হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে রাজকুমার ঘোষ

বিট্টুর সঙ্গী

বিট্টু তার স্বপ্নে হরিদাদুর সফর সঙ্গী… হরিদাদু সিঙ্গাপুরের সুসজ্জিত সিনেমা হলে ঢুকে দু’দুটো সিনেমা দেখে ফেলল।
তারপর… নবম পর্বে…

রাত্রে সিঙ্গাপুর শহরে অসংখ্য নাইট ক্লাব। সেখানে সারারাত্রি আলোর ঝিলমিল। সেখানে বেশীর ভাগ চীনে মেয়েরাই আপ্পায়নে ব্যস্ত। সিঙ্গাপুরের সিনেমা হলে হরি দু’দুটো হিন্দি সিনেমা দেখে নিল। বিশ্বজিৎ এর ‘এপ্রিল ফুল’ ও দিলিপ কুমারের ‘লিডার’। দুটো সিনেমা দেখেই হরি ভীষণ উৎফুল্ল। এমন একটি সিনেমা হলে ভারতীয় সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হতে সে ভীষণ আনন্দ পেল। সিঙ্গাপুরে নেভী জাহাজ অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিনস, ভারত, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে আসে। শহরের পশ্চিমে চ্যাপেল ডকইয়ার্ড এবং পূর্বে সেম্বুয়াং ডকইয়ার্ড। পূর্বপ্রান্ত শহর থেকে দূরে। সেখানে সাউথ ইন্ডিয়ানদের কলোনী যেন নতুন সিটি।
সিঙ্গাপুরের প্রতিটি লোকের জীবনযাত্রার মান খুব হাই-ফাই। এমনকি গরীব জনতারও নিজস্ব ফ্লাট আছে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে সিঙ্গাপুরের শাসনব্যবস্থা দুর্বল ছিল। ষাটের দশকের শেষে এক যুবক শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন পুরোনো বৃটিশ আইনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটায়। বৃদ্ধদের সরিয়ে যুবকদের শাসন ব্যবস্থায় নিয়ে আসা হয়, যাদের বয়স ৩৫ থেকে ৪৫ বৎসর পর্যন্ত। শিক্ষিত যুবক শাসকবৃন্দ দেশের জন্য নতুন কড়া শাসন ব্যবস্থার প্রচলন করার সঙ্গে সঙ্গেই সিঙ্গাপুরের আশাতীত উন্নতি হয়। এই সুন্দর শহরে দু’দিন থেকে হরির জাহাজ আবার চলতে থাকে থাইল্যান্ডের ব্যাংককের দিকে…

বেশ লম্বা ঘুমের মধ্যে বিট্টু তার হরিদাদুর সাথে অনেক জায়গায় ঘুরে নিল। হরিদাদুর গল্প বলার ধরণে বিট্টু বেশ প্রভাবিত। তার চোখের সামনে যেন ভাসছে। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই চোখের সামনে গেঞ্জী ও সাদা প্যান্ট পড়া, মাথায় টুপি দেওয়া রোগা-পাতলা লোকটাকে দেখে বিট্টু হতভম্ব হয়ে গেল। লোকটি ওর দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। বিট্টুও অবাক হয়ে লোকটাকে দেখতে থাকল। বিট্টুর সাথে লোকটিই প্রথম কথা বলা শুরু করল,
“কি বাবা, বাড়িতে ঘুম হয়নি বুঝি! এখানে এসে ঘুমোচ্ছিস? তারপর ঘুমের মধ্যে কত কথা বলছিলিস। রেঙ্গুন, কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর… এইসব নাম কোথা থেকে পেলি? আমি তো এইসব নাম শুনিনি। যাই হোক, তুই এখানে কেন? বাড়ি কোথায় তোর? এইভাবে রাতে পার্কের মধ্যে ঘুমোচ্ছিস। যদি কেউ তুলে নিয়ে যায়”
“হ্যাঁ কাকু। বাড়িতে একদম ভালো লাগে না। যে তুলে নিয়ে যাক, আমি তার সাথে চলে যাব”
বিট্টুর কথা শুনে লোকটা অবাক হয়ে গেল। তারপর,
“তোর নাম কি? কোথায় থাকিস? সেটা তো বল”
“আগে তুমি কোথাও ঘুরতে নিয়ে চলো, তারপর সব বলব”
বিট্টু হরিদাদুর ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার মুখস্থ করে নিয়েছে। ভাবছিল লোকটাকে সাথে নিয়ে হরিদাদুর বাড়িতে যাবে। তবে লোকটি ওর কথার প্রত্যুত্তরে জানাল,
“ঠিক আছে। তবে চল আমাদের গ্রামে, ঘন জঙ্গলে ঘেরা। কত গাছ, পাখি, পুকুর… কত কি আছে সেখানে। তোর খুব ভালো লাগবে”
বিট্টু লোকটির কথা শুনে বেশ খুশি হল। সে ভাবল, আগে লোকটার সাথে সেখানেই যাবে, তারপর হরিদাদুর বাড়ি যাওয়া যাবে। সে উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“বাহ। খুব মজা হবে কাকু। আমার নাম বিট্টু। তোমার নাম কি কাকু?”
“আমার নাম ঘোতন”
নাম শুনেই বিট্টু খুব হাসতে লাগল। সে বলল,
“কি নাম বললে কাকু, ঘোতন। শুয়োরের মত ঘোঁৎ ঘোঁৎ করো বুঝি?”
ওর কথা শুনে ঘোতন বেশ রেগে গেল। কিন্তু রাগ প্রকাশ করল না। সে বিট্টুকে বলল, “চল খোকা, আমরা বেরিয়ে পড়ি”
এরপর ঘোতনের সাথে বিট্টু রাতের অন্ধকারে কাছের একটি রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিল। সেখান থেকে ট্রেন ধরে ঘোতনের বলা সেই গ্রামে চলে যাবে। কিন্তু ট্রেনে উঠেই বিট্টুর মাথাটা ঘুরতে লাগল। তারপর গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল।

