T3 – স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় ইন্দ্রাণী ঘোষ

কেমন ছিলেন অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যারা?
‘সে এক নিদারুন সময় । অত্যাচার দেখে গায়ের লোহিত কনিকা টগবগ করে ফুটত।’ কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম । বলেছিলেন আমার প্রমাতামহী । শ্রীমতি প্রীতিলতা ঘোষ। তাঁর গা ঘেঁষে বসে স্বাধীনতার গল্প শুনতে দিব্যি লাগত । জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘লোহিত কনিকা টগবগ করে ফোটার মানে কি গো?” উত্তরে বুড়ি সেদিন নিজের গায়ের চাদরের নীচে আমাকে টেনে নিয়ে বলেছিল ‘সে এক প্রেমের সময় দিদি। প্রেম বোঝ তো?’
‘বিলকুল বুঝি, দস্তুরমত প্রস্তুত আমি। আজ ঝাঁপি খুলেই ফেল।এই তো শুধু তুমি আর আমি। আর কেউ নেই।’ এরপর বলতে শুরু করলেন আমার অশীতিপর বুড়ি আম্মা। শ্রীমতী প্রীতিলতা ঘোষ। স্বাধীনতা সংগ্রামী। সেই অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা। ‘আমার বিয়ে হয়েছিল ১৯ বছর বয়েসে। গায়ের রঙ কালো ছিল। তাই আমার বাবা অনেক গয়না দিয়েছিলেন। আমার বর ছিল উকিল।”এই বলে একটু দম নেন বৃদ্ধা। কিশোরী আমি অস্থির হয়ে বলি ” তারপর? বর খুব সুন্দর ছিল বুঝি?’ লাজে রাঙ্গা হন না বৃদ্ধা। শুধু অত্যন্ত উজ্জ্বল চোখদুটো চকচক করে ওঠে। ‘আমার বর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য বিনি পয়সায় মামলা লড়তেন দিদি।” আহা, বৃদ্ধার চোখে সে কি আলোর ছটা। না থেমেই বলে চলেন তিনি। ” আমার বর বলল স্বাধীনতা এক প্রেম। দেশপ্রেম। আমায় ভালবাসলে যে দেশকেও ভালবাসতে হবে । প্রীতির লতা হলে হবে না তোমায় প্রীতির কঠিন ব্রত নিতে হবে। দরকার হলে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’ ব্যাস যেই বলা সেই কাজ। লাঠি খেলা শিখলাম । চড়কা কাটা শিখলাম হুগলীতে, গান্ধীজির আশ্রমে। দেশর জন্য আর বরের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত আমি। কোল জুড়ে তিনটি ছেলেমেয়ে এল। এরপর এক সময় আমার বরকে পুলিশে ধরল।আমার বুকের পাঁজর ভেঙে গিয়েছিল দিদি। কিন্তু ভাঙলে তো হবে না। আমায় তো লড়তে হবে। গান্ধীজি তখন এসেছিলেন আমাদের বাড়ী। ব্রিটিশ দ্রব্য বয়কট করতে হবে। আশ্রমে বোনা কাপড় নিয়ে যেতে হবে বাজারে। সেই কাপড় বাজারে বিক্রী হবে। ব্যারাকপুর আশ্রমের থেকে গাড়ি বের হতে না হতেই আমরা ধরা পড়লাম পুলিশের হাতে। পুলিশ মারতে মারতে গাড়ীতে তুলে নিল । সেই টগবগ করে গায়ের রক্ত ফুটতে শুরু করল। ভাবছি কত মারবি মার, আমরাও শেষ দেখে ছাড়ব। জেল থেকে যখন ছাড়া পেলাম তখন লিখেছেন রজনীকান্ত সেন “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই । দীন দুখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্যি নাই।” রবি ঠাকুর লিখছেন ‘ বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান,তুমি কি এমনি শক্তিমান’। এসব গান শুনলে পরে গায়ের রক্ত তো টগবগ করে ফুটে উঠবেই দিদি। এই গানে বুকের মধ্যে নিয়েই যে প্রতিটা পল আমরা লড়েছি, বেঁচেছি,মরেছি। এই গানের প্রত্যেকটা অক্ষরকে আমরা অন্তরে ধারন করেছিলাম।” সেইদিন বুড়ি আম্মার কাছেই পাঠ নিয়েছিলাম প্রেম আর দেশপ্রেম কেমন করে মিলে যায়। কেনই বা ‘মুক্তির মন্দির সোপানও তলে কত প্রাণ হল বলিদান। লেখা আছে অশ্রু জলে।’ গাইতে গিয়ে ইশকুলে আমাদের চোখ আপনা থেকেই ভিজে উঠত। দেশাত্মবোধক গান আসলে প্রেরনা,ভালবাসার মিশেল।
আরেকটা গল্প শুনেছিলাম বুড়ি আম্মার কাছে। হিজলি জেলের বিখ্যাত গল্প। জোর করে এক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে জেলের ভিতর খাবার খাওয়াতে গিয়েছিলেন একজন ডাক্তার ।সেই ভারত মায়ের বীর পুত্র কষিয়ে এক চড় লাগিয়েছিলেন সাহেবদের ডাক্তারকে। জেল থেকে টেলিগ্রাম গিয়েছিল ‘ Dr stabbed” যাতে আসলে লেখা থাকা উচিত ছিল ‘Dr slapped”। ব্যাস,বড়লাট হুকুম পাঠালেন “ফায়ার”। টেলিগ্রামের ছাপার অক্ষরের ভুলের ফলে গুলি চালিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার হিজলি জেলে কয়েদীদের উপর। সেই হল কুখ্যাত “হিজলি জেল ফায়ারিং কেস।’ বুড়ি আম্মারা জেনানা ফটকে বসে সে খবর পেয়েছিল। আবারও তাদের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠেছিল।
এরপর বুড়ি আম্মার স্বামী মারা যান। জেলে তাঁকে স্লো পয়েজেনিং করা হয়েছিল। তিনটি দুধের সন্তানকে নিয়ে সেদিন ছাব্বিশ বছরের যুবতী আমাদের বুড়ি আম্মা সুভাস বোসের দেওয়া ইস্কুলের চাকরি করে স্নাতক হন,বি. এড পাশ করেন। শ্বশুরবাড়ির কেউ পাশে দাঁড়ায় নি। উলটে সব গয়না নিয়ে নিয়েছিল। তবে ভিটেছাড়া করতে পারে নি সেই অগ্নিকন্যাকে। বুড়ি আম্মার প্রথম সন্তান মারা যায় কয়েকদিন পর দুদিনের টাইফয়েডে। বাবা, মা স্বাধীনতা সংগ্রামী । বুড়ি আম্মার সেই বড় মেয়ে তেরো বছরের তনিমার উপরেই ছিল সংসারের সব দায়িত্ব। সে মেয়ে আম খেতে চেয়েছিল জ্বরের মুখে।আনতে পারে নি বুড়ি আম্মা। এইটুকু বলে চুপ করে যায় আশি পেরনো বৃদ্ধা। নাহ। চোখ তাঁর শুকনোই থাকে। শুধু কোনদিন তারপর থেকে আম মুখে তোলেন নি তিনি। কেউ তাঁর সামনে বাড়িতে আম নিয়ে যেত না, খেত না, সকলে ভয় পেত। এমনি তাঁর দাপট ছিল। হবে না? তিনি যে অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা। তাঁর কি আর যেমন তেমন তেজ। প্রেম ,দেশপ্রেম মেলানো বিপুল শক্তির আধার তাঁরা সকলেই। ইতিহাস তাদের মনে রাখে নি। শুধু তাঁরা রয়ে গেছেন আপনজনের ধুলোমাখা গল্পের খাতায় বিনা অভিযোগে ।