কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

গহনা বড়ি
ভারতে বা বাংলায় অনেক খাবার যেমন বিদেশী আগমনের ফলে উদ্ভব হয়েছে তেমনি কিছু খাবার নিজেরও রয়েছে। বিশেষ করে নানান ধরণের শাক সবজি কিংবা ডালের ব্যবহার। কারণ ভারতবর্ষের সমতল ভূমির বেশিরভাগই নদীমাতৃক। ফলে জলের অসুবিধে খুব একটা নেই। আর চাষবাসও দিব্য হয়৷ যদিও ইতিহাস বলে বর্তমান দিনকালের মতো বিপুল চাষ আগে হত না৷ বৃষ্টিহীনতা কিংবা অনুন্নত চাষের পদ্ধতি৷ তাই বলে কি চাষ হত না একেবারেই? না। মোটেই না। ধান, গম, নানান ডাল শাক সবজি বরাবরই হয়েছে৷ ভারতে নানান ধরণের ডালের চাষ হয়। আমাদের বাংলার মাটি এই ডাল চাষ থেকে একেবারেই পিছিয়ে নেই৷ বিশেষ করে মাসকলাই, মটর ডাল, মুসুরডাল, মুগডাল ইত্যাদি৷
এটা খুবই স্বাভাবিক যে, যেই ফসল উৎপাদন হয় সেই ফসলকে ঘিরেই মানুষের খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে৷ বড়ি তেমনই একটা বস্তু৷ ঠিক কবে বা কিভাবে বড়ি বানানো শুরু হয়েছিল তা আমার জানা নেই। বোধ করি বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই শিল্প ছিল৷
“রান্ধিল পুতিকা শাক দিয়া ফুলবড়ি
চুঁয়া চুঁয়া ঘৃতে ভাজা করে পলা কড়ি”
— রূপরাম চক্রবর্তী, গোলাহাট পালা, ধর্মমঙ্গল
বড়ি প্রধান খাবার নয়, এ হল অনুষঙ্গ। শাকের তরকারি থেকে ঘন্ট কিংবা শুক্তো, বাংলার সেরার সেরা রান্নাগুলো কেবলমাত্র বড়ির সংযোগের কারণেই স্বাদে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়৷
মেদিনীপুরের মেয়ে হওয়ার কারণে বড়ি আমার কাছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ শিল্প। যেমন বিষ্ণুপুরের পোড়া মাটির শিল্প, কিংবা নদীয়ার তাঁত মেদিনীপুরের অনেক শিল্পর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বড়ি। বলা ভালো গয়না বড়ি৷ যা তৈরি হয় মূলত বিউলির ডাল থেকে৷ তবে গয়না বড়ি ছাড়াও নানান ধরণের বড়ি তৈরি হয়, যা তরকারিতে ব্যবহার করা হয়। অবশ্যই এক এক তরকারির এক একরকম বড়ি। যেমন শাক বা কুমড়োতে দেওয়া হয় ফুলবড়ি, শুক্তোতে মশলা বড়ি, আলু মাখায় টোপা বড়ি, আবার ঘন্টতে চালকুমড়োর বড়ি। আর গরম গরম ধোঁয়া ওঠা বাটি উঁচু ভাতের কোলে বনেদি গয়নার মতো শুয়ে থাকে গয়না বড়ি৷
শীতকাল এলে যেমন ধান তোলা, প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপূজা, মকর সংক্রান্তি, নবান্ন ইত্যাদি উৎসবে মেতে উঠতাম তেমনি আরও একটি উৎসব ছিল বড়ি দেওয়া। মা কাকিমারা কতটা উৎসব ভাবতেন আমার জানা নেই৷ কিন্তু আমাদের ছোটদের কাছে উৎসব তো বটেই। আগের দিন সকাল সকাল খোসা সমেত বিউলির ডাল ভিজিয়ে রাখা হত। বিকেল হলেই বাড়ির অন্যান্য কাজ সারার আগে, ঘাটের সিঁড়িতে বসে বসে মা কাকিমা কিংবা ঠাকুমারা গামলা ভর্তি কলাই ও জল নিয়ে বসে পড়ত। হাত দিয়ে ঘষে ঘষে খোসা বার করে বার বার ধোয়ার মাধ্যমে পরিষ্কার করে নিত এই ভেজানো ডাল৷ এরপর অন্যান্য কাজ সেরে সন্ধেতে বসে শিল পাট্টায় পিষে নিত৷ সব বাড়ি থেকেই প্রায় একই শব্দ আসত। আমরা বুঝে যেতাম পরের দিন সকালে সারা ছাদ জুড়ে দেখা যাবে শিল্পের মেলা। আর তেমনটাই হত। একজন হাত দিয়ে ফেটিয়ে যেত আর একজন বড়ি দিত৷