বিট্টু অতল ঘুমে আচ্ছন্ন। সে কোথায়? জানে না। হরিদাদু ওর স্বপ্নে এসেছে আবার… তার সাথে কথা বলছে। বিট্টু হরিদাদুকে একটা দুঃখের কথা জানায়।
“দাদু, ঐ দুষ্টু মেয়েটা, খুব অন্যায় করেছে”
“কি করেছে? দাদুভাই”
“মা, দাদু-ঠাম্মার এক্সিডেন্ট হয়নি। ড্রাইভার রামলালের সাথে মিলিত হয়ে ইচ্ছা করে এক্সিডেন্ট করিয়েছে। রামলাল তার এক সাথীকে গাড়ি চালাতে দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়”
“মানে?”
“মা, রামলালকে ফোন করে বলছিল, ‘তুই চিন্তা করিস না, তুই যেখানে আছিস, চুপচাপ থাক। একদম এদিকে আসবি না। তোর টাকা সময়মত পেয়ে যাবি”
“কি বলছিস বিট্টুসোনা? তাহলে রত্না প্ল্যান করে সকলকে খুন করেছে”
বিট্টু খুব কাঁদতে লাগল। হরিদাদুর কথাগুলো বিট্টুর সম্মুখে আবার ভেসে এল,
“যখনই নিজেকে একলা মনে করবে, নিজের মায়ের কথা মনে করবে। আর ’যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’- এই গানটা মনে মনে গাইবে। আর শোনো, এই দুনিয়ায় সবাই একা। ঘরের ভেতর বা বাইরে, যেখানেই হোক, এই জগতে ভালো খারাপ অনেক মানুষই আছে। দেখবে একলা থাকার অভ্যাসের সাথে সঠিক পথ ঠিক খুঁজে পাবে, দাদুভাই। মনে সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবে। কেউ একজন ঠিক তোমার পাশে চলে আসবে।”
এটা ঠিক যে, বিট্টু নিজের কানে রত্নার কথাগুলো শুনেছে। সে রত্নাকে বেশ ভয় পেয়েছে। খুব চিন্তায় সে, তার বাবাকে রত্না কিছু করবে না তো? কেন যে বাবা বুঝতে পারছে না, বিট্টুর মাথায় ঢুকছে না। সে তার বাবাকে চিৎকার করতে বলতে চায়। কিন্তু কোনও ফল হবে না। পরিবর্তে রত্নার কারসাজিতে বাবার হাতে মার খেতে হবে। …… ঘুমের রাজ্যে বিট্টু তার হরিদাদুকে এই সত্যটা বলে অনেকটা হালকা অনুভব করল। হরিদাদুর এক একটা কথা বিট্টুকে অনেক উৎসাহ যোগান দেয়। সে এবার হরিদাদুর কাছে আবদার করল,
“দাদু, এবার তুমি সিঙ্গাপুর থেকে কোথায় গিয়েছিলে?”
“এখন শুনবে? এবার তুমি ঘুমোও দাদুভাই। তুমি যে গভীর ঘুমে আছ। কিছুই বুঝতে পারবে না”
“না, দাদু। আমি সব শুনব… প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ”
বিট্টুর নাছোড়বান্দা মনোভাবে হরিদাদু হাসতে হাসতে শুরু করলেন…
