ্তযুগের কিছু কিছু নিদর্শন আগেও আশেপাশের গ্রাম থেকে পাওয়া গিয়েছে । তেমন কিছু পোক্ত প্রমাণের অভাবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আগ্রহ দেখাচ্ছিল না । বিল্টু যেটা পেয়েছে বা ওই সন্ন্যাসী ওকে দিয়েছে সেইটে আমার অনুমান গুপ্তযুগ বা তৎপরবর্তী যুগের মুদ্রা । যদি সত্যিই তাই হয় । ওই জায়গাটা খনন করাও হতে পারে । একটা ইতিহাস আবিষ্কারের সঙ্গে বিল্টুবাবুর নিম জড়িয়ে যাবে ।
–সে নয় বুঝলাম , কিন্তু সন্ন্যাসী এলো কোত্থেকে ? সে নাকি বুড়ো বাবা — এ কী বিশ্বাস হয় ? বললে বিল্টুর বাবা ।
ঠাকুরমা প্রতিবাদ করে বললে , বিশ্বাস না করার কী আছে ।বিশ্বাস থাকলে সব হয় ।আসলে তিনি খুব জাগ্রত দেবতা । আবার পুজো চান ।
ঠাকুরমাকে সমর্থন করলেন স্যার । বললেন , ঠিক কথাই বলেছেন মাসিমা । আপনারা পড়ার লোকেরা মিলে মন্দিরটা সংস্কার করুন । আবার পুজো হোক । লোকজন আসুক । আর ইতিহাস থাকলে তো কথাই নেই । জায়গাটা টুরিস্ট স্পট হয়ে উঠবে ।
এসব কথা শুনতে শুনতে বিল্টু অবাক হচ্ছে । গল্পের মতোই লাগছে সবসকিছু কিন্তু রহস্যটা থেকেই যাচ্ছে । কে সেই সন্ন্যাসী — সত্যিই কী বুড়ো বাবা ? কে সেদিন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বেল খেতে চেয়েছিল ? বলেছিল ভয়কে জয় করবার কথা !