প্রতিটা মেয়ের বাড়ির জন্য আলাদা বড়ি হত৷ তিন থাকের গয়না বড়ি৷ ডিজাইনগুলো আলাদা, সুন্দর৷ যেন মেয়ের বাড়ি থেকে কোন নিন্দে মন্দ না শুনতে হয়৷ এই সব বড়ি দেওয়া হত নেট বা জালের ওপর নইলে মাদুর কাঠির তৈরি পাটায়৷ আর বিশেষ কিছু বড়ি থালায় পোস্ত ছড়িয়ে তার ওপর দেওয়া হত৷ সেগুলো বিশেষ বিশেষ দিনে খেতে দেওয়া হবে৷ এই হল মেদিনীপুরের বিখ্যাত গয়না বড়ি৷ আমরা বংশ পরম্পরায় মা ঠাকুমাদের দেখে দেখেই দিতে শিখে গেছি৷ আর সে কারণেই আজও আনন্দে দিই৷
একসময় নরম কাপড়ের ওপর এই বড়ি দেওয়া হত। কিন্তু ব্রিটিশদের আগমনের পোস্তর ব্যবহার শিখল মানুষ৷ সে এক ব্যবসায়ী গল্প। পলাশীর যুদ্ধের পর পাকাপাকি ভাবে ব্রিটিশদের বাংলায় বসবাস শুরু হল। তারা যে এখানে থাকতে খেতে এসেছিল এমন তো নয়, এসেছিল বানিজ্য করতে, মুনাফা লাভ করতে। সেই সময় চিনে বেআইনি ভাবে আফিম বিক্রির বিশাল বাজার ছিল। আমরা প্রত্যেকেই জানি আফিম থেকে বেদনানাশক ওষুধ তৈরি করা হয় বহু বছর আগে থেকেই৷ আবার অতিরিক্ত মাত্রায় আফিম সেবন একপ্রকার মাদক সেবনের মতই৷ যুগে যুগেই আলোর তলায় অন্ধকার জন্ম নিয়েছে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের উন্নয়নের পাশাপাশি ক্ষয়ও কুরে কুরে খেয়েছে৷ ওষুধের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি মাদকের ব্যবহারের কারণেই আফিমের চোরাকারবারি৷ ব্রিটিশরা বুঝল নীল চাষের পাশাপাশি এই আরেক জায়গা যেখানে বিপুল মুনাফা লাভ করা যাবে৷ রাঢ় বাংলার মাটি আফিম চাষের জন্য উপযুক্ত – কথাটা বোঝার সাথে সাথেই তারা এই সমস্ত জায়গার চাষীদের একপ্রকার বাধ্য করল পোস্ত চাষ করতে৷ আর সেখান থেকে আফিম নিষ্কাশন করে তা চীনে পাচার করে ব্যবসা চালু করল। আফিম বার করে নেওয়ার পর যে পোস্ত বীজ পড়ে থাকত তা শুরুর দিকে ফেলে দেওয়ারই চল ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে রাঢ় অঞ্চলের মানুষরা একে ব্যবহার করতে শিখল। যে কারণে আজও সারা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, বর্ধমান জেলার রান্নায় পোস্ত এক বিশেষ উপকরণ। আর মেদিনীপুরের গয়না বড়িও পোস্তর বিছানায় দেওয়ার চল হয়ে উঠল।
মেদিনীপুরের গয়না বড়ির ব্যবহার আমরা আগন্তুক সিনেমাতেও দেখি। আর রবিঠাকুরের শান্তিনিকেতনেও স্থান পেয়েছিল।
ময়ূর, মাছ, পাখি কিংবা বনেদি গয়নার ডিজাইনে তৈরি এই বড়ি তৈরির জন্য আলাদা করে কোন স্কেচের প্রয়োজন হয় না। কাপড়ের মাঝে ফুটো করে লোহা বা টিনের চোঙ ঢুকিয়ে বাটা বিউলির ডাল দিয়ে এক টানে এই অপূর্ব ডিজাইন দিয়ে ফেলে গ্রামের মেয়েরা। যেন জন্ম থেকেই এই প্রশিক্ষণ তাঁরা পেয়েছেন। আজ আমিও যখন শীতকালে দিই, আমার মেয়ে শিখে যায় কিভাবে হাত ঘোরাতে হয় বা কতটা টিপ দিলে বড়ি দেওয়া সহজ হবে৷
১৯৩০ সালে সেবা মাইতি নামে শান্তিনিকেতনের এক ছাত্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তার মা হিরন্ময়ী দেবী ও ঠাকুমা শরতকুমারী দেবীর তৈরী গয়না বড়ি উপহার দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গয়না বড়ির শিল্পকলা দেখে এতটাই মুগ্ধ ও অবাক হন যে তিনি গয়না বড়িগুলির ছবি তুলে তা শান্তিনিকতনের কলা ভবনে সংরক্ষণ করার অনুমতি চেয়ে হিরণ্ময়ী দেবী ও শরতকুমারী দেবীকে চিঠি লেখেন। এর ফলে গহনা বড়ি চারুকলার নিদর্শন হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আবার অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর গহনা বড়িকে এমন শিল্প বলেই মনে করতেন যে তাকে রান্না করা বা খাওয়াকে শিল্পকর্ম ধ্বংসের সামিল বলে মনে করতেন। তাহলে, গয়না বড়ি আসলেই যে কত সুন্দর রূপের হয় তা বোধকরি স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একবার বলেছিলেন, গয়না বড়ি শুধুমাত্র দেখার জন্য, খাওয়ার জন্য নয়। তিনি এই গয়না বড়ির শিল্পকর্মের সাথে মধ্য এশিয়ার খোটানে আবিষ্কৃত প্রত্নতত্ত্বের শিল্পকর্মের সাদৃশ্য খুঁজে পান এবং গহনা বড়ির প্রদর্শনীর যথাযথ ব্যবস্থা করেন। নন্দলাল বসু গহনা বড়িকে বাংলা মায়ের গয়নার বাক্সের একটি রত্ন বলে বর্ণনা করেন। অথচ এই গয়না বড়ি আমরা এতো খানি দেখতে ও বানাতে অভ্যস্ত যে এই সমস্ত বিষেশণ আমাদের মেদনীপুরের লোকেদের কাছে যেন অবাক করা বিষয়৷
ছোটবেলায় ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছিলাম, তমলুকের মেলায় গয়না বড়ি বিক্রি হত, আর প্রদর্শনীও দেওয়া হত। ঠাকুমার মামিমারা নানান ধরণের বড় বড় থালার মাপের ডিজাইন বানিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন। সেসব গল্প যেন সত্যিই গল্পে পড়া কল্পনার মতো।
আজও গয়না বড়ি পাওয়া যায় নানান মেলায় কিংবা অনলাইন বিক্রিও হয়৷ আমার ধারণা পুরনো দিনের থেকে বর্তমানে বড়ির বাজার অনেক বেশি ভালো। কারণ কুরিয়ার ডেলিভারি বা ইন্টারনেটের যুগে বাড়ি বসেই নানান ডিজাইন দেখার সুযোগ ও বাইরে পাঠানোর সুযোগ বড়ির বাজার অনেক বেশি উজ্জ্বল করেছে৷ আর এভাবেই বাংলায় বহু প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে গিয়েও টিকে আছে। খানিক বেশি মানুষের মাঝে আজও নাম রূপ উজ্জ্বল করে নিজেকে ধরে রেখেছে৷