হরিকৃষ্ণ মিত্র, জাহাজে করে সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাংককে চলে এল। ব্যাংকক থাইল্যান্ডের রাজধানী। এককথায় বলা যেতে পারে, অপরাধীদের ডেরা। এখানে অপরাধমূলক কাজকর্মে লীপ্ত দুনিয়ার যত ফালতু মানুষের বাস বলা যেতে পারে। এছাড়াও পর্যটকদের কাছে বিশিষ্ট স্থান। সারাবছর ব্যাংককে প্রচুর পর্যটকের ভীড়। থাইল্যান্ডের অধিবাসীরা অধিকাংশই চিনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। শহরে অনেক ভারতীয় প্রধানতঃ শিখ সম্প্রদায়ের লোকের বাস। থাইল্যান্ডের পূর্ব নাম শ্যামদেশ। থাইল্যান্ডও ভারতের মত কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে এখনও রাজতন্ত্র বিরাজমান। পাশের দেশ চীন থেকে দলে দলে লোক এসে এখানে বসবাস করে।
ব্যাংকক শহরে অনেক বড় বড় হোটেল আছে। সব বড় হোটেলেই অনেক মেয়েরা চাকরি মেয়েরা অধিকাংশই ১৬ থেকে ২০ বৎসরের মধ্যে। এছাড়া এখানকার মেয়েদের মধ্যে একটা ফ্যাশন মনোভাব আছে। তাছাড়া অনেককাজেই তারা লীপ্ত থাকে। সেসব কথা নাই বা উল্লেখ করা হল। হরি, বেশ কিছু সাথীদের নিয়ে একটি বড় হোটেলে বিউটি প্রতিযোগিতা দেখতে গিয়েছিল। সেখানে এক নম্বর সুন্দরীর সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ পেয়ে যায়। মেয়েটির বাড়ী শহর থেকে অনেক দূরে, বয়স ১৯ বছর। হরিকে তার বাড়ী নিয়ে যায়। একতলা কাঠের বাড়ী। অনেক গুলো ঘর। ওর বাবা মা ও একটি ছোটবোন। ছোট বোন স্কুলে পড়ে। বাবা ও মা দুজনেই চাকরী করে। অনেক বড় এলাকা নিয়ে এদের বাড়ী। বাড়ির প্রবেশ পথে একটি সুন্দর ফুলের বাগিচা। বাড়ীর ভেতরে অনেক নারিকেলের গাছ দেখা গেল। একজন মালী আছে তার ঘর ও বাগিচার পাশেই ঘরবাড়ী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। টি. ভি., রেডিও, ফ্রিজ, গাড়ীর গ্যারেজ সব আছে। প্রতিবেশী বহু মুসলমানও থাকে। তারা সকলেই মুরগী পালন করে। যেন প্রত্যেক বাড়ীতেই মুরগীর পোলট্রি। ছোটবোন ইংরেজী মাধ্যমে স্কুলে পড়ে।
যাইহোক, মেয়েটির পরিবার হরিকে খুব আপ্যায়ন করল। হরির সাথে আলাপ হতেই মেয়েটির মা জানাল, “থাইল্যান্ড গরীব দেশ। এখানে সব মেয়েদেরই একটু লেখাপড়া শিখে চাকরীর খোঁজে শহরে যোগাযোগ রাখতে হয়। চাকরীর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্মানহানী হয়”

থাইল্যান্ড সম্বন্ধে জানা গেল… এরপর পড়ুন দশম পর্বে…

এই গল্পের সাথে বিদেশ সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্যসূত্র, গুগল ও বিভিন্ন ভ্রমন বিষয়ক বই পড়ে নিজের মত করে সাজানো…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *